গুলজারের ভিটেমাটি
লাস্ট ট্রেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসছে পাঞ্জাবে। ট্রেনের ভিতরে এবং মাথায় এক বিন্দুও জায়গা খালি নেই। কেউ আসছেন পরিবারের সঙ্গে। কেউ আসছেন পড়শির সঙ্গে। ট্রেনের এক কামরায় বসে আছেন গুলজার সাহেব। সামনের সিটে যমজ সন্তানকে নিয়ে মা। ভিড়ের চাপে ট্রেনের মধ্যেই মৃত্যু হল এক সন্তানের। সকলে বলছেন মৃত সন্তানকে ট্রেন থেকে বাইরে ফেলে দিতে। জীবিত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে নতুন ভারতবর্ষের। বিয়াস নদীর ব্রিজ পেরোলেই পাঞ্জাব। সকলে অপেক্ষা করছে কখন দেখা যাবে সেই ব্রিজ। আর মৃত সন্তানটিকে বাইরে ফেলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছে ট্রেনের বাকি যাত্রীরা এবং সন্তানের পিতা। মা কিছুতেই মৃত সন্তানকে ফেলে যেতে চায় না। বাকিরা বোঝাতে থাকে জীবিত সন্তানকে নিয়েই নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখতে হবে। ভোরের কুয়াশার আলো ফুটতে ফুটতে ট্রেনের সকলের সে কী উল্লাস! দূরে দেখা যাচ্ছে বিয়াস নদীর ব্রিজ। ব্রিজ পেরোলেই ভারতবর্ষ। নতুন দেশ। নতুন স্বপ্ন। ব্রিজের উপরে ট্রেন আসতেই মৃত সন্তানের পিতা এক ঝটকায় বিয়াস নদীতে তার সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলল। মৃত সন্তানটি যখন বিয়াস নদীর জলে পড়ছে তখন সে চিৎকার করে কাঁদছে। নিমেষে কামরার ভেতরে চিৎকার ও কান্নার রোল ভেসে উঠল। কারণ দুঃখে-যন্ত্রণায় আচমকাই তার বাবা মৃত সন্তানকে রেখে জীবিত সন্তানকেই ছুঁড়ে ফেলেছেন বিয়াস নদীর জলে। গুলজার সাহেব সব দেখছেন নিজের চোখে আর ভাবছেন তাঁর ফেলে আসা ভিটেমাটির কথা। ভাবছেন ওই মায়ের যন্ত্রণার কথা। যে ভিটেমাটিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল লাস্ট ট্রেনের সব যাত্রীই। ফেলে আসা নিকানো উঠোন। দাওয়ায় মাটির প্রলেপ দেওয়া আর সন্ধেবেলায় পিদিম জ্বালা।
আরও পড়ুন-
সুন্দর দিন কাটাইতাম
এ গল্প শুধু গুলজারের রিজু রিভুর গল্প নয়। এ গল্পে আছে ভিটেমাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় ওপার বাংলা থেকেও হাজার হাজার মানুষ এসেছে এপারে তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে। কেউ এসেছে দাদিকে সঙ্গে নিয়ে এপারে। কেউ এসেছে ঠাম্মা-দিদার ঘুম পাড়ানোর ছড়া শুনতে শুনতে। আজও তাদের মনে পড়ে যায় তাদের ফেলে আসা গ্রামে মাটির দেওয়ালে গাঁথা ঘরের কথা। যে দেওয়াল জুড়ে আছে ছোট ছোট সুখ আর স্নিগ্ধ মনস্কাম। সকাল-সন্ধে এই মাটির ঘরের রোয়াকে চলত পাড়ার সুখ-দুঃখের বারমাস্যা। মাঝে মাঝে লেপে নেওয়া হত উঠোন, বাড়ির দেওয়াল আর রোয়াক। দূষণমুক্ত করার জন্যে সঙ্গী ছিল গোবর জল। দেওয়াল জুড়ে আঁকা থাকত আলপনা। আর উঠোন জুড়ে পাতা থাকত ভালবাসার সরগম। সকাল-বিকেলে সেখানে সুর উঠত আত্মীয়তার। উঠোনের একপারে ছিল শিউলি ফুলের গাছ। গোবর লেপা উঠোনে এই ভিটেমাটিতেই ভোরের শিশির মেখে শিউলিরা ভিড় জমাত। অন্য পারে ছিল খেজুরের রস থেকে পাটালি বানানোর উনুন আর লোহার ১০ নম্বরের কড়াই। শীত সকালে গাছিরা মাটির হাঁড়ি থেকে রস দিয়ে যেত। বাড়ির সবাই ঘিরে বসত উনুনের চারিদিকে। তারপর সর্ষেফোট, বাঘাফোট হয়ে খেজুরের রস রূপ নিত পাটালির। আবার বিকেলবেলা গাছিরা এসে মাটির ভাঁড়গুলোকে পরিশুদ্ধ করার জন্যে খড় দিয়ে পুড়িয়ে নিত। ভিটেমাটির অদূরেই ছিল হাঁটু জল পেরোনো শুকনো নদী। বর্ষা এলেই তার অন্য রূপ। নদী পেরোনো বাঁশের সাঁকো বর্ষার জলে টলমল করত। আর সূর্য নামলেই সাঁকো পারে পানসি নৌকা বেঁধে হাসান মিয়া গান ধরত, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। এদিকে উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চে সন্ধ্যা পিদিম টিম টিম করে জ্বলতে থাকত। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত হ্যারিকেন, লণ্ঠন। ভিটেমাটিতে তখন একফালি আলোর জন্যে চেয়ে থাকত ছোটরা বড়রা।
গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়েছে যাদের তারাও ভিটেমাটির প্রেমে, বিরহে দিন কাটিয়েছে। যে মাটির গন্ধে গ্রামে তাদের সময় কাটত, শহরে এসে সেই মাটিই হয়েছে দুর্মূল্য। ভিটেমাটি ছেড়ে শহুরে ফ্ল্যাটের রূপকথায় মাটি নেই, আছে ভিটেমাটির স্মৃতি ভেজা গন্ধ। নেই বাড়ির ঈশান কোণের হাসনুহানা গাছ। নেই বর্ষার দিনের প্রথম কদম ফুলের গন্ধ। ফ্ল্যাটের দক্ষিণের জানলায় ছোট ছোট টবে রংবাহারি গাছের সারি। ভিটেমাটির এই গন্ধ থেকে অনেক দূরে শহুরে মন।
স্বপ্ন দ্যাহি দ্যাশের বাড়ির
বিশ্বের দেশে দেশে ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে দিন কাটানোর মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রায় ১১ কোটির মানুষ হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আর সুদানে সেনা বনাম আধাসেনার লড়াইয়ে নতুন করে ভিটেমাটিহীন হয়ে পড়েছেন ২ কোটি মানুষ। জাতিসংঘের হিসেবে ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুরু হওয়ার পরই হুড় হুড় করে বাড়ছে উদ্বাস্তু সংখ্যা। আফগানিস্তানেও রাজনৈতিক পালাবদলের পড়ে ভিটেহীন হয়েছেন অনেকে। রাশিয়ার হামলার পড়ে ইউক্রেন ছেড়ে এক জামাকাপড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন অসংখ্য মানুষ। বেশ কয়েকটি দেশ এই ভিটেমাটিহীন মানুষকে আশ্রয় দিতে চায়নি। ১৯৫১ সালে জেনেভা কনভেনশনে শরণার্থী এবং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতিতে যেসব দেশ স্বাক্ষর করেছিল সেই দেশগুলি আজ উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। জীবনের জন্যে তাদেরকে ছাড়তে হয়েছে ভিটেমাটি। অথচ এই ভিটেমাটিতেই তারা একসময় বন্ধক রেখেছিলেন তাঁদের স্বপ্ন। আবার প্রায় ৭৭ বছর আগে পূর্ব পাকিস্তানের নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এসেছিল যেসব পরিবার, তারা এখন পুরো ভারতীয়। নতুন করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি করছেন আপন ভিটে। বাঙালি উদ্বাস্তুদের ভিটেমাটির গল্প পাল্টেছে। পাল্টেছে তাদের সমাজ জীবন, অর্থনীতিক জীবন। ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার ঠিক দু’দিন পরে যে র্যাডক্লিফ লাইন টেনে উপমহাদেশের মানচিত্র চিরতরে পাল্টে দেওয়া হয়েছিল—তাতে একদিকে যেমন কোটি কোটি মানুষ নিজের দেশ পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন, অন্যদিকে কয়েক লক্ষ মানুষকে হারাতে হয়েছিল নিজের দেশ, নিজের ভিটেমাটি। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের উদ্বাস্তুদের অনেকেরই এখনও ছবির মতো মনে রয়ে গেছে ছেড়ে আসা দেশের কথা, ভিটের কথা। ‘‘অহনও রাত্রে স্বপ্ন দ্যাহি দ্যাশের বাড়ির। নদীরে তো দ্যাশে গাঙ কইত। আমরা গাঙ্গে স্নান করতে যাইতাম। কত্ত কিসু মনে পড়ে, হায় কপাল।’’
আরও পড়ুন-অপরাজিতা বিলের সপক্ষে গর্জে উঠুন একসাথে
কাঁটাতার পেরিয়ে অন্য ভিটে
