বাড়ছে শীত আর বিরল শিশুরোগ

শীতকাল শিশুদের জন্য সুন্দর হলেও, এসময় ঠান্ডা আবহাওয়া, শুষ্ক বাতাস এবং বন্ধ পরিবেশের কারণে সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। আর দেখা দেয় বিরল অথচ বিকট সব রোগ। শিশুদের রোগবালাইয়ের শেষ হবে না তালিকা। আজ আরও কিছু শিশুরোগ নিয়ে লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

চিলব্লেইনস
ঠান্ডার সংস্পর্শে সৃষ্ট এক বেদনাদায়ক প্রদাহজনিত ত্বকের রোগ এটি, যার ফলে হাত ও পায়ের আঙুল, কান বা নাকের চামড়ায় লালচে-বেগুনি রঙের চুলকানিযুক্ত ফোলা দাগ দেখা দেয়, যা অত্যন্ত জ্বালা করে। কখনও এই ক্ষতগুলো ফোসকা পড়ে ঘা হয়ে যায় বা খোসা ওঠে; গুরুতর ক্ষেত্রে সংক্রমণ মারাত্মক ছড়িয়ে পড়ে কিংবা স্থায়ী দাগও থেকে যেতে পারে।

কেন বিরল : ভারতের সাধারণত মৃদু শীত, যখন গড় তাপমাত্রা ১০-২৫°সেঃ, তখনই এই রোগ তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে দীর্ঘস্থায়ী স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডায়, যখন তাপমাত্রা ১০°সেঃ-এর কম, অর্থাৎ উচ্চ আর্দ্রতায়, বিশেষ করে তখনই উত্তর বা পার্বত্য অঞ্চলে, যেমন হিমাচল, কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ডে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। দুর্বল রক্তসঞ্চালন, পাতলা ত্বক, বা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের ঝুঁকি বেশি। অনেক সময় একে সাধারণ ‘শীতের চুলকানি’ বা ‘ফ্রস্টবাইট’ বলে ভুল নির্ণয় করা হয়।
প্রাদুর্ভাব : সার্বিকভাবে এটি বিরল, প্রায় ০.৫%-এর কম, শিশু-চর্মরোগের ক্ষেত্রে। তবে শৈত্যপ্রবাহ চলাকালীন উচ্চভূমি বা গ্রামীণ অঞ্চলে হঠাৎ বেড়ে যায়; স্থানভেদে আক্রান্ত শিশুদের হার ১-৫% পর্যন্ত হতে পারে।

আরও পড়ুন-হরমনপ্রীতের দাপটে জয় ও হোয়াইটওয়াশ

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : হাত-পা উষ্ণ ও শুকনো রাখা, প্রয়োজনে উলের মোজা ও দস্তানা ব্যবহার করা, আকস্মিক তাপমাত্রা পরিবর্তন এড়ানো জরুরি। আক্রান্ত স্থানে কুসুমগরম জলে ধীরে ধীরে উষ্ণতা ফিরিয়ে আনা উচিত, গরম জলে নয়। জেদি ক্ষত হলে হালকা কর্টিকোস্টেরয়েড মলম বা নিফেডিপিন ব্যবহার করা যায়; সংক্রমণ হলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। যত্ন নিলে সাধারণত ১-৩ সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যায়।
ঝুঁকির কারণ হিসেবে বলা যায়, কম বিএমআই, রক্তাল্পতা বা পরিবারে রেনো’স সিনড্রোমের ইতিহাস থাকলে এই সমস্যার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নগরাঞ্চলের দূষণও প্রদাহকে আরও তীব্র করতে পারে। সাধারণত জানুয়ারির শৈত্যপ্রবাহের সময় জম্মু, শিমলা বা দার্জিলিংয়ের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মধ্যে এর কিছু ঘটনা দেখা যায়, তবে দক্ষিণ বা উপকূলীয় ভারতে এটি বিরল। ফ্রস্টবাইটের সঙ্গে এর পার্থক্য হল— ফ্রস্টবাইটে ত্বক বরফে জমে যায়, কিন্তু চিলব্লেইন হয় হিমাঙ্কের ওপরে স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডায়, বিশেষ করে আর্দ্র পরিবেশে। প্রতিরোধের জন্য বাতাস চলাচল করতে পারে এমন স্তরযুক্ত উষ্ণ পোশাক পরা উপকারী। ঠান্ডার সংস্পর্শের পর যদি শিশুর ত্বকে লালচে ফোলা দাগ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে ভাস্কুলাইটিস বা রক্তনালির প্রদাহের সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায়।
গুলি-বারে সিনড্রোম
এটি একটি বিরল স্ব-প্রতিরোধ জনিত স্নায়ুরোগ, যেখানে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেরই পার্শ্ববর্তী স্নায়ুগুলিকে আক্রমণ করে। ফলে দ্রুত পেশিশক্তি হ্রাস পায়, হাতে-পায়ে ঝিনঝিন বা অবশ ভাব দেখা দেয়, এবং গুরুতর ক্ষেত্রে প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে— যা সাধারণত পা থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে উপরের দিকে ছড়ায়। শিশুদের মধ্যে হাঁটতে অসুবিধা, মুখ বেঁকে যাওয়া বা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যা কখনও কখনও ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন পর্যন্ত গড়ায়।

