শীতকাল মানেই শ্বাসকষ্ট বা সিওপিডির সমস্যার বাড়াবাড়ি। ফুসফুসকে সুস্থ এবং কর্মক্ষম রাখতে জরুরি হল ব্যালান্সড ডায়েট । কী খাবেন জানালেন ডায়েটেশিয়ান এবং ডায়াবেটিক এডুকেটর সোনালি ঘোষ লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী
ফুসফুস শরীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যার মধ্যে থাকে আমাদের প্রাণবায়ু বা বিশুদ্ধ অক্সিজেন। বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতিতে এই অঙ্গের মূল্য আমরা আরও বেশি করে বুঝতে পেরেছি। ফুসফুস হল এমন একটি অঙ্গ যা যে কোনও ভাইরাস দ্বারা দ্রুত আক্রান্ত হয়। শুধু ভাইরাসই নয়— দূষণ, ধূমপান ইত্যাদি নানা কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নানা ধরনের সংক্রমণ বা ইনফেকশন দেখা দেয়।
আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত ভোটে দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের দিকে সমর্থনের ঢল
বর্তমানে অ্যাজমা, সিওপিডি বা লাং ইনফেকশনের পেশেন্ট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই ধরনের রোগ ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় অনেকটাই। বিশেষ করে শীতকালে এই ধরনের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং শীতকালে তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে সারাবছর ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে ব্যালান্সড ডায়েট এবং এক্সারসাইজ করা খুবই জরুরি। ডায়েট এবং ব্যায়াম— এই দুইয়ের মাধ্যমে কীভাবে সুস্থ রাখবেন ফুসফুসকে এটাই আজকের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
আরও পড়ুন-Railway School: রেলের চক্রান্ত
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, ডি, বি, সি এবং কিছু খনিজ পদার্থ, যেমন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম জাতীয় উপাদানে সমৃদ্ধ খাদ্যগ্রহণ করলে ফুসফুসের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে নিয়মিত কিছু যোগাসন বা এক্সারসাইজ, প্রাণায়াম বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে ফুসফুসের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও কিছু হাবর্স আর মশলা রয়েছে যা রান্নায় ব্যবহার করলে সেই খাবারে ফুসফুস সুস্থ থাকবে দীর্ঘদিন।
এবার জানা প্রয়োজন ব্যালান্সড ডায়েটটা কী। প্রধানত পাঁচটি খাদ্যের গ্রুপ রয়েছে। সিরিয়ালস, পালসেস বা ডাল জাতীয় খাদ্য, সবজি, ফল, দুধ বা দুগ্ধজাতীয়, প্রোটিন অর্থাৎ মাছ, মাংস ইত্যাদি। আমাদের প্রাত্যহিক আহারে এই প্রধান পাঁচটি গ্রুপের খাদ্য যখন উপস্থিত থাকে, যার মাধ্যমে দেহের সম্পূর্ণ পুষ্টি সাধিত হয় তাকেই ব্যালান্সড ডায়েট বলা হয়।
আরও পড়ুন-দুর্ঘটনা রুখতে শহরে এবার জরিমানাও
কার্বোহাইড্রেট
ব্যালান্সড ডায়েটে প্রথমেই রয়েছে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য। ফুসফুসের জন্য যেটা সবচেয়ে জরুরি। এমন খাদ্য খেতে হবে যা থেকে কার্বন জাতীয় উপাদান কম উৎপন্ন হয়। এবার কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে যে সিম্পল সুগার থাকে যেমন, চিনি, ময়দা এগুলো যখন বিপাক হচ্ছে তখন এর থেকে কার্বন উৎপন্ন হয়। তাই এই সব খাবারকে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এর পরিবর্তে খেতে হবে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বা যেগুলোর মধ্যে একটু ফাইবার জাতীয় উপাদান রয়েছে যেমন ওটস, বার্লি, কর্নফ্লেক্স ইত্যাদি খেলে ফুসফুস ভাল থাকবে।
প্রোটিন
