‘কর্তা নীলাম্বর বাঁড়ুয্যের বয়স যাই হোক রাতে ভাত খাওয়া ছেড়েছেন তিনি অনেক দিন। ঘরের গরুর খাঁটি দুধের সের খানেককে মেরে আছড় করে সর পরিয়ে রাখা হয়। আর তাতেই বাড়িতে ভাজা টাটকা খই পেলে গোটা আষ্টেক মনোহরা মেখে আহার সারেন নীলাম্বর।’
বড় কর্তামশাই-এর সরপড়া দুধ, মেজকর্তার বছরভরের অভ্যাস ক্ষীরের তক্তি আর নারকেল কোরা দিয়ে জামবাটিতে গুঁড়ো মিছরি আর মুড়ি, বাড়ির সেজকর্তার আবার রাতে পেতলের বড় থালায় গরম গরম খানকয়েক ফুলকো লুচি, সাদা আলুর তরকারি আর লাল চিনির পায়েস। বাড়ির ছোট ছেলের পছন্দের ছোট মাছ দিয়ে জুঁই ফুল সমান সাদা গরম ভাত। পরিবারের প্রত্যেকের এই সমস্ত কিছুর দায়িত্বে থাকেন কিন্তু অন্তঃপুরিকারা।
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলের সবুজদ্বীপে ইকো পার্ক নয়া রূপে
পরিবারের বড়বউদি অথবা বড়মা, রাঙাকাকি, কনেদিদা, সোনামা, মিষ্টিদিদারা। পরিবারের প্রত্যেকের কী পছন্দ এবং কী প্রয়োজন যা ছিল তাঁদের নখদর্পণে।
নানাজনের হরেক কিসিমের ফরমায়েসি খাবার তৈরি এবং পরিবেশনে অদ্ভুত তৃপ্তি পেতেন অন্দরমহলের নারীরা।
পরিবারের সদস্যরা যখন খুশি হুকুম চালালেও এতটুকু বিরক্ত বোধ ছিল না তাঁদের। বরং শ্রদ্ধা, ভক্তি, স্নেহ, আদর, আহ্লাদ আর প্রশ্রয়ের নরম চাদর মিশে থাকত দুটি হাতে। নিজেদের খাওয়া হচ্ছে কি না, নিজেদের যত্ন হচ্ছে কি না, শরীর ঠিক থাকছে কি না এসব দিকে এতটুকু হুঁশ থাকত না। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে এক অকৃত্রিম সুখানুভূতি, ভরপুর ভালবাসার টানে বাঁধা থাকত অন্দরমহলের দিনরাত। সাধারণ অথবা বিশিষ্ট পরিবার সবখানেই এক চিত্র দেখা যেত।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কথাই ধরা যাক না কেন, ঠাকুরবাড়ির ঠাকুর-চাকরের ছড়াছড়ি থাকলেও বাড়ির মেয়েরা কিন্তু হেঁশেলের ভার সামলাতেন।
মহর্ষির বড় মেয়ে সৌদামিনী, যিনি প্রথম বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, বাবার নির্দেশে দীর্ঘদিন হেঁশেলের ভার নিয়েছিলেন।
উচ্চবিত্ত সংসার হলেও লেখাপড়ার পাশাপাশি গার্হস্থ্য ধর্মের উপযুক্ত বিকাশের কারণেই মহর্ষির এ হেন সিদ্ধান্ত।
শরৎকুমারী, বর্ণকুমারী প্রত্যেক মেয়েকেই নাকি প্রতিদিন অন্তত একটি করে পদ রাঁধতে হত।
ডিম দিয়ে মুলিগাতানি স্যুপ তৈরি করে শরৎকুমারী সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন।
বহুদিন প্রবাসে কাটিয়ে ঘরে ফিরতেন দেবেন্দ্রনাথ প্রিয় মানুষ আর প্রিয় রান্নার টানে। শুধু বামুনের হাতে রান্না খেলে তিনিও খাবারের স্বাদ ভুলে যাবেন আর ঘরের বউ-মেয়েরাও রান্না ভুলে যাবে। তাই সারদাসুন্দরীকে হুকুম দিয়েছিলেন বউ-মেয়েদের রান্না শেখাতে। বাবামশাই বাড়ি থাকলে সারদা তাঁর গোলগাল চেহারা নিয়ে কষ্ট করেও রান্নাঘরে গিয়ে বসতেন তদারকির জন্য। দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশেই অন্দরে বউমহলে শুরু হল রান্নাবান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
সরকারি রসুই ঘরের ঢালাও ডাল-ঝোলের পাশাপাশি বউদের সযত্নে রাঁধা ব্যঞ্জনের স্বাদে আকাশ-পাতাল তফাত। ঠাকুরবাড়ির রান্নার বিশিষ্ট ঘরানা গড়ে উঠেছিল এইসব বিশেষ যত্নের রান্নাতেই।
কর্তামা বসে বসে নির্দেশ দেবেন আর বউরা, মেয়েরা রান্নার জন্য তরকারি গুছিয়ে দেবেন। গিন্নিদের হাতে আছে সবজি, ফলমূল, আমসত্ত্ব, নাড়ু, বড়ি, তিলকুটা সন্দেশের ভাঁড়ার।
বউদের সঙ্গে অবিবাহিতা কন্যারাও এই আসরের তৎপর সদস্যা।
সৌদামিনী, শরৎকুমারী, বর্ণকুমারীরা মায়ের তত্ত্বাবধানে কাজ শেখেন।
হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর পঞ্চাশতম জন্মদিনে তাঁকে ‘কবি সম্বর্ধনা বরফি’ রেঁধে খাইয়েছিলেন। বাংলা খাবারের মেনুচার্টও তাঁর হাত ধরেই। নাম দিয়েছিলেন ‘ক্রমণী’।
আরও পড়ুন-আসানসোলে নাইট সার্ভিস বাস চালু করতে উদ্যোগী পুরনিগম
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর হাতের রান্না ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
ঐতিহ্যশালী বনেদি পরিবার বাদ দিলেও রান্না নিয়ে অসম্ভব পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধ থেকে কোনও মুক্তি ছিল না মহিলাদের। সেই ‘খাওয়ার পর রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়া’ নিয়ে জীবনের চাকা ঘুরত। আসলে একটা সময় ছিল যখন বাঙালি নারীরা ছিলেন পরদানশিন। বাইরের জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ এক সুবিশাল পরিবার, আত্মীয়স্বজন লতায়পাতায় ঘেরা আশ্রিতমণ্ডলীর খাওয়া নিয়ে সদা চিন্তিত ও সদাব্যস্ত থাকতেন তাঁরা। গল্প-উপন্যাসেও এর বহু উদাহরণ আমরা দেখেছি।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও বাঙালি গিন্নির হেঁশেলের লম্বা বিবরণ রয়েছে। শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীতে। রাজলক্ষ্মীর অপরিসীম যত্ন মমত্ববোধ এবং খাবার পরিবেশনের আন্তরিকতা ও মুনশিয়ানা দীপ্ত করে পাঠক কুলকে।
ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য তাঁর প্রিয়তমা পত্নী ভানুমতির রান্নার অত্যন্ত গুণগ্রাহী ছিলেন। তবে রাজারাজরাজড়াদের ব্যাপারই আলাদা। সেখানে সাধারণ মানুষের নিয়ম খাটে না।
রাজাবীরচন্দ্র নাকি এক-একদিন রানিদের রান্নার গুণমান পরীক্ষা করবার অভিপ্রায়ে কোনও বিশেষ রানির মহলে উপস্থিত হতেন।
বলাই বাহুল্য, রানির সংখ্যা যেমন অগুন্তি তেমনি মহারাজের সামনে পরিবেশিত পদের সংখ্যারও হিসেব থাকত না। সাধারণত নাকি বত্রিশ ব্যঞ্জনের কমে মহারাজের সেবার কথা নাকি কল্পনাও করা যেত না। রানি মহারানি থেকে সাধারণ নারি, হেঁশেল সামলাতে হত সব্বাইকে।
তবে শুধু হেঁশেল সামলানোই নয়, রান্নার ব্যবস্থাপনা, পরিবেশন, হিসেবনিকেশ সবকিছুর সঙ্গে থাকত সংসারিক রাজনীতি, যার বিবরণ আমরা বিভিন্ন জায়গাতে পাই।
তবে এই যে অন্দরমহলে নারীরা রান্না করে খাইয়ে তৃপ্তি পেতেন, ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রান্নাঘর, হেঁশেল বা পাকশাল কিন্তু একেবারেই উৎকৃষ্ট ছিল না সে সময়ে। সেই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ধোঁয়ার ঝুলে কালিমাখা দেওয়াল, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই নির্দ্বিধায় বসে অনায়াস দক্ষতায় ফেলে দেওয়া কুচো শাকপাতা, সবজির ডাটা, খোসা, ছোটমাছ, বাসি ভাত জলে রেখে অপূর্ব সব স্বাদের রান্না তৈরি করতেন। ঝড়তি-পড়তি যে কোনও কিছুই না ফেলে কখনও রোদে শুকিয়ে নেড়েচেড়ে রক্ষা করতেন। গৃহিণীপনায় এতটাই চোস্ত ছিলেন তাঁরা।
পরিবেশনেও থাকত অদ্ভুত নিষ্ঠা। বাটিতে সাজিয়ে বাড়ির পুরুষদের আপ্যায়ন করে খেতে দেওয়া হত। সঙ্গে চলত পাখার বাতাস।
আরও পড়ুন-দিঘার জগন্নাথ মন্দির মুখ্যমন্ত্রীর প্রতীক্ষায়
চার ভাই যখন সারি দিয়ে খেতে বসেছে বড় বড় কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে সামনে মা বসেছেন পাখা হাতে করে। বউরা ধারেকাছে ঘুরছে নুনটুকু লেবুটুকু লাগবে কি না জানতে… আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় বাড়ির মেয়েদের সহস্তে পরিবেশনের এই চিত্র আমরা পড়েছি।
এটা ধরে নেওয়াই ছিল আবহমান কাল থেকে অন্দরমহল বা হেঁশেল সামলানোর কাজমাত্রই নারীর।
পুরুষতান্ত্রিকতায় এই ভাবনার বীজ রোপণ ছিল যে, রাঁধাবাড়া আর কী এমন কাজ!
