‘তুমি যে মরিবে খাঁটি, তোমাকেও দিবে মাটি’
মাটির শরীর, মাটির বাড়ি, মাটিতেই আমাদের বসবাস, মাটির উপর চলাফেরা, মাটির উপর কর্মযজ্ঞ, মাটি জোগায় ভাত, মাটি সবার আত্মার বাঁধন, মাটির সঙ্গে দুঃখ-সুখের বাত! মাটি জীবন, মাটি সৃষ্টি, মাটি মৃত্যু— মাটি সর্বক্ষণ এই পৃথিবীর প্রতিটি জীব ও জড়ের এত যে খেয়াল রাখে, তার খোঁজ কি কেউ নেয়? মাটি যখন কান্না করে বলে ‘আমাকে দেখ’, তখন কেউ কি মাটির বুকে কান পেতে শোনে তার সুবিধা-অসুবিধার কথা, তার অভিযোগগুলো!
নাহ্, মাটির কথা কেউ শোনে না। শুধুমাত্র নানা প্রয়োজনে নয় প্রয়োজন ছাড়াও, লোভ-লালসা কিংবা স্বার্থ মেটানোর তাগিদেও এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যে মাটি অসুস্থ হয়
মাটির শরীরে বাসা বাঁধে নানা ধরনের ভৌতিক, জৈবিক, এবং রাসায়নিক অসুখ! কিন্তু মানবজাতিকে সুস্থ হয়ে বাঁচতে হলে, মাটির স্বাস্থ্যের কথাও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
আরও পড়ুন-কৈলাশ মিশ্রর নেতৃত্বে ইস্টার্ন রেলওয়ে তৃণমূল মেন্স কংগ্রেসে যোগদানপর্ব
মাটিরও দেহ-মন ভাল নেই
বিশ্বায়নের নামে আজ পৃথিবীর একটি বৃহৎ অংশের বসবাসযোগ্য মাটিকে ঢেকে ফেলা হয়েছে কংক্রিটের চাদরে, মাটির শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। নিজেদের স্বার্থে আমরা নানাক্ষেত্রে যেসব রাসায়নিক পদার্থ অতিরিক্ত ব্যবহার করছি, তার ফলে ভিতরে ভিতরে মাটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পুড়ে ঘা হয়ে গেছে। মাটির উপর সাধের বনানী কেটে ফেললে সেই আর্তনাদ শুনতে পাই না!
মাটি আজকে মারাত্মক ভাবে দূষিত, মাটির শরীর খারাপ! অত্যাচারের শিকার মাটির কার্বন তথা কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধারণ ও ত্যাগ করার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, মধ্যস্থিত গলিত মৃত জীবদেহ বা হিউমাস স্তর কমছে। এ ছাড়াও মাটির মধ্যে উপস্থিত খনিজের সাম্য এবং প্রাকৃতিক জীবাণুগত কার্যকলাপের তারতম্য দেখা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্যি যে, আজকাল মাটি এই পৃথিবীপৃষ্ঠের সামগ্রিক জীবজগতের সুরক্ষাকবচ নেই। এর জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই।
শরীর খারাপের কারণ
