সত্যি কথাটা স্বীকার না করে আজ আর কোনও উপায় নেই।
হে লোডশেডিং অধিকারী! মার্জনা করবেন, আপনারা ঠিকই বলেন।
হে দুধেসোনা ঘোষ! ক্ষমা করবেন, আপনার বক্তব্য ১০০ শতাংশ ঠিক।
হে স্বজনপোষণ চকোত্তি! অস্বীকার করছি না, আপনার ভাষ্যে কোনও ভুল নেই।
বাংলা, মা মাটি মানুষের সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গ, পিছিয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই বলেন। এগিয়ে বাংলা নয়, পিছিয়ে বাংলা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
দুর্নীতিতে পিছিয়ে বাংলা।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭-’১৮ থেকে ২০২০-’২১ পর্যন্ত আর্থিক বছরে অর্থাৎ চার বছরে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে গোটা দেশে ৯৩৫ কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে তামিলনাড়ুতে, টাকার পরিমাণ ২৪৫ কোটি। অন্ধ্রপ্রদেশে সেই সংখ্যাটা ২৩৯ কোটি, আর ঝাড়খণ্ড ও বিহারে যথাক্রমে ৫১.২৯ কোটি ও ১২.৩৪ কোটি টাকা। যে সময়কালের দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে, তখন বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের সরকার ছিল বিজেপির। আর পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কত টাকার? প্রায় ৮ কোটি ২৮ লক্ষ। এর মধ্যে ২ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যেই উদ্ধার হয়ে গিয়েছে।
সত্যি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির নিরিখে পিছিয়ে বাংলা। আর সেজন্যই বুঝি ১০০ দিনের কাজের পাওনা টাকা নিয়ে মোদি সরকারের এত টালবাহানা।
আরও পড়ুন-নির্লজ্জ! বিজেপি পার্টি অফিসে আইএসএফ বৈঠক
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে তদন্ত করার সময় কিছু দুর্নীতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তা সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছিল। রাজ্য সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিং তার সত্যতা স্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। বঙ্গ বিজেপির নেতারা দিল্লিতে গিয়ে বাংলার মানুষের টাকা আদায়ের জন্য লড়াই করা তো দূরের কথা, উল্টে বুক ফুলিয়ে বলছেন, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বেশ করছে। শ্যামবাজারের যাত্রা মঞ্চ, থুড়ি ‘ধর্না মঞ্চ’ থেকেও, এই সেদিনকেও, যাত্রাপালার অধিকারী মশাই থেকে শুরু করে বালুরঘাটের নিশিকান্ত পেয়াদা, সবার হুক্কা হুয়াতেও এই রব শোনা গিয়েছে। কিন্তু সত্যিটা বুঝতে আজ বাংলার আপামর জনতার আর কিছু বাকি নেই। গোপন কথাটা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ১০০ দিনের কাজ হোক বা আবাস যোজনা, বাংলার টাকা আটকে দেওয়ার পিছনে সেই একটা কারণই ঘুরে ফিরে আসছে, একুশে হারের জ্বালা। বাংলার মানুষের প্রত্যাখ্যানের জ্বালা দিল্লির বিজেপি নেতারা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। মোদি- শাহ অ্যান্ড কোম্পানি কায়দা অধিকারীর মতো অনেক জার্সি বদলুদের নিয়ে, অনেক আশায় বুক বেঁধে, বাংলা দখলের জন্য ‘অলআউট’ লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু জননেত্রীর কাছে এমন গোহারা হারতে হবে, সেটা কল্পনাও করতে পারেননি। পরাজয়ের সেই জ্বালা জুড়ানোর জন্যই বাংলার গরিব মানুষকে ভাতে মারার এমন মরিয়া চেষ্টা।
আরও পড়ুন-কড়া প্রশাসন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, হাওড়াকাণ্ডে তদন্ত শুরু সিআইডির
গ্রামের খেটেখাওয়া গরিব মানুষজন এখন বুঝে গিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারই তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমের মজুরি আটকে রেখেছে। তার জন্য কলকাঠি নেড়েছে কারা, সেটাও তাঁদের কাছে স্পষ্ট। তবে, সেটা বোঝানোর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এ-রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বের। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে নেতাদের দহরম মহরম প্রমাণের জন্য আগে থেকেই ১০০ দিনের ও আবাস যোজনার টাকা আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁদের পাঠানো অভিযোগের ফাইল নিয়েই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী অফিসাররা ঘুরেছেন গ্রামে গ্রামে। ফলে সবাই বুঝে গিয়েছেন, তাঁদের মজুরি আটকে দেওয়ার নাটের গুরু কারা। ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে দেওয়ায় দলমত নির্বিশেষে গ্রামের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। কারণ তাঁরা শ্রম দিয়েছেন, কিন্তু পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। তাই সুযোগ পেলেই বিজেপি নেতাদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সেই বিক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছেন দিল্লি থেকে তদন্ত করতে আসা অফিসাররাও। বারবার তদন্ত করেও কেন্দ্রীয় সরকার ‘পুকুরচুরি’ হয়েছে, এমন দাবি করতে পারেনি।
আরও পড়ুন-জীবন-সাধক যোগেশচন্দ্র
এমতাবস্থায় খানিকটা অনন্যোপায় হয়েই গেরুয়া খোকারা একটা নোংরা খেলায় মেতেছে। পঞ্চায়েত ভোট আটকানোর জন্য বঙ্গ-বিজেপির ছটফটানি বেড়েই চলেছে। আসলে ১০০ দিনের কাজ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে শায়েস্তা করতে গিয়ে রাজ্যের প্রাপ্য হাজার হাজার কোটি টাকা আটকে রাখার ফল হচ্ছে উল্টো। দিল্লির নেতাদের উসকানি দেওয়ার সময় হাওয়ায় ফুলেফেঁপে ওঠা বঙ্গ-বিজেপি বুঝতে পারেনি, এই প্রকল্পই গরিব মানুষের ‘লাইফ লাইন’। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসতে তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, ভোটে মারতে না পেরে ভাতে মারতে গিয়ে নিজেদের ভোট খোয়ানোর রাস্তাটা তারা একেবারে পরিষ্কার করে ফেলেছে। এহেন বিলম্বিত বোধোদয়ের ফল-পরিণামে গেরুয়া খোকারা নানাভাবে ১০০ দিনের কাজকে গুরুত্বহীন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। লোডশেডিং অধিকারীর ব্যঙ্গোক্তি, বিশ্ব বাংলা নয়, নিঃস্ব বাংলা। বঙ্গ-বিজেপির রাজ্য সভাপতির বচন, ‘এ-রাজ্যের সরকার মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাই এখানে ২১৩ টাকা মজুরির ১০০ দিনের কাজের এত চাহিদা। গুজরাতের মানুষ দৈনিক হাজার টাকা মজুরিতে অন্য কাজ করে। তাই সেখানে ১০০ দিনের কাজ নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা নেই।’ কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান তো বলছে অন্য কথা। গুজরাতে সক্রিয় জবকার্ডধারীর সংখ্যা ৩২ লক্ষেরও বেশি।
আরও পড়ুন-বোকা বানিয়ে মজার দিন, মুসলিম গণহত্যার দাস্তান
খোকা অধিকারী কিংবা ধোঁকা মজুমদার, এর পর কী বলবেন? এরকম পরিস্থিতিতে একটা কথা স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া যাক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও প্রকল্প চালু করলেই বিরোধীরা তার পিছনে অভিসন্ধি খুঁজে পান। সমালোচনাও করেন। আবার রাজ্যে রাজ্যে বাঁচার জন্য সেই কর্মসূচিকে আঁকড়ে ধরেন। কেবল নামটা বদলে দেন। কোনও দলের কর্মসূচি বা সরকারি প্রকল্প ভাল হলে তাকে অনুসরণ করা অন্যায় নয়। বরং সাধারণ মানুষের জন্যে তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু সমালোচনা করার পর তাকেই আঁকড়ে ধরলে বুঝতে হবে, সেটা দৈন্যের লক্ষণ।
আরও পড়ুন-রবিবার থেকে থামছে বৃষ্টি বাড়বে তীব্র গরমের প্রকোপ
সেই দৈন্যই প্রকট বঙ্গ-বিজেপির রঙ্গলীলায়। এর পাশাপাশি হাত-হাতুড়ির অবুঝপনাও কম নয়। ইতিহাস সাক্ষী, চিরদিনই সংকটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উপস্থিতি আরও বড় ক্যানভাসে ধরা পড়ে। কঠিন চ্যালেঞ্জ তাঁকে আরও ধারালো করে। নব্বইয়ের দশকে বঙ্গের একপেশে অচলায়তন রাজনীতির অঙ্গনে তিনি সহসা একটা খোলা হাওয়া হয়েই সামনে এসেছিলেন। আর আজ নিজের ক্ষমতায় তিনি ডান-বাম, জগাই-মাধাই-গদাই সবার টার্গেট। কিন্তু অগ্নিকন্যাকে কোণঠাসা করাই কি এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির অগ্রাধিকার? এ-রাজ্যে লালু পার্টি ও মিরজাফরের জোট বিপন্ন হয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতেও পিছপা হচ্ছে না। এটা মোটেই জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে আদর্শের প্রশ্নে খুব ভাল বিজ্ঞাপন নয়। সবাই জানে ও মানে, সত্যি বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইলে জননেত্রীর মতো সংগ্রামী প্রতিস্পর্ধী অগ্রনায়িকার প্রয়োজন সর্বাগ্রে।
জগাই-মাধাইরা এই সহজ সত্যিটা কবে যে বুঝবে!