সংস্কৃত ভাষার কাঁথাখানি গায়ে জড়িয়েই বাংলা গদ্য জন্ম নিয়েছিল বঙ্কিম কলমে। সে ছিল ভাষার এক বিহান বেলা। বাঙালির মাতৃভাষা তখন শুধু কথ্য ভাষা, তাতে ফলে না কোনও সাহিত্যফল। চর্যাপদ নিঃসন্দেহে বাঙালির গর্ব কিন্তু সে বাংলা তো বাঙালি চেনে না। মঙ্গলকাব্য ধর্মনির্ভর কবিতা। সে যুগে বাংলা সাহিত্য বেঁচে ছিল কবিতায় আরও বিশেষ বললে পয়ার ছন্দে, পাঁচালির ঢঙে। এটুকুই যা মোদের গরব, মোদের আশা। সাহিত্যের সেই সবে ভোর হয়-হয়-এর যুগে বাংলা গদ্য দেখল মুক্তির আলো— লেখা হল বঙ্কিম-কলমে প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী।
শুরুটা কিন্তু সোজা ছিল না, পথ অনেকটাই বঙ্কিম ছিল। সংস্কৃত ভাষা কিংবা ব্রজবুলি আর মৈথিলী ভাষায় সাহিত্য জগতে যে বাংলা ভাষা গদ্য সাহিত্যে পা রাখতে পারে সেটা ভাবনার বাইরে ছিল। প্রথম উপন্যাস হতেই পারত ফুলমণি ও করুণার বিবরণ কিংবা আলালের ঘরের দুলাল। ওগুলো বড় গল্পের মর্যাদাতেই আটকে রইল। সংস্কৃত ভাষার প্রভাব মেখেই আঠারোশো পঁয়ষট্টি সালে জন্ম নিল প্রথম বাংলা উপন্যাস, তাও কিনা লেখকের বিগত বারো বছর বাংলা আর সংস্কৃত চর্চার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।
আরও পড়ুন-নিট-কেলেঙ্কারিতে বিজেপি যোগ আরও স্পষ্ট, উঠে এল যোগীরাজ্যের বিধায়কের নাম
বঙ্কিম উপন্যাসে কাহিনির বিন্যাস ঘটে প্রায়শ একটি স্ত্রী চরিত্রকে ঘিরে। অর্থাৎ এখানে নারী চরিত্রগুলিই নায়ক। তাই প্রত্যেকটি চরিত্র এক-একটি বিশেষ গুণসম্পন্ন। অসামান্য সুন্দরী, স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত এবং গল্পের নিয়ন্ত্রক— এই নারী চরিত্রগুলি সে-যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বঙ্কিম সাহিত্যে পার্শ্বচরিত্রের মহিলারাও অলৌকিক সুন্দরী। অনেকটাই ভিক্টোরিয়ান যুগের স্যুররিয়ালিস্টিক ছবির মতো। এত সাজানো, শিক্ষিত, পরমাসুন্দরী নায়িকা তায় বুদ্ধিমতী, এমনকী কঠিন বিষয়ে পরামর্শদাতা তাই সে যুগের তুলনায় খানিক বেমানানও বটে। এজন্য বঙ্কিম কলমকে দেখতে হবে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। সাংখ্য দর্শনের অনুসারী বঙ্কিমচন্দ্র যে প্রকৃতিকে এবং সেই অনুসারে নারীকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী করে চিত্রিত করবেন এ তো বলাই বাহুল্য। তাই বঙ্কিম উপন্যাসের নারী এত শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমা। লেখকের তুলিতে— ‘নিশীথ-কৌমুদী দীপ্ত নদীর ন্যায় প্রশান্ত ভাব প্রকাশক। আর চক্ষুর বর্ণ ঊষাকালে সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্বে, চন্দ্রাস্তের সময় আকাশের যে কোমল নীলবর্ণ প্রকাশ পায়, সেইরূপ’; লেখকের এই বর্ণনার সাথে পাঠক খুঁজে পায় এক সরলা বালিকার ছবি যার চোখে এখনও সরলতার নীলচে ভাব। বয়স ষোলো কিন্তু অবিবাহিত। এখানেই