এ-বছরের ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে শীতের অনুভূতিই বলে দিচ্ছে পরিবেশ বা জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে বর্তমান আবহাওয়ার সার্বিক পরিস্থিতিতে সামান্য শীতের আমেজ ফিরেছে। কিন্তু দিবালোক দীর্ঘায়িত হয়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার স্থায়িত্ব বেশি হওয়াতে এই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বাংলায় শীতের প্রভাব কার্যত থাকবে না বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদেরা। পরিবেশ তথা জলবায়ুর পরিবর্তন যে এর জন্য দায়ী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরিবেশের অংশ
পৃথিবীর জটিল পরিবেশ এবং জলবায়ু যা একে অপরের সঙ্গে সর্বদা সমন্বয় রেখে চলে, তাদের মোটামুটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১) বায়ুমণ্ডল যা পৃথিবীর উপরিভাগের বায়ুস্তর।
২) পৃথিবী-বেষ্ঠিত জলরাশি যা পৃথিবীর উপরিভাগের দুই তৃতীয়াংশ।
৩) পৃথিবীর দুই মেরুপ্রান্তে থাকা বিশাল বরফরাশি।
৪) পৃথিবীর বাকি অংশের মাটি বা পাথুরে অংশ (লিথোস্ফিয়ার) এবং
৫) সম্পূর্ণ প্রাণিজগৎ বা জীবজগৎ।
পরিবেশের পরিবর্তন : এই পাঁচটি বিভাগের যে কোনও একটিতে কোনও ঘাটতি হলে তা সময়ের সাপেক্ষে অন্যগুলির উপরেও সরল অথবা জটিলভাবে প্রভাব বিস্তার করবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আর এই ঘাটতি তৈরিতে তাপের মতো শক্তিশালী বা সমকক্ষ আর কেউ নেই।
এই পৃথিবীর জলবায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য তিনটি অংশ দায়ী।
১) পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন ও তাপমাত্রার ৬০০০ ডিগ্রি পর্যন্ত বিভাজন।
২) পৃথিবীর দিকে আসা সূর্যের তাপপ্রবাহ এবং
৩) জলবায়ুর উপরিলিখিত নিজের পাঁচটি অংশের অবিরত, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সৌজন্যে এক থেকে অন্যত্র অনুপ্রবেশ বা রূপান্তরের প্রবণতা।
পৃথিবীর গঠন ও প্রভাব
পৃথিবীর অভ্যন্তর নানা রকম স্তরে গঠিত। প্রতিটি স্তরের তাপমাত্রা, অবস্থা আলাদা। একদম কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গলিত তরল অবস্থায় আছে। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে পৃথিবীর ভেতরের তাপ যথাক্রমে আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের সঙ্গে পৃথিবীর ওপরে চলে আসে এবং সমুদ্র বা জলবায়ুর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং বায়ুমণ্ডলের ওপর স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে। বস্তুত দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলের কাছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এরই উদহারণ। এই ঘটনায় ওই অঞ্চলের সমুদ্রের নিচের অংশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য নানারকম প্রোটিনসমৃদ্ধ জীবজগৎ সমুদ্র সমতলে ভেসে ওঠে এবং আহার হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। এই ঘটনাকে এলনিনো বা ক্রাইস্ট-চাইল্ড বলা হয়। ২ থেকে ৮ বছর বাদে-বাদে পুনরাবৃত্তি হয়। এই ঘটনায় সমগ্র সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। আবার যখন এর বিপরীত ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়, তখন তাকে লা-নীনা বলে। দক্ষিণ গোলার্ধের এলনিনোপ্রসূত তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বায়ুমণ্ডলের উপর বাষ্পায়নের প্রভাবকে এলনিনো সাউদার্ন অসিলেশন বা এনসো বলে।
তাপ পরিবহণ