প্রোটিন জাতীয় খাদ্য খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। কারণ হল প্রোটিনের মধ্যে যেটা রয়েছে তা আমাদের ফুসফুসের প্যাসেজ ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং লাং ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করে। প্রোটিনের মধ্যে যেমন ডিম, লিন মিট, মাছ আর যদি ভেজ প্রোটিনের কথা বলা যায় তবে তার মধ্যে রয়েছে দই, সবরকম ডাল, স্প্রাউটস ইত্যাদি। স্প্রাউটসে রয়েছে কিছু পরিমাণ ভিটামিন সি-ও।
আরও পড়ুন-ক্লাস নিলেন বিডিও
ফ্যাট
ফ্যাট দু-ধরনের হয়৷ স্যাচুরেটেড এবং আন-স্যাচুরেটেড। স্যাচুরেটেড ফ্যাট অর্থাৎ (ঘি, মাখন)। এগুলো শুধু হার্ট নয় লাং-কেও ক্ষতি করে সমানভাবেই। ফুসফুসের বায়ুপথগুলো বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাটের প্রভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই বায়ুপথ পরিষ্কার রাখতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। সবচেয়ে ভাল সাদা তেল বা ভেজিটেবিল অয়েল ব্যবহার করা। এর মধ্যে বেশি উপকারী হল অলিভ অয়েল ব্যবহার করা। অলিভ অয়েলে রয়েছে ভিটামিন ই এবং পলিফেনলস। ভিটামিন ই-তে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিফেনলে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহনাশক উপাদান। এটা অ্যাজমার রিস্ক কমিয়ে দেয়। বিশেষত ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এটা আরও ভালভাবে কাজ করে। এ ছাড়া ফ্ল্যাকসিডও খুব ভাল। এর মধ্যে ওমেগা থ্রি, সিক্স এবং ওমেগা নাইন ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। এই জাতীয় খাবারে ফুসফুসের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন-Mamata Banerjee Targets Delhi : দ্রুত হরিয়ানা-পাঞ্জাব যেতে চাই, জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ভেজিটেবল বা সবজি
ভেজিটেবলসের মধ্যে সবার আগে বলতে হয় গ্রিন লিফ ভেজিটেবলস বা সবুজ শাকসবজির কথা। যেমন পালংশাক। এর মধ্যে রয়েছে ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন-এ। ক্যারটিনয়েডের মধ্যে রয়েছে লেটেইন এবং জেনথানিন জাতীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা ফুসফুস থেকে ফ্রি রাডিকলস বের করে দেয় ফলে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সবজির মধ্যে কুমড়ো, গাজর, বিট, টমেটো রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। এগুলোয় রয়েছে ক্যারটিনয়েড। যা লাং-এর এয়ার প্যাসেজ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। ফলে যে কোনও ধরনের অ্যাজমা বা সিওপিডি বা লাং ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে যায়। ফুসফুসের একটি রোগ হল পালমোনারি হাইপারটেনশন। এই রোগটি সাধারণত যাঁদের হাই ব্লাডপ্রেশার থাকে তাঁদেরই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিটে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ভিটামিন সি যা এই হাইপারটেনশন ডিজিজকে রোধ করে। ব্রকোলি, ফুলকপি, রেড ক্যাবেজ, বেলপেপার— এই সব সবজিতেও রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ফুসফুসের জন্য খুব উপকারী।
আরও পড়ুন-বন্ধু পেইনের পাশে থাকবেন না বেইলি
ফল
যেসব ফল ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ সেগুলো ঠান্ডালাগা, সর্দি, হাঁচি, কাশি বা যে কোনও ধরনের কনজেশন বের করে দিতে সাহায্য করে। যেমন পেয়ারা, আপেল, ব্লুবেরি, আঙুর, আমলা, কমলালেবু, মোসাম্বি লেবু ইত্যাদি। সপ্তাহে অন্তত পাঁচটা আপেল খেলে ফুসফুসের সমস্যা কমে যায়। ফলের মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাভনয়েড যা ফুসফুসের যে কোনও সমস্যা রোধ করে।
পানীয়