পাঠক মন দাগা খায়— যে যুগে মেয়েদের আট পেরোলে একঘরে হতে হত সেখানে নায়িকা কিন্তু একেবারেই ন্যাচারাল। অন্য চরিত্র বিমলা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এমনকী পাঠান বা মোঘল কোন পক্ষ নিলে দুর্গেশ-এর সঠিক হবে তারও দিশা দেখায় যুক্তি দিয়ে। ‘বিমলার সভ্যতা ও বাগ্ বৈদগ্ধ এমন প্রসিদ্ধ ছিল যে তাহা সামান্যা পরিচারিকায় সম্ভবে না।’ সেই বিমলা পাঠক পরে জানতে পারবেন, দুর্গেশের স্ত্রী এবং দেখবেন কী অসাধারণ কাঠিন্যে পাঠান কতলু খাঁকে হত্যা করে স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। আর এক প্রধান নারী চরিত্র, কতলু খাঁর কন্যা আয়েষা বাইশ বছরের, অবিবাহিতা কিন্তু বোরখা বা হিজাব আবৃত নন। ‘আয়েষা রূপে আলো করিতেন কিন্তু সে পূর্বাহ্নিক সূর্য্যরশ্মির ন্যায়; প্রদীপ্ত, প্রভাময় অথচ যাহাতে পড়ে, তাহাই হাসিতে থাকে’।
খুড়তুতো দাদুর কাছে শোনা এক ঐতিহাসিক গল্প আর এক নিপুণ কল্পনার যুগলবন্দি যে বাংলা সাহিত্যে নতুন মোড় এনেছিল তাতে সন্দেহ কী!
আরও পড়ুন-নান্দীকার ৬৫
লেখক যখন পরাবাস্তব চরিত্র সৃষ্টি করেন তখন পাঠকমাত্রেই তাকে কাল্পনিক আখ্যা দেন। নেগুঁয়া মহকুমায় কর্মরত থাকাকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অনবরত সমুদ্র দেখেছেন কিন্তু দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য গাছগুলো যে কলঙ্করেখার মতো লাগে সেটা প্রকাশের ভাষা আর চোখ একান্তই লেখকের নিজস্ব ঘরানা। সেই সময় এক সন্ন্যাসী নিয়মিত তাঁর সঙ্গে রাত্রে দেখা করতে আসতেন। সেটাই বোধহয় কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের বীজতলা।
কপালকুণ্ডলা কাপালিক-পালিতা কন্যা। নিরাভরণ কপালকুণ্ডলাকে নবকুমার দেখলেন এবং মোহিত হলেন। ঠিক যা বলতে চাইলেন সেটা কতদিন পর মহুয়া কাব্যগ্রন্থে কবি লিখবেন ‘সাগরজলে সিনান করি সজল এলোচুলে/বসিয়াছিল উপল-উপকূলে/শীথিল পীতবাস/মাটির ’পরে কুটিলরেখা লুটিল চারি পাশ/নিরাবরণ বক্ষে তব, নিরাভরণ দেহে/চিকন সোনা-লিখন উষা আঁকিয়া দিল স্নেহে।’
আবার সংস্কারও বজায় রাখলেন বঙ্কিমি ঢঙে— অধিকারীকে দিয়ে বলালেন… ‘ব্রাহ্মণ কন্যা— বাল্যকালে দুরন্ত খ্রিস্টীয়ান তস্কর কর্তৃক’… ইত্যাদি ইত্যাদি সাথে আবার সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট ‘ইনি এখনো পর্যন্ত অনূঢ়া, ইহার চরিত্র পরম পবিত্র’। আসল ভাঁজটা এখানেই। নবকুমার যত খুশি বিয়ে করতে কিংবা পত্নীগমন করতে পারেন, নায়িকা বনে বাঁদাড়ে চরে বেড়ালেও ভার্জিন হতেই হবে! তবে সাহস করে ঝাপট দিয়েছেন, মনের কথা বলিয়েছেন প্রকাশ্যে। চন্দ্ররশ্মিবর্নশোভিনী নায়িকা বিয়ে থা করে ঘরে রীতিমতো আদরে আবদ্ধ হয়েও ননদকে জানায়, ‘সমুদ্র তীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে’। পরাবাস্তব নয় রীতিমতো পোড়াবাস্তব!