দুটো ভাতসেদ্ধ বই তো কিছু নয়! জগতের সহজতম ও ওঁচাতম কাজের মধ্যে একটি। অথচ কার্যকালে বারংবার দেখা গিয়েছে এই কাজটাই জোয়ান মদ্দপুরুষদের হিমশিম খাইয়ে ছেড়েছে। কোনও সময় অতিসেদ্ধ হয়ে পিণ্ডিপাকানো অথবা অতি-সাবধানে চাল থেকে যাওয়া। সময়ে জলের মাপের ভুলে সুগন্ধীতে পাড়া আমোদিত হওয়া…
তবু নারীর স্বীকৃতি নেই।
মেয়ে মানুষ তুমি। বুদ্ধিশুদ্ধির বালাই নেই। ঘর গৃহস্থালির কাজের আবার মূল্য কী?
বেশ কিছুকাল পর্যন্ত সমাজপতি ও পুরুষদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মেয়ে মানুষ মানেই হেঁশেল সামলানো আর সন্তান মানুষ করার যন্ত্র বিশেষ। এর বাইরে কিছুটি নয়। সব সময় একটা প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা ঘিরে থাকে।
এ তো গেল সেকালের কথা, এবার দেখা যাক একালের কী চিত্র?
না, এ-যুগে আর সে-যুগের কোনও স্পষ্ট তফাত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আব্রুর কড়া শিকল শিথিল হয়ে এসেছে এখন অনেকটাই, তবে তা পারিপার্শ্বিক চাপে।
সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে অবলীলায় এগিয়ে গিয়েছে নারী। সমাজের বিভিন্ন ধরনের পেশা যা এতকাল কেবলমাত্র পুরুষদের একাধিপত্যে ছিল সেখানেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে নারী।
আজ কর্মক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণ। এখন মেধাসম্পদ দিয়ে দেশ ও দশের কাজে লাগছে নারী। সংসারের বাইরেও যে তার মূল্য আছে তা সে নিজেই বুঝেছে।
কিন্তু নারীর মস্তিষ্কের পরিচালনা তো নতুন কিছু নয়, ঘরের কাজেও এর যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল এবং আছে অতীতে এবং বর্তমানে এ-কথা বারবার দেখা গিয়েছে। এই ভুবনায়নের যুগেও নারীকেই কিন্তু সংসার সামলাবার যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। অদ্ভুত একটা প্রত্যাশা নারীকে ঘিরে। প্রযুক্তির নিত্যনতুন আবিষ্কারের সময়ে নারী আজ কর্মরতা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে পুরুষের সমান রোজগার করে।
কিছু দিনভর কর্মক্ষেত্রে সামলে হা-ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যখন ঘরে আসে তখন প্রত্যাশা থাকে চা বা জলখাবারটা নারীই তৈরি করে পুরুষের মুখে তুলে দেবে। রান্নাঘরের দায়িত্ব যেন তারই।
এক অলিখিত চুক্তি যেন!
আরও পড়ুন-বিধ্বংসী স্টার্ক, ফিরল গোলাপি আতঙ্কও
হাউজ হাজব্যান্ড আজও সংখ্যায় নগণ্য। পুরুষের সংসারের কাজে হাত লাগানোকে ‘মেয়েলিপনা’ বলে দেগে দেওয়া হয়। যেন সেই পুরুষ অন্য গ্রহের জীব!
বহমান সংস্কৃতির ভিত এতটাই গোঁড়া যে, এই উত্তর আধুনিক সময়ে আমরা শপিংমলে, পোশাকে, যোগাযোগে, প্রযুক্তিতে অত্যাধুনিক হলেও ভাবনা-চিন্তা নিরিখে সেই অতীতকালেই পড়ে রয়েছি।
একটি সন্তান পরিবারে বেশিরভাগ সময় জিজ্ঞাসা করে, মা আজকে কী রান্না হয়েছে? অথবা, মা আজ টিফিনে কী নেব? ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমরা কি কখনও শুনি যে একটি সন্তান বা পরিবারের অভিভাবকেরা একটি পুরুষকে জিজ্ঞাসা করছেন আজকে কী রান্না হয়েছে? লিঙ্গ বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গির বদল এতটুকু ঘটেনি। যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে।
পরিশেষে, একটাই কথা বলার যে এই আধুনিকতার ফানুস ওড়ানো সময়েও এই সমাজ-সংসারের সঙ্গে নারীদের নিয়ে অস্থিমজ্জায় মিশে যাওয়া বহমান সংস্কার আজও লালিত হয়ে চলেছে এটাই যা ভাবনার।