বিভিন্ন পানীয় যেমন গ্রিন টি এবং কফি। আমাদের শরীরে থাকা হিস্টামিন (নাইট্রোজেন কম্পাউন্ড) যে কোনও ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ অ্যালার্জিক অবস্থায় ক্ষরিত হয়। গ্রিন টি সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে । কারণ এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। কফিতে রয়েছে ক্যাফেইন যা কি না খুব ভাল ভেসোডায়ালেটার অর্থাৎ রক্তকে তরল রাখতে সাহায্য করে, ক্লট হতে দেয় না। তবে কফি রাতে না খাওয়াই ভাল। ডার্ক চকোলেট বা কোকা পরিমাণ মতো খেলে তা আমাদের ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। লাং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
আরও পড়ুন-Deputy Speaker: ‘৮৯১ দিন পরেও লোকসভায় নেই ডেপুটি স্পিকার’ টুইটারে তোপ ডেরেক ও ব্রায়ানের
হার্বস ও মশলা
বিভিন্ন হার্বস ও মশলা লাং-এর জন্য খুব কার্যকরী। যেমন, রসুনে রয়েছে সেলেনিয়াম, জিঙ্ক এবং কপার যা লাং ভাল রাখতে সাহায্য করে। এক কোয়া রসুন শীতকালে খালি পেটে খান নিয়মিত। বিশেষ করে যেকোনওরকম অ্যালার্জি থেকে মুক্তি দেয় রসুন, কারণ শীতকালে অ্যালার্জি থেকেও কিন্তু শ্বাসকষ্ট হয়। আদা এবং গোলমরিচেরও রসুনের মতোই একইরকম উপকারিতা। এ ছাড়া পাঁচটা হার্বস যা আমাদের রোজকার জীবনে ব্যবহার হয় না কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ । যেমন, অরিগ্যানো, এতে রয়েছে রোজ ম্যারিনিক অ্যাসিড এটার কাজ হিস্টামিন (নাইট্রোজেন কম্পাউন্ড) নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনও ইনফেকশনকে কমিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া এতে রয়েছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রপার্টি। যার জন্য প্যাথোজেনকে ফুসফুসে ঢুকতে বাধা দেয়।
আরও পড়ুন-Sudip Roy Barman: সিপিএমের গুন্ডাদের নিয়ে রাজ্য চালাচ্ছে বিপ্লব দেব, তুলোধনা করলেন সুদীপ রায় বর্মন
লিকোরিক বা মুলেঠি যা প্রাচীনকাল থেকেই অনেক বাড়িতেই সর্দিকাশির জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে । এই মুলেঠি, গোলমরিচ, আদা দিয়ে কাড়হা বানিয়ে খেলে বা বেটে মধু দিয়ে খেলে যে কোনও কনজেশনে খুব কাজ দেয়।
আর একটি হার্বস হল গিলয়। গিলয় সাপ্লিমেন্ট এবং জ্যুস হিসেবেই পাওয়া যায় যা একইরকম ভাবেই উপকারী।
থাইম একটি পরিচিত সবুজ রঙের হার্বস। কন্টিনেন্টাল রান্নায় খুব ব্যবহার হয়। স্যুপে, চাইনিজ রান্নায় এটা খাওয়া যেতে পারে। থাইমে রয়েছে অ্যাপিজেনিন এবং লিউলিওলিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা প্রদাহ কমায় এবং ফুসফুসের প্যাসেজ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
মশলার মধ্যে একটি অতি-পরিচিত নাম হল হলুদ বা টার্মারিক। এর গুণ অপরিসীম। অ্যান্টিইনফ্লামেটরি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিসেপটিক, বায়ুথলিকে পরিষ্কার করে, অ্যান্টি ভাইরাল, ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখতে এর জুড়ি নেই।
আরও পড়ুন-Agartala: ভয় পাবেন না, পাশে আছি: আক্রান্তদের আশ্বাস অভিষেকের
ব্যায়াম
নিয়ম মেনে প্রতিদিন কিছু ব্যায়াম ও প্রাণায়াম করুন। ফ্রি–হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে পারেন ও অনুলোম বিলোম, ভ্রামরি, শীতলি প্রাণায়ামগুলো করলে লাং ভাল থাকবে। স্যাতঁসেঁতে জায়গায় প্রাণায়াম করবেন না। যদি কারও শ্বাসকষ্ট থাকে তা হলে জোর করে করা উচিত নয়। খুব ভোরে না করে একটু পরের দিকে করলে ভাল। মর্নিংওয়াক করা খুব ভাল। যত বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেওয়া যাবে তত লাং-এর কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে।