জম্বি! নামটা শুনলেই এতদিন দেখে আসা সব জম্বিমুভিগুলি কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওয়াকিং ডেড! ট্রেন টু বুসান ইত্যাদি। আর তার সঙ্গেই একটা চাপা ভয় আমাদের মনে চেপে বসে যে আদৌ যদি এসব সত্যি হয় তাহলে… যদিও সত্যি বলতে এমন কিছুর সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি, যেটা মানুষকে জম্বি বানিয়ে ফেলতে পারে। তবে মানুষ এসবের থেকে রক্ষা পেলেও পিঁপড়েরা এর থেকে রক্ষা পায়নি। থাইল্যান্ডের বৃষ্টি অরণ্যে এমন একধরনের ছত্রাকের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা জীবন ধারণের জন্য অন্য প্রাণীকে আক্রমণ করে খুন করে এবং সেই মৃতদেহে নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করে। আর খুন করার আগে এরা পোষককে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নেয়।
আরও পড়ুন-জেসিনের গোলে ইস্টবেঙ্গল জয়ী
কে এই জম্বি ফাঙ্গাস
নাম Ophiocordyceps unilateralis পরিচয়ে এটি একটি ফাঙ্গাস ‘জম্বি ফাঙ্গাস’। থাইল্যান্ড ও ব্রাজিলে এদের বাস। ইউরোপ ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই কমবেশি এদের দেখা পাওয়া যায়।
১৮৫৯ সালে জীববিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস এদের পর্যবেক্ষণ করেন। তবে এক গবেষণায় জার্মানির মেসেল পিট নামের ৪৭ মিলিয়ন বছর পুরনো এক ফসিলে এদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসলে, জম্বি ফাঙ্গাসের বসবাসের জন্য প্রয়োজন হয় গভীর বনের। আর আবিষ্কৃত ফসিলটি যে সময়কালের, সে-সময় জার্মানি-সহ পুরো ইউরোপ মহাদেশের সবটুকু জুড়েই ছিল সবুজের প্রাধান্য।
এই জম্বি ছত্রাক সবাই শত্রু নয়! শুধু কার্পেন্টার পিঁপড়েই শত্রু। ছত্রাকটি জানে, একমাত্র এই প্রজাতিকেই আক্রমণ করলে তারা সবচেয়ে ভালভাবে জীবন অতিবাহিত পারবে, তাই এরা পরিকল্পিতভাবেই এদেরকেই আক্রমণ করে।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল, সিনেমায় যেমন দেখা যায়, একটি এলাকায় যদি জম্বি আক্রমণ ঘটে তাহলে সেই পুরো এলাকাটিই জম্বিদের দখলে চলে যায়, বাস্তবে জম্বি ফাঙ্গাসও ঠিক এই কাজটিই করে। পিঁপড়েরা সাধারণত মিলেমিশে কলোনিতে বসবাস করে। জম্বি ফাঙ্গাস যদি কোনও কলোনির একটি পিঁপড়েকেও জম্বি বানিয়ে নিতে পারে, তবে ওই পিঁপড়ের মাধ্যমেই এরা পুরো কলোনি দখল করে নিতে পারে।
ছত্রাকের জীবনচক্র পিঁপড়ের মৃত্যুচক্র
ছত্রাকের বংশবৃদ্ধি মূলত স্পোর-এর মাধ্যমেই হয়। পূর্ণবয়স্ক কোনও জম্বি ছত্রাক মাটিতে স্পোর ফেলে রেখে যায়। পিঁপড়েরা যখন বনের মধ্যে দিয়ে চলাচল করে অজান্তেই এরা সেই ছত্রাকের স্পোর তুলে নেয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই পিঁপড়েটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়— মৃত্যু!
