নয়া বিপদ ডিজিটাল অ্যারেস্ট

গত শনিবার ইডির তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বিশেষ ধরনের সাইবার জালিয়াতি ডিজিটাল আরেস্টের মামলায় ১০ অক্টোবর বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। তাতে আটজনের নামের পাশাপাশি তাদের তৈরি করা ভুয়ো ২৪ কোম্পানিরও উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে আছে ধৃতরা। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন তন্ময় সিংহ

Must read

ডিজিটাল অ্যারেস্ট। সাইবার প্রতারণার এক নয়া ছক। ফাঁদে পা দিলেই ফাঁকা হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। ইদানীং তৎপরতা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি। ডিজিটাল অ্যারেস্টের একটি মামলায় সম্প্রতি চার্জশিট দাখিল করেছে ইডি। যেখানে সব মিলিয়ে জালিয়াতির অঙ্ক ১৫৯ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি নতুন অ্যাডভাইজারি জারি করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আই৪সি)-এর তরফে। এমন কোনও ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তা জাতীয় সাইবার ক্রাইম হেল্পলাইন নম্বর ১৯৩০ বা www.cybercrime.gov.in পোর্টালে জানাতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন-ডেঙ্গি প্রবণ এলাকায় বিনামূল্যে মশারি দেবে রাজ্য!

আসলে বিপদ আমাদের মধ্যে ছিলই, আমরা প্রতারিত হচ্ছিলাম, আমরা আইনের কড়া নাড়ছিলাম। কিন্তু কখনওই সেই জায়গাটা তৈরি হচ্ছিল না যাতে সারা ভারতব্যাপী এই বিপদ সম্পর্কে একটা সচেতনতা তৈরি করা যায়। এখন বোঝা যাচ্ছে যে, নতুন মোবাইলে ডিজিটাল অ্যারেস্ট হওয়ার ভয় পাইয়ে যে অ্যারেস্ট না করার জন্য টাকা দাবি করা হচ্ছে তা আসলে ভুয়ো। কতগুলো উদাহরণ দিলেই আমরা বুঝতে পারব কীভাবে আমরা এই স্ক্যামের মাধ্যমে নিজেরা প্রতারিত হচ্ছি।
অনলাইনে সব জিনিস কিনে অস্মিত, মোবাইলে ট্র্যাক করা কুরিয়ার সার্ভিসকে তার বহুদিনকার অভ্যাস। হঠাৎ করে তার মোবাইলে মেসেজ আসে যে আপনার ঠিকানা আপডেট না করার জন্য আমরা ডেলিভারি করতে পারছি না। চিন্তিত হলেও অস্মিত ফোন করে কাস্টমার কেয়ারে, ফোন করার পর কাস্টমার কেয়ারে অ্যাড্রেস আপডেট করতে গিয়ে হয় বিপদ, প্রথমে অ্যাড্রেস আপডেট করার পর ওটিপি আসে ওটিপি দিয়ে দেওয়ার পর হয় বিপদ। অস্মিত দেখে সামরিক পোশাকে সজ্জিত একদল লোক যাদের মাথার উপর সরকারি প্রতীক তারা ভিডিও কলে তাকে জানাচ্ছে যে আপনি ড্রাগস-এর অর্ডার দেন, অনলাইন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। আমরা বহুদিন ধরে আপনার সন্ধানে আছি আমরা আপনার বাড়ি ট্র্যাক করে ফেলেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পেশাল ফোর্স আপনার বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে। মাথায় হাত অস্মিতের। ফোনের কল কাটার মতন ক্ষমতা তার নেই ফোন পুরোপুরি হ্যাক করে নিয়েছে ওই সংস্থা। অস্মিত বুঝতে পারে তার মান-সম্মান-ইজ্জত সব এবার বরবাদ হয়ে যাবে। করুণ স্বরে প্রার্থনা করে যে আমি দোষী না হলেও বলুন আমাকে কী করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এক লক্ষ টাকা অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে বাধ্য হয় অস্মিত।
পরের ঘটনাটাও একই রকম। অনলাইনে মাল কেনার পর, কুরিয়ারের ডিটেলস পাই প্রিয়াংকা। তারপরে একদিন হঠাৎ তার ফোনে আসে ফোন, জানানো হয় ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে পার্সেল ডেলিভারি না হওয়ার জন্য ফোন করা হয়েছে। আপনার বাড়ি আমাদের ডেলিভারি ম্যান খুঁজে পাইনি তাই আপনি যদি পুনরায় ডেলিভারি চান তাহলে ‘এক’ টিপুন। নিঃসন্দেহে এক টেপার পরে ফোনে আসে ওটিপি, পরিষ্কার ওই কুরিয়ার কোম্পানি থেকে আসা ওটিপি নিঃসংশয়ে শেয়ার করার পর প্রিয়াঙ্কাকে জানানো হয় বোম্বে ডক ইয়ার্ডে একটি সরকারি সংস্থা তার কুরিয়ার আটক করেছে কুরিয়ারের মধ্যে ড্রাগস ছিল। মানসিক ভাবে চাপ দেওয়া শুরু হয় শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সমঝোতা করে ২৫ হাজারে নিজের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য।