আরও পড়ুন-‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পের ১০ লক্ষ সাইকেল কেনার প্রক্রিয়া শুরু

কেন বিরল
ভারতে এর সামগ্রিক প্রকোপ খুবই কম। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১ লক্ষ শিশুর মধ্যে মাত্র ১-২ জন। তবে শীতকালে এর প্রকোপ কিছুটা বাড়ে। কারণ, এই সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা, আরএসভি বা এন্টারোভাইরাসের মতো সংক্রমণ বেশি হয়, যা শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করে এই রোগকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। ঠান্ডা আবহাওয়া, ঘরোয়া ভিড়, কুয়াশা ও দূষণময় বাতাস এই সংক্রমণ বিস্তারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে, বিশেষত উত্তর ভারতের শহরাঞ্চলে।
প্রাদুর্ভাব : শিশু স্নায়ুবিদ্যার তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এর হার ০.৫%-এরও কম, তবে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের পর দিল্লি ও লখনউয়ের মতো শহরের হাসপাতালে শীতকালীন কয়েকটি ক্লাস্টার দেখা গেছে। সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশুরাই এতে বেশি আক্রান্ত হয়।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : এর কোনও নির্দিষ্ট প্রতিরোধ নেই, তবে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি— কারণ প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন বা প্লাজমাফেরেসিস থেরাপি দিলে রোগের অগ্রগতি থামানো যায়। সহায়ক চিকিৎসা যেমন ফিজিওথেরাপি ও ভেন্টিলেটরি সাপোর্টও গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ শিশুই ছয় থেকে বারো মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সেরে ওঠে, যদিও ৫-১০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিছুটা পেশিশক্তি হ্রাস দীর্ঘস্থায়ী হয়।
নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই রোগটি প্রায়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে একে প্রায়ই পোলিও বা স্ট্রোক বলে ভুল ধরা হয়। আসলে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে স্নায়ু পরিবাহিতা পরীক্ষা, যাকে ডাক্তাররা বলেন, নার্ভ কনডাকশন স্টাডি। এ-ছাড়াও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বা সুষুম্না রস বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যেখানে ‘অ্যালবুমিনোসাইটোলোজিক ডিসোসিয়েশন’ নামের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি দেখা যায়।
প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু-রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগের সূত্রপাত ঘটে শীতকালের শ্বাসযন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণের পর। দূষিত জল বা খাবার থেকে ছড়ানো ক্যাম্ফাইলোব্যাক্টর জেজুনি ব্যাকটেরিয়া এর অন্যতম প্রধান উদ্দীপক। ভারতের চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ বা আইসিএমআর এবং শীর্ষ হাসপাতালগুলির সমীক্ষা অনুযায়ী, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে গুলি-বারে সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ২ থেকে ৩ গুণ বেড়ে যায়— যা কুয়াশা, ধোঁয়াশা ও ভাইরাল সংক্রমণের বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত।
অভিভাবকদের জন্য সতর্কতার সংকেত হল— শিশু হঠাৎ হাঁটতে না চাওয়া, দুই পাশের পেশিতে সমান দুর্বলতা বা রিফ্লেক্সের অনুপস্থিতি। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে, কারণ দুই সপ্তাহের মধ্যে ইমিউনোগ্লোবুলিন চিকিৎসা না পেলে ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। যদিও এই রোগটি বিরল, তবুও এটি একটি স্নায়বিক জরুরি অবস্থা। শীতকালীন ফ্লু বা ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়া শিশুদের মধ্যে যদি দুর্বলতার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায়, তবে দ্রুত শিশু-স্নায়ু-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই জীবনরক্ষাকারী হতে পারে।
আমাদের কথা
এর বাইরেও শীতকালে শিশুদের মধ্যে আরও অনেক বিরল রোগ দেখা যায়, যেমন কেরাটোলাইটিক উইন্টার ইরিথেমা ও নানা ধরনের জেনেটিক ডিজিজ, ঠান্ডাজনিত পরিবেশে বাড়তে পারে। সচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই রোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ। এই রোগগুলো খুব কম দেখা যায়, তাই অভিভাবকেরা সচেতন থাকলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

Latest article