ক’দিন আগেই চলে গেল তাঁর ১৫১তম জন্মবার্ষিকী। গেরুয়া শিবির তা নিয়ে কোনও উৎসাহ-আগ্রহ দেখায়নি। দেখাবেই বা কেন? নেতাজি সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক গুরু যে বিদ্বেষবিষ ছড়ানোর রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। বিভেদপন্থার পাপ থেকে মুক্ত বাংলা গড়ার স্বপ্ন তাঁকে উদ্বেলিত করত। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ বেঙ্গল প্যাক্ট। স্বপ্ন সার্থক হওয়ার পথে ছিল অযুত প্রতিবন্ধকতা। তবু আজও তা প্রাসঙ্গিক। আলোচনায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুমিত মুখোপাধ্যায়
আরও পড়ুন-গোলাপ দিয়ে স্বাগত
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের একনিষ্ঠ সমর্থক ও উপাসক। তাঁর শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ মান্দালয় কারাগৃহ থেকে হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে লিখেছিলেন ‘‘ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এতবড় বন্ধু আর কেউ ছিলেন বলিয়া আমার মনে হয় না।
চুক্তিপত্রের দ্বারা বিবাদভঞ্জন হইলেও তিনি বিশ্বাস করিতেন না যে শুধু তাহারই দ্বারা হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতি ও ভালবাসা জাগরিত হইবে। তাই তিনি শিক্ষার দিক দিয়া হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে মৈত্রী সংস্থাপনের চেষ্টা করিতেন।” শিক্ষা বলতে এখানে দেশবন্ধু সংস্কৃতি বা culture-এর কথাই বলতে চেয়েছেন। সুভাষচন্দ্রের সাক্ষ্য অনুযায়ী কারাগারে মৌলানা আক্রম খাঁর সঙ্গে দেশবন্ধুর প্রায়ই আলোচনা হত এবং তার ফলশ্রুতি মৌলানা সাহেব হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষার মিলন বিষয়ে পুস্তক বা প্রবন্ধ রচনা করতে রাজি হন।
আরও পড়ুন-ফের রাজ্যবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছবে রেশন
সাংস্কৃতিক স্তরে সেতুবন্ধনের কথা বললেও রাজনৈতিক স্তরে দেশবন্ধু চুক্তির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিরোধ নিরসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি বেঙ্গল প্যাক্টের প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সিরাজগঞ্জ কংগ্রেসে তা গৃহীত হয়। সুভাষচন্দ্র বলেছেন যে দেশবন্ধু গোপনে নয়, প্রকাশ্যেও বারবার স্পষ্ট করে বলেছেন যে তাঁর উদ্দেশ্য দেশের দুই সম্প্রদায়ের মিলনের একটি স্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন করা। এই প্যাক্ট অনুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে যথাক্রমে শতকরা ৫২ ও ৪৮ ভাগ বণ্টনের কথা বলা হয়েছিল।
আরও পড়ুন-টস বিতর্কে আইসিসির হস্তক্ষেপ চান সানি
সাম্প্রদায়িকতা যে প্রধানত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার অভিব্যক্তি, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে দেশবন্ধু তা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। লোকসংখ্যা অনুযায়ী উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আইনসভা, জেলা বোর্ড ইত্যাদিতে প্রতিনিধি সংখ্যা নির্ধারণ করা আবশ্যক তা দেশবন্ধুর অবিদিত ছিল না। দেশবন্ধুর কন্যা অপর্ণাদেবী লিখেছেন, স্বরাজ্য দলের দ্বারা দেশবন্ধু সমস্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড ও মিউনিসিপ্যালিটি দখল করতে চেয়েছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে প্রায় প্রত্যেক ওয়ার্ডেই স্বরাজ্য দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। বহুসংখ্যক মুসলমান এ-সময় হিন্দুর ভোটে নির্বাচিত হন।
আরও পড়ুন-লিজেন্ড লিগে শাস্ত্রী এবার কমিশনারের ভূমিকায়
১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে চিত্তরঞ্জন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন এবং ডেপুটি মেয়র হন সুরাবর্দি। বেঙ্গল প্যাক্ট হিন্দু-মুসলমানের মিলিত প্রয়াসে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে কোণঠাসা করতে পেরেছিল এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকারকে বিব্রত করা সম্ভব হত না যদি না বঙ্গীয় বিধানসভার অধিকাংশ মুসলমান সদস্যের সমর্থন স্বরাজ্য দলের থাকত। আবদুল রহিম, গজনভি প্রমুখ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্ররোচনা সত্ত্বেও প্রচুর মুসলমান স্বরাজ্য দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতা করেন। এর ফলে ব্রিটিশ সরকারের পদলেহী মুসলমান নেতারা সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন-তিনে ব্যাট করতে পেরে কৃতজ্ঞ মার্শ
