সন্ধে সাড়ে পাঁচটা। বাগবাজার ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে জ্বলে উঠছে আলো। শোনা যাচ্ছে থিম সং। জমজমাট কনসার্ট। চোখা চোখা সংলাপ। চলছে ২৯তম যাত্রা উৎসব। আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি। ৩৫ দিনের যাত্রা উৎসবের সূচনা হয়েছে ৩১ জানুয়ারি, বারাসতের কাছারি ময়দানে। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সভাপতি অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সহ-সভাপতি ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ। ওই মঞ্চে যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দিন। ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
২ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে সূচনা হয়েছে কলকাতা পর্বের যাত্রা উৎসবের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। এছাড়াও ছিলেন কৌস্তুভ তরফদার, বাসুদেব ঘোষ, তপন তরফদার, সুমিতা দে, প্রদীপকুমার সরকার প্রমুখ তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আধিকারিকরা। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, তিনদিন মঞ্চস্থ হয়েছে তিনটি যাত্রাপালা। পাশাপাশি ২-৪ ফেব্রুয়ারি একতারা মুক্তমঞ্চে আয়োজিত হয়েছে আলোচনাসভা। পরিবেশিত হয়েছে যাত্রার গান এবং যাত্রাপালার নির্বাচিত অংশ। আয়োজিত হয়েছে প্রদর্শনী।
আরও পড়ুন-আজ মালদহে সাংগঠনিক সভা
৫ ফেব্রুয়ারি থেকে, বাগবাজার ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে চলছে যাত্রা উৎসব। শেষ হবে ৬ মার্চ। প্রতিদিন মঞ্চস্থ হচ্ছে একটি করে পালা। তার আগে স্মারক প্রদানের মধ্যে দিয়ে সংবর্ধিত করা হচ্ছে পালার কলাকুশলীদের। উপস্থিত থাকছেন অতিথিরা। তাঁরাই যাত্রা দলের প্রত্যেকের হাতে তুলে দিচ্ছেন উৎসব-স্মারক। বিভিন্ন দিন অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, রবীন্দ্র-গবেষক ড. নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেতা উৎপল চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী রুমা দাশগুপ্ত, অভিনেত্রী অনামিকা সাহা, অভিনেতা অনল চক্রবর্তী, অভিনেত্রী কাকলি চৌধুরী, অভিনেত্রী জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী চম্পা হালদার, পরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা তপন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রযোজক কনক ভট্টাচার্য, প্রযোজক গৌতম নন্দী, প্রযোজক রূপকুমার ঘোষ, প্রযোজক উত্তম নট্ট, পালাকার নীলকমল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এছাড়াও থাকছেন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সচিব লিপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
উৎসব প্রাঙ্গণে হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন যাত্রার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তাঁদের সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছেন যাত্রাপ্রেমীরা। অনেকেই প্রিয় তারকার সঙ্গে তুলছেন সেলফি। দেখে বোঝা যাচ্ছে, নতুন জোয়ার এসেছে এই শিল্পে। অথচ বাংলার জনপ্রিয় লোকনাট্যের ধারাটি একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বিশেষত ২০১১ সালের আগে। যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বহু মানুষ। তাঁরা পড়েছিলেন মহা সমস্যায়। কমে গিয়েছিল শো, দলের সংখ্যা। পরিস্থিতি দেখে এই শিল্পমাধ্যমের পাশে দাঁড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস নবজাগরণ ঘটান এই শিল্পের। তিনি যাত্রা উৎসবে নতুন প্রাণসঞ্চার করেন। শিল্পীদের জন্য চালু হয় শান্তিগোপাল তপনকুমার পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রতি বছর যাত্রা উৎসবে প্রদান করা হয়। সেইসঙ্গে দুঃস্থ শিল্পীদেরও সহযোগিতা করা হয় নানাভাবে। আয়োজন করা হয় কর্মশালা। তুলে আনা হয় নতুন শিল্পীদের। কর্মশালা থেকে উঠে আসা একঝাঁক শিল্পী অভিনয় করছেন এবারের উৎসবে। বর্তমানে বেড়েছে শো এবং যাত্রার দলের সংখ্যা। ফলে হাসি ফুটেছে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের মুখে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে স্বনির্ভর বাংলা, রেকর্ড উৎপাদন, রাজ্যে প্রথম পেঁয়াজ সংরক্ষণ
বারাসত কাছারি ময়দান, রবীন্দ্রসদনের মতোই প্রতিদিন হাউসফুল হচ্ছে ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চ। অথচ একটা সময় মনে করা হত, যাত্রার দর্শক ছড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র গ্রামবাংলায়।
এবারের উৎসবে কয়েকটি পালা রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছে। বারাসত কাছারি ময়দানে পরিবেশিত বিশাল অপেরার ‘থানায় যাচ্ছে সোনালি’ দেখেছেন বহু মানুষ। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে তিনটি পালা মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রসদনে। স্বর্ণদীপ অপেরার ‘আমি সিংহ বাড়ির রাঙা বউ’, নন্দী কোম্পানির ‘আমার জীবন প্রতিশোধের বিজ্ঞাপন’ এবং আনন্দবীণা অপেরার ‘বোম্বাইকা বিবি’। তিনটি পালাই পেয়েছে দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা। ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে প্রতিদিন মঞ্চস্থ হচ্ছে সুপারহিট যাত্রাপালা। টিকিট কেটে প্রেক্ষাগৃহ ভরাচ্ছেন শহুরে দর্শকরা। দেবাঞ্জলি অপেরার ‘আমি ইস্কাবনের বিবি’, দেবীবন্দনা যাত্রা সংস্থার ‘আমি সোনার টুকরো ছেলে’, রূপমঞ্জরী অপেরার ‘আমি কলঙ্কিনী নই’, রাজেশ্বরী অপেরার ‘রূপে হরিণী গুণে বাঘিনী’, আনন্দলোক অপেরার ‘আমি বাংলার ভক্ত’, উমা অপেরার ‘সে মেয়ে নয় মাতঙ্গিনী’, দেবলোক অপেরার ‘আমি ছদ্মবেশী নায়ক’, অঞ্জলি অপেরার ‘রিফিউজি নম্বর ওয়ান’, শ্রীচৈতন্য অপেরার ‘শ্যামলা গাঁয়ের পাগলি মেয়ে’, ভৈরব অপেরার ‘ঘরের লক্ষ্মী পরের বউ’ পেয়েছে দর্শকদের অকুণ্ঠ ভালবাসা। প্রায় প্রতিটি পালায় দেখা যাচ্ছে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। কিছু পালায় উঠে আসছে সমাজের কথা, নানা সমস্যার কথা। নাচ, গান, হাস্যরস পরিবেশনের মাধ্যমে শিল্পীরা উপহার দিচ্ছেন ভরপুর বিনোদন। কারও কারও অভিনয় সাবেক, কারও আধুনিক। গড়ে দিচ্ছে পার্থক্য। ১-৬ মার্চ পর্যন্ত পালাগুলো নিয়েও রয়েছে যাত্রাপ্রেমীদের তুমুল আগ্রহ, উন্মাদনা।
ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চের পাশে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনী। ঘুরে দেখছেন বহু মানুষ। তুলে ধরা হয়েছে বাংলার ৫০০ বছরের যাত্রার ইতিহাস। টিকিট কাউন্টারের সামনেই রয়েছে একটি স্টল। বিক্রি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি প্রকাশিত বই, পত্রিকা। বাংলার জীবন যাত্রা। কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অভিনয় দেখা, আলাপ পরিচয়, আড্ডা, গরম চায়ে চুমুক— সবমিলিয়ে জমে উঠেছে এবারের যাত্রা উৎসব। যাত্রা শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের কাছে এই উৎসব যে দুর্গাপুজোর মতো। তাঁরা এই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকেন সারা বছর।