পৃথিবীর বুকে মানবজাতি তথা সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি উপাদানের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা আমাদের অন্যতম কর্তব্য। দৈনন্দিন জীবনে কৃষিকাজে একটু ভাল ফলন পেতে বিভিন্ন আগাছানাশক, অর্গানোফসফেট, ক্লোরিন যুক্ত হাইড্রোকার্বন ও পাইরেথ্রামের মতো পতঙ্গনাশক, এবং পারদ-সংবলিত রাসায়নিক পদার্থ, থিওকার্বামেটস ও কপার সালফেটের মতো ছত্রাকনাশক ব্যবহার করি, তার ফলে মারাত্মকভাবে মাটি দূষিত হয়। খননকার্য, উন্নত প্রাযুক্তিক চাষাবাদ থেকে সৃষ্ট বর্জ্য, চিকিৎসাগত এবং বৈদ্যুতিক বর্জ্যের ফলে মাটিতে মেশে আর্সেনিক, দস্তা, সীসা, পারদ, অ্যান্টিমনি, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, সেলেনিয়াম, তামার ইত্যাদির মতো বিষাক্ত ভারী ধাতু। রাসায়নিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাটির সামগ্রিক গঠন। যানবাহন, মাটির নিচে ও উপরে কয়লা প্রক্রিয়াকরণের সময় নির্গত ধোঁয়া, এবং শিলা নিঃসৃত তেলের মধ্যে উপস্থিত ন্যাপথালিন, অ্যানথ্রাসিন, ফেনালিন প্রভৃতি পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন অতিরিক্ত মাত্রায় মাটি দূষণ ঘটায়। এছাড়াও কলকারখানা থেকে নির্গত ডাই-অক্সিনস, ক্লোরিন যুক্ত বর্জ্য, প্লাস্টিসিজারস এবং বাইফিনাইলস মাটি দূষণের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
এখানেই শেষ নয়, নিবিড়ভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণে, বড় বড় বিল্ডিং ভেঙে ফেলা এবং নতুন করে তৈরি করার সময় মারাত্মক রকমের ভারী দূষক মাটিতে মেশে, যা মাটির সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক পরিবেশের প্রচুর ক্ষতি করে। তার উপর রয়েছে অসংরক্ষিত ‘ড্রেনেজ’ কিংবা ‘সিউয়েজ’ প্রক্রিয়া এবং পেট্রোল ও ডিজেলের স্পাইলেজ, যা মাটিকে ব্যাপক মাত্রায় দূষিত করে। এছাড়া হয় আরও নানান মারাত্মক ধরনের দূষণ।
আরও পড়ুন-বৃষ্টিতে পণ্ড প্রথম দিন, আজ ৫০ ওভারের ম্যাচ
আমাদের ভোগান্তিরও শেষ নেই
মাটির স্বাস্থ্যসংকট মানেই সমগ্র জীবকুলের সংকট। প্রকৃতিতে যেসব দূষক মাটি দূষণ ঘটায় তারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সরাসরি আক্রমণ করে, এই যেমন মাটিতে বেঞ্জিনের উপস্থিতি অতিরিক্ত হলে সেই মাটির সংস্পর্শে ব্লাড ক্যানসার হয়, মাটিতে উপস্থিত সীসা কিংবা পারদ স্নায়ুতন্ত্রকে বিকলাঙ্গ করে দেয়, কিডনি ও লিভারের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও আসে মাথাব্যথা, বমি, কাশি, অ্যালার্জি, বুকে ব্যথা, হাঁপানি, চর্মরোগ, চোখের সমস্যা, ক্লান্তি, দুর্বলতা ও আরও নানা দুর্ভোগ!