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই চুক্তিকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়েছেন। ১৯২৪ সালে সুভাষচন্দ্র কর্পোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার নিযুক্ত হওয়ার পর দেশবন্ধুর লক্ষ্যপূরণের জন্য নির্দেশ দেন নতুন কাউকে নিয়োগ করতে হলে আগে মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর দাবি যেন অগ্রাধিকার পায়। বাংলা প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটি ও ‘মুসলমান’-এর মতো কাগজও বলে যে এই বেঙ্গল প্যাক্ট ১৯১৬ সালের লখনউ প্যাক্টের চেয়ে ভাল।
পরবর্তীকালে সমালোচকেরা বলেছেন যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা এত জটিল ছিল যে তা এই চুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব ছিল না। নিমাইসাধন বসুর মতে, কেবল চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে অক্ষম ছিল। এতদ্সত্ত্বেও এ-কথা সত্য যে মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল। গান্ধী স্বয়ং ৩১ জুলাই ১৯২৪ তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় সুভাষচন্দ্রের কর্পোরেশনে মুসলমানদের জন্য চাকরি সংরক্ষণের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। দেশবন্ধু বাংলায় মুসলমানদের মন থেকে ভয় ও আশঙ্কাকে অনেকাংশে দূর করতে পেরেছিলেন।
মৌলানা আজাদ আক্ষেপ করে বলেছেন যে, চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর বেঙ্গল প্যাক্টকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যই দেশভাগের দরজা খুলে যায়। চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যু নিঃসন্দেহে এর একটা বড় কারণ। আরও দুর্ভাগ্য সুভাষচন্দ্র তখন কারাগৃহে। তিনি অন্তরীণ না থাকলে প্যাক্টকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন যদিও তাকে রক্ষা করা যেত কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। ১৯২৬ সালে ইউরোপীয়দের চেষ্টায় কিছু সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলমান বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে জয়ী হন।
আরও পড়ুন-প্রস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
নির্বাচনের পর প্রাক্তন স্বরাজী আবদুল গফুর দাবি করেন যে বেঙ্গল প্যাক্ট তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে এবং মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের কথা বলেন। এর ফলে ইউরোপীয় ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় সন্তুষ্ট হয়ে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ এর বিরোধিতা করে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। কিন্তু প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়।
কৃষ্ণনগরে বাংলা কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ছিলেন সভাপতি। তিনি কাস্টিং ভোট দিয়ে প্যাক্টকে রক্ষা করেন, অথচ পরের বার তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হল না এবং তিনি স্বরাজ্য দলের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এখানেই ঘটল বেঙ্গল প্যাক্টের সলিলসমাধি। দেশবন্ধুর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। তবু তিনি মুসলমান সমাজের বৃহৎ অংশের জনচিত্তে আলোড়ন তুলেছিলেন।
তাই তো দেশবন্ধুর প্রয়াণের পর রচিত ‘ইন্দ্রপতন’ কবিতায় কাজী নজরুল লিখেছিলেন ‘নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া পাগল মিলন হেতু/ হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু/ জানি না আজ কী অর্ঘ্য দিবে হিন্দু-মুসলমান/ ঈর্ষাপঙ্কে পঙ্কজ হয়ে ফুটুক তাদের প্রাণ।’