আরও পড়ুন-সংসদে নিট-বিতর্ক এড়াতে মরিয়া কেন্দ্র, প্রতিবাদে উত্তাল ঐক্যবদ্ধ ‘ইন্ডিয়া’
মৃণালিনী উপন্যাসের শুরু ‘প্রাবৃটকাল, কিন্তু আকাশে মেঘ নাই’ যেন বর্তমান দিনের আবহাওয়া ঘোষণা। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় নামক জাতীয় কলঙ্ক বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন না তাই মৃণালিনী উপন্যাসের আয়োজন। মৃণালিনীর সহচরী গিরিজায়া অপরূপ কণ্ঠের অধিকারিণী। বাংলার বৈষ্ণব পদাবলী, লোকগীতি তাঁর গলায় সরস্বতীর আশীর্বাদ হয়ে ঝরে। আর এক চরিত্র মনোরমা— ‘নবীন সূর্যোদয়ে সদ্য প্রফুল্লদলমালাময়ী নলিনীর প্রসন্ন ব্রীড়াতুল্য সুকুমার’। বঙ্কিম লেখনী যতই সংস্কৃত ভাষার দিকে বঙ্কিম হোক, একথা স্পষ্ট যে তাঁর কল্পিত নারীরা অপরূপা। প্রণয় অমূল্য। মনোরমা বলেন, ‘যে ভালো তাকে কে না ভালোবাসে? যে মন্দ তাকে যে আপনা ভুলিয়া ভালোবাসে…’। এই অমূল্য প্রণয়ের জোরে মৃণালিনীর সাথে হেমচন্দ্রের মিলন হয়, যবন নিধনের পর নতুন রাজ্য স্থাপনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন-নিট-কেলেঙ্কারিতে বিজেপি যোগ আরও স্পষ্ট, উঠে এল যোগীরাজ্যের বিধায়কের নাম
বঙ্কিমের ঈশ্বর বিরোধের সূক্ষ্ম অথচ স্পষ্ট কারণ নিশ্চয়ই সাংখ্যদর্শন। একজন রক্ষণশীল একজন প্রগতিশীল। যে কথা সর্বসমক্ষে বললে প্রগতির বিরোধিতা করা হয় সেটা বঙ্কিম বসালেন তাঁর লেখার চরিত্রের মুখে। ‘যে বিধবাদের বিয়ে দেয় সে যদি পণ্ডিত হয় তাহলে মূর্খ কে?’ এই নায়িকা ছাঁচে গড়া সমাজ প্রতিভূ। পতিপরায়ণা সুখী জমিদার গৃহিণী। এই প্রথম বঙ্কিম একজন সাধারণ নারী চরিত্র ফুটিয়ে তুললেন, বিষবৃক্ষের সূর্যমুখী। এই প্রথম বঙ্কিমকে আশ্রয় নিতে হল না কোনও কল্পনার। চরিত্রে আরোপ করতে হল না কোন দেবীত্ব কিংবা অতিমানবিক কিছু গুণাবলি। সূর্যমুখী রক্তমাংসে গড়া এক বাস্তব চরিত্র। সে তার ননদকে দুঃখ করে জিজ্ঞেস করে, ‘কমল, কোন দেশে মেয়ে হলে মেরে ফেলে?’ কমল উত্তর দেয়— ‘মেয়ে হলেই কি হয়? যার যেমন কপাল, তার তেমনি ঘটে।’ স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত দেখে জোর করে দ্বিতীয় বিয়ে দেয় এবং নিজে গৃহত্যাগ করে। দ্বিতীয় বিবাহ নায়ককে সুখী করে না, পরন্তু খুঁজে বেড়ায় তার পুরোনো স্ত্রীকেই। লেখক সমাজ বার্তা দেন বিধবা বিবাহ বিষবৃক্ষ রূপ, এটি বর্জন করলে গৃহে অমৃত ফলবে। কিন্তু লেখক এইখানে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন না— আসক্তি শুধু বিধবাতেই হয় না পরকীয়া মানুষের প্রকট বা প্রচ্ছন্ন নেশা। বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনী অসামান্য সুন্দরী কিন্তু বুদ্ধিহীনা। হীরা পদ্মপলাশলোচনা, বুদ্ধিমতী। সব চরিত্রই বাস্তব কিন্তু উপন্যাসের ভিত্তিটাই বড় সাজানো, সিনেম্যাটিক। গোটা উপন্যাসে একটি লাইন বাজিমাত করে হীরা চরিত্রের মুখে, ‘এখন তোমার মরণ নিকট শুনিয়া একবার আহ্লাদ করিয়া তোমায় দেখিতে আসিয়াছি, আশীর্বাদ করি, নরকেও যেন তোমার স্থান না হয়’।
