বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল কল্লোল গোষ্ঠীর হাত ধরে। এই গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা। কারণ, তখন মনে করা হত রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই। এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে কল্লোলের কবি-সাহিত্যিকরা খুঁজেছিলেন নতুন এক সাহিত্য, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বাঙালি সমাজের যন্ত্রণা আর হতাশাকে ফুটিয়ে তুলবে। এই ভাবনার পিছনে ছিল তৎকালীন পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবও। সেই তরুণ বিদ্রোহী সাহিত্যিকদের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখা ‘কয়লাকুঠি’ গল্পে বাঙালি পাঠক প্রথম জেনেছিল আসানসোল, রানিগঞ্জ অঞ্চলের কয়লাখনিতে কর্মরত কুলিকামিন, সাঁওতাল, বাউড়িদের নিয়তিতাড়িত মর্মান্তিক জীবনচিত্র। যাঁদের কথা বাংলা সাহিত্যের পাতায় আর কোনও সাহিত্যিক ঠাঁই করে দেননি এতকাল। নামহীন, অন্ত্যজ এই মানুষগুলিকে নিয়েও যে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করা যায়, তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। গল্প-উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলেন খ্যাতি। তবে কবিতা দিয়ে সূচনা হয়েছিল তাঁর সাহিত্য জীবনের।
আরও পড়ুন-১৭ লাখি হীরে আর একজন ‘ফকিরে’র কিস্সা
শৈলজানন্দের জন্ম ১৯০১ সালের ১৮ মার্চ। মতান্তরে ২১ মার্চ। বীরভূমের রূপসীপুরে। বাবার নাম ধরণীধর মুখোপাধ্যায়। মায়ের নাম হেমবরণী দেবী। তিন বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বর্ধমানের মামাবাড়িতে বড় হয়ে ওঠেন। তাঁর মাতামহ মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত কয়লা ব্যবসায়ী। শৈলজানন্দের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বোলপুর হাই স্কুলে। তারপর ভর্তি হন উখরা এন্ট্রান্স স্কুলে। চোদ্দো বছর বয়সে তাঁর মাতামহ তাঁকে রানিগঞ্জ হাই স্কুলে নিয়ে যান। বছরখানেক সেখানে পড়াশোনার পর দেশের বাড়ি রূপসীপুরে ফিরে আসেন। সেখানে নাকড়াকোঁদা হাই স্কুলে ভর্তি হন। অন্ডালে মাতামহের বাড়ির শখের ফুলের বাগানের পাশে একটি মাটির ঘর ছিল। তার নাম ছিল ‘মোহামেডান বোর্ডিং’। কবি কাজী নজরুল ইসলাম থাকতেন সেই বোর্ডিং হাউসে। সেই সূত্রে নজরুলের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব রচিত হয়েছিল।
১৯১৬ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং শৈলজানন্দ দু’জনেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই সময় ইউরোপ জুড়ে চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নজরুল ইসলাম এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় গোপনে বাঙালি পল্টনে যোগদানের জন্য নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় শৈলজানন্দ বাদ পড়েন। নজরুল ইসলাম এই ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। এরপর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে শৈলজানন্দ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। সেই অবস্থাতে পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। এরপর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পাশ করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কলেজের পড়া শেষ করেননি। শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শেখেন। মাতামহের কয়লাকুঠিতে কিছুদিন কাজ করেন।
আরও পড়ুন-উড়ে যাই দূরে যাই
১৯২১ সালে ১২ বছর বয়সী লীলাবতীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বরযাত্রী হয়েছিলেন নজরুল ও শৈলেন ঘোষ। শ্বশুরের সাহায্যে কয়লার ডিপো খুলে জোড়জোনাকি কয়লাখনি অঞ্চলে যাতায়াত শুরু করেন শৈলজানন্দ। কয়লাখনিতে কুলিমজুর সরবরাহের কাজও করতেন। কুলিমজুরের খোঁজে সাঁওতাল পরগনার বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হত। ফলে কয়লাখনির শোষিত শ্রমিক-মজুরদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। কয়লাখনির শ্রমিকদের জীবনযাপন অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গল্প ‘কয়লাকুঠি’। গল্পটি মাসিক বসুমতী পত্রিকার ‘কার্তিক ১৩২৯’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মূলত এই গল্পের মাধ্যমে গল্পকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি সস্ত্রীক কলকাতার ১১৫ আমহার্স্ট স্ট্রিটে শ্বশুরমশায়ের বাড়িতে চলে আসেন। পটুয়াটোলা লেনে তখন চলছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ। সেই সময় একদিন শৈলজানন্দ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় একটি গল্প জমা দিতে বেরিয়েছেন। পথে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি শৈলজাননন্দকে নিয়ে যান ‘কল্লোল’-এর অফিসে যান। সেখানে গোকুল নাগ ও দীনেশ দাসের সঙ্গে আলাপ হয়। এঁরা ‘কল্লোল’-এর প্রথম সংখ্যার জন্য শৈলজানন্দকে একটি গল্প দিতে অনুরোধ করেন। শৈলজানন্দ ‘প্রবাসী’র জন্য আনা গল্পটা তাঁদের দেন। গল্পটির নাম ছিল ‘মা’। এর সূত্রে পরে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও মণীন্দ্রলাল বসুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছিলেন শৈলজানন্দ। জীবনের শেষদিকে আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। উপার্জন করলেও, সঞ্চয়ের নেশাও ততটা তাঁর ছিল না। ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন। আজও তিনি চর্চিত, পঠিত।