আরও পড়ুন-চাকরি দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রতারণা! অভিযুক্ত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক

পরের ঘটনাটিও একই রকম। ফেসবুকে হঠাৎ করে ভিডিও কল আসে রাকেশের। এক মহিলা ভিডিও কল করে কথা বলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে উলঙ্গ হয়ে যায় এবং বলে তার সঙ্গে এই ভিডিও কলের ছবি ভাইরাল করে দেবে তার পরিচিত মহলে এবং স্ক্রিনশট পাঠাতে শুরু করে তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে। ভিডিও-তে চলে আসে সরকারি আধিকারিকদের ছবি। রাকেশকে জানানো হয় যে সে সেক্স রাকেটের সঙ্গে যুক্ত অবিলম্বে যদি না সে জরিমানা দেয় তাহলে তাকে অ্যারেস্ট করা হবে এবং বোম্বের কোর্টে প্রডিউস করা হবে। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার দিয়ে সে-যাত্রায় রক্ষা পায় রাকেশ।
কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষ দাস হয়ে গেছে মোবাইলের। সারাদিন প্রত্যেকে মোবাইল-বন্দি। কারও সময় কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিল দেখে, কারও অনলাইনে বিভিন্ন শপিং সাইট সার্ফ করে আবার কারও বিভিন্ন অনলাইনে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ দেখে। শৈশব এবং কৈশোরও বন্দি হয়ে গেছে মোবাইলে বিভিন্ন গেমের চক্করে অথবা পর্নের বিভিন্ন সাইটে। এরই সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়েছে জামতাড়া গ্যাংয়ের মতো দেশি-বিদেশি স্ক্যামাররা। টেলিগ্রামে পয়সার হাতছানি, কখনও ক্রিপ্টো কারেন্সি কখনও বিভিন্ন বেটিং সাইট থেকে পয়সা রোজগারের হাতছানি, সহজেই সফট টার্গেট পেয়ে যায় এই ধরনের স্ক্যামাররা।
এই ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ মোবাইলের দুনিয়ার নতুন বিপদ। এখানে আপনার ফোনে ভিডিও কলে আপনাকে আটকে রেখে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করবে স্ক্যামাররা যেখানে আপনি দেখতে পাবেন সরকারি আধিকারিকদের অফিস, সরকারি বিভিন্ন প্রতীক এবং সকলেই নির্দিষ্ট পোশাকে সুসজ্জিত। আপনি বুঝতেই পারবেন না যে এরা আসলে স্ক্যামার। আমাদের প্রাচীন প্রবাদ ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’। আমরা খুব সহজেই তাই এই আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচতে যেকোনও সহজ পথ এবং অনেক সময় ঘুরপথে সমঝোতাতেও রাজি হয়ে যায়। স্ক্যামাররা আমাদের এই স্বভাবত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’কে এই সময়কার সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে সারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশের কাছে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন-চা-তেল-বিস্কুট-শ্যাম্পুর দামে আগুন লাগতে চলেছে

তাহলে উপায়? আমাদের ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বলে কোনও শব্দবন্ধ আমাদের ভারতীয় আইনে নেই। তাই আপনার কাছে ফোন এলে আপনি নিশ্চিত থাকুন এটা সম্ভব নয়। এরপরেও আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে আপনাকে ওরা ভীত করলেও, আপনাকে চিন্তা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনওভাবেই ওই চাপের কাছে এবং ওদের লোক-দেখানো সেট-আপের সামনে মাথা না নোয়ানোর। শুধুমাত্র ব্যাপক সচেতনতা সমস্ত মোবাইল গ্রাহকদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারলেই আমরা এই ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ নামক স্ক্যামারদের বেকার করে দিতে পারব। দিনের শেষে আমাদের মনে রাখতে হবে সবচেয়ে বড় সত্যটা : ফোনে বা ভিডিও কলে আমাকে কেউ অ্যারেস্ট করতে পারবে না, ভারতের সংবিধান কাউকে সেই অধিকার দেয়নি

Latest article