আগে ধারণা করা হত এই ছত্রাক পোষকের মস্তিষ্কের দখল নেয় এবং তাকে দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, জম্বি ফাঙ্গাসে আক্রান্ত পিঁপড়ের মস্তিষ্ক কোনওরকমভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বরং জম্বি ফাঙ্গাস পিঁপড়ের দেহের প্রায় সব কোষ এবং পেশি দখল করে নেয়। এ সময় এরা পিঁপড়ের দেহে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ ছেড়ে দেয়। এই রাসায়নিক পদার্থ পিঁপড়ের হিমোসিলের মাধ্যমে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়লে পিঁপড়ের নিজের দেহের ওপর আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গবেষক ডেভিড হিউ এই ব্যাপারটা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এরা একেবারে পরিকল্পিতভাবে প্রথমে পিঁপড়েটাকে অকেজো করে নেয় তারপর পেশি যন্ত্রগুলো দখল করে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ঠিক পুতুল নাচের মতোই এ-সময় এরা সুতো ধরে পিঁপড়েগুলোকে ইচ্ছেমতো নাচাতে পারে।
জম্বি ফাঙ্গাস পিঁপড়েকে চালিয়ে অনুকূল পরিবেশে নিয়ে আসার পর কোনও গাছের পাতার তলার পৃষ্ঠে ম্যান্ডিবল (দাঁত) দিয়ে কামড়ে ধরতে বাধ্য করে। কামড়ে ধরার পরে এরা পিঁপড়ের সব পেশি অকেজো করে দেয়। একে বলা হয় ডেথ গ্রিপ।
আরও পড়ুন-‘স্কুল শিক্ষক ও সহপাঠীরা দায়ী’, আত্মহত্যার আগে সুইসাইড নোটে লিখল নাবালক
ছত্রাকের বেড়ে ওঠা
ডেথ গ্রিপের পর পিঁপড়ে মারা যায়। এ পর্যায়ে এসে জম্বি ফাঙ্গাস পিঁপড়ের পুরো দেহটিই দখল করে নেয় এবং পরিবেশের প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে এরা পিঁপড়ের দেহের বাইরের কাঠামোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এর ফলে ছত্রাকটি পোষক দেহে প্রয়োজনমতো বেড়ে উঠতে পারে। কোনও নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, পিঁপড়ের খোলসের ভেতরে পিঁপড়ের নিজস্ব কিছু থাকে না। ছত্রাক আক্ষরিক অর্থেই এর ভেতরের প্রায় সবটাই দখল করে নেয়। সাধারণত চার থেকে দশ দিনের ভেতর যথেষ্ট বেড়ে উঠে ছত্রাক। এরপর পিঁপড়ের মাথা ছেদ করে ছত্রাকের দেহ (ফ্রুট বডি) বাইরে বেরিয়ে আসে।
স্পোর সৃষ্টি
পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠা ছত্রাক অনেক স্পোর সৃষ্টি করে। সেগুলি তারা গাছের পাতা থেকে মাটিতে ছড়িয়ে দেয়। পুনরায় কোনও পিঁপড়ে তার অজান্তেই মাটি থেকে স্পোর তুলে নিলে আবার শুরু হয় তাদের এই মৃত্যুচক্র।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এমন একধরনের ছত্রাক আছে যারা এই জম্বি ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং এদের বেড়ে ওঠা দমন করে। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যান্টি -জম্বি-ফাঙ্গাস’। এই ‘অ্যান্টি -জম্বি-ফাঙ্গাস যদি জম্বি ফাঙ্গাসকে আক্রমণ করে তবে মাত্র ৬.৫ শতাংশ জম্বি ছত্রাক এদের আক্রমণ থেকে বেঁচে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে। এই কারণেই আসলে কার্পেন্টার প্রজাতির পিঁপড়েরা এখনও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি।
এ ছাড়াও এতদিন ধরে আক্রমণের শিকার পিঁপড়েরা ধীরে ধীরে ছত্রাকে আক্রান্ত সদস্যকে শনাক্ত করতে শিখে গেছে। এমনিতে পিঁপড়েরা সামাজিক প্রাণী বলে বেশ পরিচিত হলেও আত্মরক্ষার জন্য কলোনির কোনও সদস্য আক্রান্ত হলে অন্যান্য সুস্থ সদস্যরা তাকে কলোনি থেকে অনেক দূরে কোথাও রেখে আসে। তাতে রক্ষা পায় পুরো কলোনি।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, জম্বি ফাঙ্গাস ঠিক কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে পোষকদেহকে পুরোপুরি দখল করে নেয় তা এখনও জানা যায়নি। তবে গবেষক ডেভিড হিউ এ-নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। পৃথিবীতে বেশিরভাগ প্রাণী খাদ্য গ্রহণের জন্য অন্য প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু খুব বেশি প্রাণী অন্য প্রাণীদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে না। এই ছত্রাকের এমন কী গুণ আছে? কী রহস্য আছে এর পেছনে? উত্তর জানতে আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।