মুহূর্তে বদলে যাচ্ছেন একজন মানুষ। হয়ে উঠছেন সম্পূর্ণ অন্য একটি চরিত্র। এমন একটি চরিত্র, যে চরিত্রের সঙ্গে পূর্বে কোনওদিনই হয়তো তিনি বসত করেননি। ফলে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও কিঞ্চিৎ মানসিক বদল ঘটছে তাঁর। বদলে নিচ্ছেন সাজপোশাক। রংতুলির ছোঁয়ায় বদলাচ্ছে বলিরেখা। ছড়িয়ে দিচ্ছেন, উড়িয়ে দিচ্ছেন মুঠো মুঠো সংলাপ, যে সংলাপ আত্মিকভাবে ঠিক নিজের নয়, একজন সার্থক অন্য মানুষ হয়ে ওঠার সহায়ক। এ এক আশ্চর্য প্রত্রিয়া। ঘটতে থাকে। ঘটতেই থাকে। তার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় আলোকালো মঞ্চের উপর। দর্শকদের সামনে।
আরও পড়ুন-আমাদের খুউব ভাল রেখেছেন, মোদীয় ভারতে আমরা দারুণ আছি
শীতের চাদরে মোড়া শহরে এই সময়ে এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছেন বহু মানুষ। হয়ে উঠছেন সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র। নতুন চরিত্র। কারণ, মহানগরে চলছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত পঞ্চবিংশ নাট্যমেলা। সেই কারণে দেশের সংস্কৃতির পীঠস্থান, এই মহানগর এখন উৎসবমুখর।
৭ ডিসেম্বর, কলকাতার রবীন্দ্র সদন প্রেক্ষাগৃহে নাট্যমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, মন্ত্রী তথা নাট্য ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু, নাট্য ব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ, নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার, বিভাগের আধিকর্তা সমন্বয় কৌস্তুভ তরফদার, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সচিব শান্তনু চক্রবর্তী প্রমুখ।
নাট্যমেলার কলকাতা পর্যায়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে ২৬টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক, ৪৭টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটক, ৮টি অণু নাটক, ৪টি অন্তরঙ্গ নাটক, ৩টি মূকাভিনয়, ৩টি পুতুল নাটক। এবারের উদ্বোধনী নাটক ছিল রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর ‘মাৎস্যন্যায়’। নির্দেশনায় অর্পিতা ঘোষ। প্রযোজনায় মিনার্ভা রেপার্টারি থিয়েটার। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রসদনে।
‘মাৎস্যন্যায়’ মূলত বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘টাইটাস অ্যান্ড্রনিকাস’ অবলম্বনে লেখা। পাশ্চাত্যের আলোকে প্রাচ্যকে দেখা আবার প্রাচ্যের গরিমায় পাশ্চাত্ত্যকে অবলোকন করার উদ্দেশ্যেই এই নাটক রচনা করেছেন নাটককার। নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতা। মানুষের আদিম প্রবৃত্তি অসম্ভবভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। নাটকটি প্রসারিত করেছে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র, দিয়ে গেছে তাজা, টাটকা, দূষণহীন বাতাস। ধরা পড়েছে ভারতীয় নাট্যধারার মৌলিকত্ব। অভিনয় করেছেন একঝাঁক নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী। মুগ্ধ করেছেন তাঁরা। আশা করা যায়, এঁদের কেউ কেউ অনেক দূর যাবেন। প্রেক্ষাগৃহ ছিল পূর্ণ। নাটকটি ঘিরে দর্শকদের মধ্যে দেখা গেছে বিপুল উন্মাদনা।
এ ছাড়া উৎপল ফৌজদার নির্দেশিত বাউড়িয়া পিপলস রেপার্টরি থিয়েটারের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, পঙ্কজ মুন্সী নির্দেশিত সমীক্ষণের ‘এবং গঙ্গারাম’, অভি চক্রবর্তী নির্দেশিত অশোকনগর নাট্যমুখের ‘আবার বাঞ্ছা’ প্রভৃতি নাটকগুলো নিয়েও দর্শকদের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্র সদনে।
রবীন্দ্র সদনের পাশাপাশি গিরিশ মঞ্চ, শিশির মঞ্চ, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহ, নিউ টাউন রবীন্দ্রতীর্থের প্রতিটি নাটক জয় করে নিচ্ছে দর্শকদের মন। এই প্রেক্ষাগৃহগুলোয় নাট্যমেলা চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। একমাত্র মধুসূদন মঞ্চে চলবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
আরও পড়ুন-শীতের বেড়ানোর প্রস্তুতি
নাট্য জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে থিয়েটারের বিশেষ আড্ডা ‘চায়ের ধোঁয়া’। আড্ডা-আলোচনার বিষয় ‘ভিন্নক্ষেত্রের থিয়েটার’, ‘নির্দেশকের জবানবন্দি’, ‘সংগঠনের অন্দরে বাহিরে’, ‘থিয়েটারের গবেষণা ও সংরক্ষণ’, ‘থিয়েটার সংগঠনে নারী ও পুরুষের ভূমিকা’। প্রতিদিন জমে উঠছে এই আড্ডা। এছাড়াও পরিবেশিত হচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যপূর্ণ লোকসংস্কৃতির অন্যতম অংশ লোকনাটকের ৭টি আঙ্গিক। সেগুলো হল খন, ডোমনি, আলকাপ, বেণীপুতুল, ডাংপুতুল, রং পাঁচালী ও ভাঁড় যাত্রা। দর্শক সমাগম ভালোই। একতারা মুক্তমঞ্চে থিয়েটার আড্ডা এবং লোকনাটক চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এইবছর পালিত হচ্ছে তৃপ্তি মিত্রের জন্মশতবর্ষ। সেই উপলক্ষে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় আয়োজিত হয়েছে তাঁর জীবন-আধারিত বিশেষ প্রদর্শনী ‘অপরাজিতা’। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকছে। প্রতিদিন দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা।
সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে রবীন্দ্রসদন-নন্দন চত্বরটি। রচিত হয়েছে নাটকের আদর্শ পরিবেশ। ব্যবহার করা হয়েছে নানারকমের মুখোশ। বিভিন্ন জায়গায় শোভা পাচ্ছে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, বিনোদিনী দাসী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, গোলাপসুন্দরী, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার প্রমুখের কাট আউট। নিচে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। বর্ণাঢ্য উপস্থিতি বহুরূপী এবং রণপা।
শহর কলকাতার পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, হুগলি, হাওড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন নাট্যদল। দেখা যাচ্ছে বিষয় বৈচিত্র্য। শীতের নরম হাওয়ায় শহরে উড়ছে নানা রঙের নাটকের সংলাপ। সবমিলিয়ে পঞ্চবিংশ নাট্যমেলা রীতিমতো জমে উঠেছে।