আরেক ড্রামাটিক লেখা ইন্দিরা। ডাকাতে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং সৌভাগ্যক্রমে লোকের বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে অবশেষে স্বামীর সাথে মিলন। ইন্দিরা অতিসুন্দরী, সুভাষিণী সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। কিন্তু অলৌকিক বা অতিমানবিকতার ভারে ভারাক্রান্ত নয়।
কৃষ্ণকান্তের উইলে রোহিণী বিধবা। তার সাথে প্রেম করা যায়, পালিয়ে পরকীয়া করা যায়— সুস্থভাবে বিয়ে করে সংসার করা যায় না। এখানেই বঙ্কিম ভীষণ গতানুগতিক এবং সমাজ ভয়ে ভীত। ভ্রমর তার সতীত্বের গর্ব নিয়ে প্রাণত্যাগ করে কিন্তু মান নয়। ভ্রমরের মতো এতটা দৃঢ় নারী চরিত্র কম কিন্তু দুষ্প্রাপ্য নয়।
যুগলাঙ্গুরীয় উপন্যাসে হিরণময়ী সুন্দরী এবং নিজের ভালবাসায় বিশ্বাসী। ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখতে সে বিবাহকে অস্বীকার করতে পারে এতটাই সৎ।
রাধারাণী এক ইচ্ছেপূরণ গল্প। নামে উপন্যাস হলেও জাতে বড় গল্প। নায়িকা চরিত্রের বিশেষ কোনও গুণ আলাদা ভাবে চোখে পড়ে না।
আরও পড়ুন-ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, ফের বলল আমেরিকা
রাজসিংহ পুরুষ চরিত্র নির্ভর উপন্যাস। তারই মধ্যে নির্মল কুমারীর বুদ্ধিতে বাদশাহকে পরাস্ত করেন, এটাও কম প্রাপ্তি নয়। এর পরেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের কলমে অমোঘ অপমান লিখিত হবে ‘মেয়েদের বুদ্ধি কলম কাটা ছুরির মতো’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই অন্যদের চেয়ে আলাদা। অর্ধেক আকাশ নয়, সাহিত্যের প্রায় পুরো আঙিনাটাই ভরিয়েছেন অসামান্য নারী চরিত্রে।
এবার সেই অনবদ্য চরিত্র দেবীচৌধুরানী। বিধবা অনাথিনীর মেয়ে প্রফুল্ল। লোকের বাড়িতে নিত্যদিন চাল, বেগুন চেয়ে খেতে হয়। রূপের জোরে বড় ঘরে বিয়ে হলেও সমাজ নামক কদর্য লোকদের দ্বারা দেওয়া বদনামে শ্বশুরবাড়িতে তার ঠাঁই হয় না। বাড়িতে অভাবে অন্ন জোটে না তাই মায়ের সাথে একপ্রকার জোর করে শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখানে শ্বশুর তাকে গ্রহণ করে না। কালান্তরে গ্রামের সহজ সরল মেয়ে পরিণত হয় ডাকাতরানিতে। এ ডাকাতের অন্য জাত— নানা শিক্ষায় গড়ে ওঠা ডাকাত জানে ত্যাগে মেটে ভোগের নেশা। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন, অসহায়কে উদ্ধার এই ডাকাতের কাজ। ডাকাতি তার দেখনদারি— রানিগিরি তার দোকানদারি। মাটিতে শোয় গড়া পরে, স্বহস্তে শাকান্ন পাক করে। রানি সাজার আড়ালে চলে সন্ন্যাসব্রত। মেয়েদের যা যা কম থাকে প্রফুল্লর সেগুলো ছিল বেশি— প্রখর বুদ্ধি, অসীম বাহুবল। তাই সে বিতাড়িত বধূ থেকে ডাকাত দলের রানি। লেখক অবশ্য ধর্মের সিঁড়ির কোলাপসিবলের চাবি হাতে রেখেছিলেন কারণ, অতীতে কী করে দিন চলবে প্রশ্ন করাতে তার শ্বশুর চুরি, ডাকাতি, ভিক্ষা— যেকোনও কিছু করতে বলেছিল তাই সে ডাকাত হলেও তার ডাইরেক্ট পাপ লাগছে না। প্রফুল্ল সুন্দরী, বুদ্ধিমতী সর্বোপরি স্বয়ংসম্পূর্ণা। খাজনার টাকা জোগাড় করে দিয়ে মান বাঁচায় শ্বশুরের। প্রতিদানে পায় ব্রিটিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার মতো পুরস্কার। বুদ্ধিতে বাঁচে দেবী। দেবী চৌধুরাণী প্রফুল্ল হয়ে অতীত পথে হেঁটে ফিরে যায় শ্বশুরবাড়ি।
চমক এই উপন্যাসের প্রতি অধ্যায়ে। সাধারণ গরিব মেয়ে থেকে ডাকাতে উত্তরণ। প্রচলিত প্রথা— পড়ে মার খাওয়ার মুখে ঝামা ঘষে নিজেকে করেছে রানি। আবার স্বামীর ঘরে যাওয়ার জন্য রানিগিরি ছেড়ে নতুন বউ হওয়া।
ঋষি অরবিন্দর মতে বঙ্কিম উপন্যাসের দুটো ভাগ— সামাজিক আর ঐতিহাসিক। দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ আনন্দমঠ। আর একটি অনন্য চরিত্র শান্তি। শান্তি পড়াশোনা জানে, ঘোড়ায় চাপতে পারে, ধনুকে গুণ টানতে পারে অনেক পুরুষের চেয়ে বেশি জোরে, তর্কে হারাতে পারে আনন্দমঠ-এর প্রধান মহারাজকে। বঙ্কিম উপন্যাসের সেরা নারী চরিত্র শান্তি।
আরও পড়ুন-সংসদে নিট-বিতর্ক এড়াতে মরিয়া কেন্দ্র, প্রতিবাদে উত্তাল ঐক্যবদ্ধ ‘ইন্ডিয়া’
বঙ্কিম উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো কমবেশি সবাই বেশ হিরোইক, সাধারণ ঘরের চেনা মেয়েদের ছকে নয়। তবে অসুবিধা একটাই, পুরোপুরি রক্ষণশীলতার গণ্ডি ভাঙতে লেখকের সাহস হয়নি। কারণ ছক ভাঙা প্রতিটি চরিত্রের দিনের শেষে প্রাপ্তি স্বামী সংসার ইত্যাদির চেনা গণ্ডি। শত অপমান ভুলে ক্ষমা করে দেয় প্রিয়জনকে। সংসারের লোভেই হয়তো ডাকাতরানিও পুকুরঘাটে বাসন মাজে সানন্দে। লেখককে দোষ দিয়ে লাভ নেই, যুগ পাল্টালেও মেয়েরা কিন্তু এখনও আপস করে প্রতিনিয়ত শুধু সংসার নামে একটা বাঁধনের লোভে। রাগী পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে গম্ভীর অধ্যাপিকা, কিংবা নামজাদা ডাক্তার সবাই দিনের শেষে দেবী চৌধুরাণীর খোলস ছেড়ে প্রফুল্লতা ছাড়াও কখনও প্রফুল্ল হয় শুধুমাত্র সংসারটা টিকিয়ে রাখার লোভে। একসময় অসাধারণ আর সাধারণ মিশে যায় একই চাহিদার ফ্রেমে।