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গরম থেকে ঠান্ডা জায়গায় তাপ পরিবহণের জন্য নানা ধরনের উলম্ব ঘূর্ণন গতি আছে। যেমন বিষুব অঞ্চল থেকে মেরু প্রান্তে তাপ পরিবহণের পদ্ধতি হিসাবে আছে হেডলি সেল, ফেরারেল সেল এবং পোলার সেল। এগুলিকে মেরিডিওনাল সার্কুলেশন বলে। তেমনি বিষুবরেখা বরাবর তাপপ্রবাহের জন্য উলম্ব ঘূর্ণন গতিকে ওয়াকার্স সার্কুলেশন বা জোনাল সার্কুলেশন বলে। এলনিনো, লা নিনা, এনসো ইত্যাদি ঘটনার জন্য উলম্ব তাপগতির সমস্ত মেরিওডিওনাল ও জোনাল সার্কুলেশন বা ওয়াকার সার্কুলেশন বিঘ্নিত হয়। অর্থাৎ যে জায়গায় বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি হওয়ার কথা, সেখানে বায়ুর নিম্নমুখী গতি হয় অথবা এর বিপরীত হয়। আর যেখানে বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি সেখানে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হবে এবং বৃষ্টিপাত-সহ নানা ঘটনা ঘটবে। কিন্তু যেখানে বায়ুর নিম্নমুখী গতি সেখানে বায়ুর উচ্চচাপ অঞ্চল তৈরি হবে এবং ফলস্বরূপ খরা হওয়ার সম্ভবনা। এই সমস্ত ঘটনার প্রভাবে জায়গা বিশেষে খরা, বন্যা-সহ অপরিণত মনসুন, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি ও নানাবিধ প্রাকৃতিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। পেরু অঞ্চলের এই ঘটনা ভারতীয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ও শীতকালীন উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর ওপর প্রভাব পড়ে। নানা কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তাপ, বায়ু এবং সমুদ্রজলের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সুদূরপ্রসারী এই প্রভাবকে মিটিওরোলজিকাল টেলিকম্যুনিকেশন বলা হয়।
বায়ুমণ্ডলে প্রভাব
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য উল্লিখিত ওই দুই তাপপ্রবাহের সার্কুলেশন বিঘ্নিত হয়ে ভারতীয় উত্তর-পশ্চিম মৌসুমিবায়ুর সিনোপটিক অবস্থান পরিবর্তন হয়। যার জন্য এ-বছর একটিও পশ্চিমি ঝঞ্ঝা তৈরি হয়নি। আবার তিব্বতের ওপর শুষ্ক বাতাসের পরিবর্তে উপগ্রহচিত্রে প্রচুর আর্দ্রতা-সহ মেঘের স্থায়িত্ব বেড়ে গেছে। এই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে চিরচারিত বায়ুর গতি সাধারণত উত্তর বা উত্তর-পূর্বমুখী হয়। পথে হিমালয় পাহাড়ের গা বেয়ে আর্দ্র বাতাস এ-পারে এসে শুষ্ক ও গরম হাওয়ায় পরিণত হয়। শুষ্ক বায়ু ও আর্দ্র বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী ল্যাপ্স রেট-এর তারতম্যের জন্য এটা হয়। অর্থাৎ হিমালয় পাহাড় সংলগ্ন গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র উৎস থেকে ঠান্ডা হওয়ার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত গরম হাওয়া আসছে। এইরকম কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে শীতের প্রভাব কমের দিকে।
প্রতিকার
পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৫,০০০০০০,০০০ বৎসর। যদি আমরা পরিবেশের প্রয়োজন অনুযায়ী সুশৃঙ্খল জীবন যাপন না করি তবে আর ৫০০ বছরের মধ্যে আমাদের এই পৃথিবী বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে যাবে। গাছ পরিবেশ রক্ষার প্রথম সৈনিক। ভারতে জনপ্রতি গাছের সংখ্যা ২৮, আর কানাডাতে জনপ্রতি গাছের সংখ্যা ১০,১৬৩। সুতরাং আমাদের আর কালবিলম্ব করা একদম উচিত নয়। ‘গাছ বাঁচাও গাছ লাগাও’। গাছের প্রাণ আছে, গাছ প্রাণ দিতেও পারে। শহরের ঘনবসতিপূর্ণ ফ্ল্যাট জীবনযাপনে সীমাবদ্ধতা আনতেই হবে। প্রয়োজনে আরও পরিবেশ ও কৃষিজীবীবান্ধব নতুন নতুন শহরের প্রণয়ন করতে হবে।
জলবায়ুর পরিবর্তনে গায়েব শীত
জাঁকিয়ে শীতের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগই দিল না এ-বছরের অনিয়মিত আবহাওয়া। কখনও মাঝারি শীত আবার কখনও বেশ গরম— আবহাওয়ার এমন তুর্কিনাচনে শীতের মজাটাই মাটি। জলবায়ুর এই ব্যাপক পরিবর্তন শুরুর কারণ কী? বিস্তারিত আলোচনায় বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ রামকৃষ্ণ দত্ত
