নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-এর সাক্ষাৎকার নিলেন অংশুমান চক্রবর্তী
এত বছর পরেও ‘ফ্যাতাড়ু’র জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এর কারণ কী?
আগামী ২৬ ডিসেম্বর কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে মঞ্চস্থ হবে ‘ফ্যাতাড়ু’। নাটকটি আজও দারুণ জনপ্রিয়। তার কারণ, ফ্যাতাড়ুরা যে কথাগুলো বলতে চায় সেটা বোধহয় সমকালীনতার স্তর পেরিয়ে চিরকালীনতার দিকে যায়। যতদিন পৃথিবীতে ক্ষমতা থাকবে, ততদিন এইভাবে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় যখন বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তখন সব জায়গায় এইরকম প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেছে। ফ্যাতাড়ুরা দলমত নির্বিশেষে একটা রাজনীতির কথা বলে। পৃথিবীতে যতদিন সাম্যের অভাব থাকবে, ততদিন ফ্যাতাড়ুরা থাকবে।
আরও পড়ুন-KMC Election: প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরেই প্রচারে নেমে পড়ল তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা
১৮ বছর বয়সে থিয়েটারে এসেছিলেন। তখন কি অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন? নাকি পরিচালক?
তখন ওইভাবে কিছু ভাবিনি। আমি ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম, গান গাইতাম, নাচ করতাম, ফুটবল খেলতাম। থিয়েটারে এসে দেখলাম, এখানে অনেক কিছু করা যায়। সেই হিসেবে মাধ্যমটাকে ভাল লেগেছিল। তবে ঠিক কী করতে চাই, সেই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা তখন আমার তৈরি হয়নি। শুরু হয়েছিল মজা করতে করতে, পরে সিরিয়াসলি জড়িয়ে পড়ি।
আরও পড়ুন-পুরসভা জয়ে বৈঠক
থিয়েটার হবে আপনার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন, সেটা কখন মনে হয়েছিল?
১৯৯২ সালে আমি গোবরডাঙা থেকে কলকাতায় চলে আসি। তখন আমার মনে হয়েছিল যে, থিয়েটারটাই করতে হবে। কলকাতার কাছাকাছি একটা স্কুলে চাকরি নিলাম। সেখানে পড়াতাম। পাশাপাশি থিয়েটার। ২০১০ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দিই। তারপর পুরোপুরি নিজেকে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলি। আসলে সেইসময় মনে হচ্ছিল, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন-বিজেপি-সিপিএমে ভাঙন টিটাগড়ে
আপনার ‘নাটকের মতো’ ছবিটি যথেষ্ট সফল। তবু পরবর্তী সময়ে আপনাকে সিনেমার পরিচালক হিসেবে পাওয়া গেল না কেন?
এটা হয়নি আমার একবগ্গা নেচারের জন্য। এখানে পরিচালকের সঙ্গে প্রযোজকদের যে সম্পর্ক থাকে, আমি সেই সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে চাইনি। আর একটা কথা বলে রাখি, আমি কিন্তু প্রথম ছবিটা করার জন্য কোনও প্রযোজকের কাছে যাইনি। আমার অনেক বন্ধু জানত, কেয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে আমি কিছু রিসার্চ ওয়ার্ক করেছি। সেটা ১৯৯২ সাল থেকে। বন্ধুরা এটাও জানত, আমি একটা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেছি। লিখেছি নিজের আনন্দেই। ছবি করার উদ্দেশ্যে নয়। হঠাৎ একজন প্রযোজক আমার কাছে চলে এসেছিলেন। বিষয়টা হল, ছবি করতে দিলে আমি আমার কনটেন্ট নিয়ে কাজ করব। আমি যা চাইব সেটাই করব। ছবি করব আমার নিজের ভাবনা থেকেই। সেটা আমাদের এখানে অসম্ভব বলেই মনে হয়েছে। পরে ‘ইয়ে’ নামে একটা ছবি করেছি। সেটা এখনও রিলিজ করতে পারিনি। সেটা করেছি বন্ধুদের টাকায়। প্রযোজকদের ছবির মধ্যে আমি আর ঢুকব না। অর্থ উপার্জনের জন্য বা পরিচালক হিসেবে একটার পর একটা ছবি তৈরির কোনও মোহ আমার নেই। আমি যে কথাগুলো বলতে চাই, সেই কথাগুলো যদি থিয়েটারে বলতে পারি তো মিটেই গেল।
আপনি প্রচুর তথ্যচিত্র এবং ছোট ছবি তৈরি করেছেন। দর্শকদের মধ্যে এই ধরনের কাজ দেখার প্রবণতা কতটা?