সন্ত্রাসের ঘায়ে সর্বহারা বিশ্বের প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ মানুষ! ভিটেমাটি ছেড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে পড়েছেন কেউ। কেউ আবার কোনওমতে দু’বেলার খাবার জোগাচ্ছেন উদ্বাস্তু শিবিরে। অনেকে যাত্রিবোঝাই নৌকোয় সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছেন আস্তানার খোঁজে। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে উদ্বাস্তু সমস্যার এই ভয়াবহ চেহারা সামনে এনেছে রাষ্ট্রসংঘের একটি রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমন ভয়ানক শরণার্থী সমস্যা আর হয়নি। শুধু ২০১৪ সালেই ভিটেমাটি ছেড়েছেন এক কোটি দশ লক্ষ মানুষ। উদ্বাস্তু সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভাব ফেলছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে পড়শি দেশগুলোতেও। যেমন, সিরিয়া ও ইরাকে দু’বছর ধরে টানা রাজনৈতিক টালমাটাল এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর দাপট চলতে থাকায় সে দেশের মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন তুরস্ক, জর্ডন, লেবাননের মতো দেশে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে জর্ডনে দ্বিগুণ হয়েছে বেকারের সংখ্যা। বিশেষত শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। পড়শি দেশ থেকে আসা শরণার্থীরা এখন লেবাননের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ দখল করেছে। তুরস্কের সরকার জানিয়ে দিয়েছে, সিরিয়ার সঙ্গে যে দু’টি মূল সীমান্তরেখা রয়েছে তা-ও অবিলম্বে বন্ধ করবে তারা। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উদ্বাস্তু নৌকা নিয়ে সরব হয়েছে ইউরোপের দেশগুলিও। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে, আফ্রিকার উপকূলেই ঠেকাতে হবে চোরাচালানকারীদের। ভূমধ্যসাগরের নৌকাডুবি এবং যাবতীয় বাধাবিপত্তি পেরিয়ে যাঁরা তীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন, তাঁদের কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে। রাষ্ট্রসংঘের ওই রিপোর্ট বলছে, মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় বাড়াচ্ছেন পড়শি দেশগুলোতে। একটা সময়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো তুলনামূলক ভাবে কম জনসংখ্যার দেশগুলোতে এই শরণার্থী সমস্যা যে বিশ্বের অর্থনীতির উপরে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তা নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরাও। ২০২৩-এর শেষে পৃথিবীতে নিপীড়ন, সংঘাত, হিংসা, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা স্বাভাবিক সামাজিক জীবনকে ব্যাহত করে এমন ঘটনার ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ১১৭৩ লক্ষ; এর মধ্যে ৬৮৩ লক্ষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, অর্থাৎ নিজের দেশের মধ্যেই নিজ বসতি থেকে বিতাড়িত বা পালাতে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষ। ৩৭৬ লক্ষ আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু, ৬৯ লক্ষ শরণার্থী এবং ৫৮ লক্ষ মানুষ অন্যান্য দেশের সরকারের থেকে নিরাপত্তা চান। ৭৩% উদ্বাস্তু আদতে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন অথবা দক্ষিণ সুদানের বাসিন্দা। ৩৯% উদ্বাস্তুর ঠাঁই হয়েছে ইরান, তুরস্ক, কলম্বিয়া, জার্মানি এবং পাকিস্তানে। গত বছরের শেষে পৃথিবীতে উদ্বাস্তু শিশুর সংখ্যা ৪৭০ লক্ষ, যার মধ্যে ২০ লক্ষ জন্মেছেই উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়ে। ৪৪ লক্ষ মানুষের নিজের কোনও দেশই নেই, অর্থাৎ কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেই তাঁদের।
২০১১-র আরব বসন্তের পর থেকে একটানা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় ৮৫% পরিবার তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ৯০%। তদুপরি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়া ও তুরস্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূমিকম্পের ফলে ঘরবাড়ি হারানো মানুষের সংখ্যাও কিছু কম নয়। আরব বসন্তে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত আরেকটি দেশ হল দক্ষিণ সুদান। ২০২৩-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ সুদানের ৪০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত, যার মধ্যে ২২ লক্ষ দেশচ্যুতও। ২০১৭-র মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত, ১২ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা উপজাতির মানুষ মায়ানমার থেকে বিতাড়িত। পৃথিবীর বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবির এই দেশহীন রোহিঙ্গাদের জন্য, বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে। কঙ্গো এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। খরা, ক্ষুধা ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘকাল ধরে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে সোমালিয়া। পৃথিবীর প্রতি ছয়জন উদ্বাস্তুর মধ্যে একজন আফগান। অধিকাংশ আফগান উদ্বাস্তু ইরান বা পাকিস্তানে আশ্রিত। ২০২৩-এ বহু আফগান শরণার্থীকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির এই কোটি কোটি উদ্বাস্তুদের বছরের পর বছর ধরে দেখার পরে, ২০২২ থেকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পশ্চিমের পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছে সাদা চামড়ার উদ্বাস্তুদের।
আরও পড়ুন-বিমাখাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ১০০ শতাংশ করার প্রস্তাব কেন্দ্রের
বাবুদের ভিটে
ঘর ছেড়ে আসা যদি ভিটেমাটি ছাড়া হয় তবে তো প্রতিদিন সকালে ক্যানিং লোকালে, হাসনাবাদ লোকালে হাজার হাজার মেয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আসে এই শহরে। কংক্রিট, গাড়ির হর্ন, নিয়ন আলোর অন্ধকার তাদেরকে অন্য ভিটেতে নিয়ে যায়। ওই নতুন ভিটেতে বাবুরা এসে তার গ্রামের ভিটেমাটির খবর রাখে না। মদিরা আর আলোর নেশায় রূপ কথার এক নতুন দেশ তৈরি করে। সে দেশে মাটি নেই, ভিটে নেই, ঘর নেই, স্বপ্ন নেই, সত্য নেই, ভালবাসা নেই। কাজ সেরে কেউ সন্ধ্যায়, কেউ ভোর রাতে বাড়ি ফেরে। অথচ এই ভিটের মাটি নিয়েই তৈরি হয় দুর্গতিনাশিনীর রূপ। এই ভিটের মাটিতেই উৎসবের আলোর সূচনা হয়। ভিটেমাটি হারানো নারীরাও তখন বলতে থাকেন,
‘‘মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং’’।
ভিটেমাটি হারানো শতাব্দী
যৌথ পরিবারের স্বপ্ন সোহাগ আর ভালবাসা ছেড়ে যারা ঘর বেঁধেছে শহরে তারাও তো হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি। এ যেন মাটির কাছে জীবনের আত্মসমর্পণ ব্যক্তি সুখের সঙ্গে আপস। অথচ ভিটেমাটির উঠোন হাঁটতে হাঁটতেই সে গলিপথ রাজপথে এসেছে জীবনের সন্ধানে, জলের সন্ধানে। অথচ মাটির বুকের মাঝে বন্দি যে জল তার দেখা পায় না। সুদূর আকাশ ছোঁয়া ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সুদূর উঠোনে তাকিয়ে থাকে। বুকে থাকে কাজল মেঘের সজল ছায়া। মাটির দেখা সে পায় না। শুধু চোখের জলে ভিজে যায় ভিটেমাটির স্বপ্ন।
এই শতাব্দীটাই ভিটেমাটি হারানোর মানুষের শতাব্দী। ভিটে হারানো মানুষ বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরছে ঘর, কুলুঙ্গি, মাটির দেওয়ালের আলপনা, ফেলে আসা দুপুর আর কুয়োতলার গল্প। কংক্রিটের চার দেওয়ালে বাঁচিয়ে রাখছেন নিজেকে। বাঁচিয়ে রাখছে ভিটেমাটি। অন্য দেশে। অন্য শহরে। ভিটেমাটির স্বপ্নে কেউ বা বলছে, ফাইট ফাইট ফাইট, ফিরতে হবে ভিটেমাটিতে। সন্ধেবেলার তুলসী মঞ্চে, ভোরের শিউলিতলায় আর ওই মজে যাওয়া নদীর পাড়ে।