দর্শকরা এই ধরনের কাজ দেখেন। দেখতে পছন্দ করেন। তথ্যচিত্র তৈরি আমার একটা নেশা। ছোট ছবির কাজ আমি বেশি করেছি লকডাউনের সময়। বাড়িতে চুপচাপ বসে না থেকে কিছু একটা করার উদ্দেশ্য নিয়েই। পুরো কাজটা করেছি মোবাইলে। ছবি এঁকে শর্ট ডিভিশন করে আমার বন্ধু অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার, রজতাভ দত্ত-কে পাঠিয়ে দিতাম। ওরা মোবাইলে শুট করে পাঠিয়ে দিত। তারপর আমি বাড়িতে বসে এডিট করতাম। কাজগুলো প্রচুর মানুষ দেখেছেন। ফলে বোঝাই গেছে এই ধরনের কাজের দর্শক আছে।
অনেক নাটকের ওয়ার্কশপ করেছেন। নতুন প্রজন্ম থিয়েটারের প্রতি কতটা আগ্রহী?
যথেষ্ট আগ্রহী। আমি কিছুদিন আগেই একটা নতুন কাজ শুরুর মুখে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, কমবয়সি যাঁরা কাজ করতে আগ্রহী, তাঁরা মেল করতে পারেন। শুরুতেই ৪৮২ জনের আবেদনপত্র এসেছিল। তারপর একদিন তাঁদের দেখে আমি ১০৪ জনকে বেছে নিই। পরে তাঁদের থেকেও আমি বেছে নিই ৩০ জনকে। এটা খুব কঠিন কাজ। ১০৪ জনের প্রত্যেকেরই সমান পারদর্শিতা। বেছে নেওয়া ৩০ জনের মধ্যেও উনিশ-বিশ তফাত। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম থিয়েটারের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী। একটা সাধারণ ধারণা আছে, নতুন প্রজন্ম প্রান্তিক পারফর্মিং আর্টের প্রতি বিমুখ। আমি এটা একেবারেই মনে করি না।
আরও পড়ুন-আফ্রিকায় করোনা বিরাটদের সফর অনিশ্চিত
কোন অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
আমি সবার সঙ্গে কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। আমার কাজ করার পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। আমি অভিনেতাদের নিয়ে বাইরে চলে যাই। প্রি-প্রোডাকশন অনেক দিন ধরেই চলে। প্রথমদিন থেকেই অভিনেতার কাছে সেট, লাইট, মেকআপ— সমস্তকিছু থাকে। ফলে আমার সঙ্গে কাজ করতে এসে তাঁরাও মজা পান। তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সময় সেই মজাটা পাই আমিও। আর একটা কথা, আমি অভিনেতাদের কোনও ইনস্ট্রাকশন দিই না। ‘ওখানে যাও, এখানে বসো’ ইত্যাদি বলা নির্দেশকের কাজ বলে আমার মনে হয় না। করি না কোনও কম্পোজিশনও। ফলে অভিনেতারা আমার কাছে অনেক স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন।
অভিনেতা হিসেবে আপনাকে সেইভাবে পাওয়া গেল না কেন?
অভিনয়টা আমি এনজয় করি না। পিছনে থেকে কাজ করতেই বেশি ভালবাসি।
এখন আপনাকে বেশিরভাগ সময় চুইখিম গ্রামে দেখা যায়। কলকাতা ছাড়লেন কেন?
হুমম। আমি এখন চুইখিমেই বেশি থাকি। মাঝেমধ্যে কলকাতায় আসি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক গ্রাম চুইখিম। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মানুষজনও সহজ-সরল। ওখানে একটা স্কুল আছে। সেটার সঙ্গে আমরা জড়িয়ে পড়েছি। কীভাবে স্কুলটাকে আরও ভাল করা যায়, ভাবনাচিন্তা করছি। চুইখিমে করছি মেডিক্যাল ক্যাম্প। আছে আরও পরিকল্পনা। আসলে আমরা থিয়েটার কেন করি? মানুষের জন্যই তো? সেই ভাবনা থেকে আমরা বন্ধুরা মিলে চুইখিমের মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। পিছিয়ে পড়া ছোট্ট গ্রামটায় অনেক কাজের জায়গা রয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে আমি নতুন করে বাঁচার অক্সিজেন পাচ্ছি। তার মানে এই নয় আমি কলকাতা বা থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছি। সবই করছি। তবে থিয়েটারের কাজের বাইরের সময়টা আমি কাটাচ্ছি পাহাড়ের মানুষদের সঙ্গে।
আপনার লেখা নাটক নিয়ে বই বেরোচ্ছে তো?
হুমম। বইমেলায় বইটা প্রকাশিত হবে। কারিগর থেকে। থাকছে সূর্য-পোড়া ছাই, ব্রেন, নিঃসঙ্গ সম্রাট ইত্যাদি নাটক।
এখন অনলাইনে থিয়েটার দেখানো হচ্ছে। অনেকেই ওয়ার্কশপ করছেন অনলাইনে। এই বিষয়ে আপনার কী মতামত?
অনলাইনে থিয়েটার বা অভিনয়ের ওয়ার্কশপ হতে পারে না। শুধুমাত্র তথ্য জানানো যেতে পারে। যে মুহূর্তে থিয়েটার ডিজিটাল মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, তখন আর সেটা থিয়েটার থাকছে না। সম্পূর্ণ একটা অন্য মাধ্যম হয়ে যায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
জীবনের শেষ থিয়েটারটা করার ইচ্ছা আছে শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’। সেটাই হবে আমার শেষ কাজ। তারপর আর থিয়েটার করব না।