তবে এর চেয়েও বড় সমস্যা হল খাদ্যসংকট! মাটি এই পৃথিবীর সকল জীবের আহার সুনিশ্চিত করে। গবেষকদের ধারণা, আগামিদিনে মাটি দূষণেই দেখা দেবে খাদ্যসংকট, মহামারী। ইতিমধ্যেই মাটি দূষণের কারণে পৃথিবীর নানা দেশে অপুষ্টির মতো পাপ সভ্যতাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
মাটির স্বরূপ
নানারকম খনিজ, গ্যাসীয় পদার্থ, জৈবিক বস্তু, তরল এবং আণুবীক্ষণিক জীববস্তু-সহ বালি, পলি, ও কাদার যে উর্বর চাদর পৃথিবীপৃষ্ঠকে ঢেকে রেখেছে তাই হল মাটি। মাটি কঠিন, তরল এবং গ্যাসের একটি পূর্ণ মিশ্রণ— এর মধ্যে ২৫% জল, ২৫% গ্যাস, এবং ৫০% কঠিন রয়েছে, কঠিনের মধ্যে ৫% জৈব পদার্থ এবং ৪৫% খনিজ, খনিজ পদার্থ বলতে ১৮% বালি, ১৮% পলি, ও ৯% কাদা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট এলাকার পরিবেশ, জলবায়ু, জীবনধারণের উপর সেই স্থানের মাটির গঠন এবং প্রকৃতি নির্ভর করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর সামান্য অংশের মাটিই বরফের যুগ বা প্লেইস্টোসিনের চেয়ে প্রাচীন; তবে এই মাটি সেনোজোয়িক অর্থাৎ পৃথিবীর বর্তমান ভূতাত্ত্বিক সময়কালের চেয়ে পুরনো নয়, অতএব এই মাটি বিগত ৬৬ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যাই হোক, জীবাশ্মের মধ্যে পাওয়া মাটি কিন্তু সেই ৪০৩১-২৫০০ মিলিয়ন বছর আগেকার।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বিজ্ঞানী ড. ভাসিলি দোকুচায়েভ প্রথম গঠন, জলধারণ ক্ষমতা ও বায়ু চলাচলের তারতম্যের ভিত্তিতে মাটির শ্রেণিবিন্যাস করেন, কিন্তু ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমেরিকা ও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা তা নানাভাবে পরিবর্তন করেন। মাটির গঠন ও প্রকৃতির উপর বিচার করে আমেরিকার ‘এগ্রিকালচার সয়েল ট্যাক্সনমি’ বিভাগ সারা বিশ্বের মাটিকে ১২টি ভাগে ভাগ করে; তবে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ বিভিন্ন স্থানভেদে ভারতবর্ষের মাটিকে আটটি ভাগে ভাগ করেছে। যথা— পলিমাটি (৪০%), রেগুর বা কৃষ্ণমাটি (১৫%), লাল ও হলুদমাটি (১৮.৫%), ল্যাটেরাইট মাটি (৩.৭%), পার্বত্য/বনভূমির মাটি, মরুভূমির শুষ্কমাটি (৪.৪২%), লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটি, এবং জলাভূমির সিক্ত মাটি।
আরও পড়ুন-ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদে রানি রাসমণিতে জনস্রোত
জীবনে মাটির রসায়ন ও আমাদের করণীয়
মাটির মধ্যে উপস্থিত নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, তামা, বোরন, মলিবডেনাম প্রভৃতি পরিপোষক খনিজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি, সালোকসংশ্লেষণে সহায়তা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, বর্ণনির্ধারণ ও এমনকী উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের জন্য অপরিহার্য অ্যামাইনো প্রোটিনেরও জোগান দেয়। জলের সঞ্চয়, জোগান এবং বিশুদ্ধকরণের সঙ্গে সঙ্গে মাটি অক্সিজেনের জোগান দেয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বনচক্র নিয়ামক এই মাটিই। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাসা এই মাটি পৃথিবীর জিনগত বৈচিত্র্যের তত্ত্বাবধায়ক।
বর্তমান সময়ে অত্যাধুনিকতার অছিলায় আমাদের নানা অপকর্মের খেসারত হিসেবে মাটির যে ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক পরিবর্তন হচ্ছে, তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামগ্রিক পরিবেশগত বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। এই পরিবর্তনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, ওজনস্তরে সমস্যা, তৃণভূমির ধ্বংসসাধন, জলদূষণ প্রভৃতি মারাত্মক আকার নিয়েছে। মাটির মধ্যে উপস্থিত রাসায়নিকের সঙ্গে অন্যান্য উপাদানের আন্তঃক্রিয়া পরিস্থিতি অনুরূপ দ্রুত বদলে যাচ্ছে, ফলস্বরূপ মাটির রাসায়নিক ধর্ম পরিবর্তিত হচ্ছে; জমিতে কোনও সার ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যাবে, কোনও জমির লবণাক্ততা বেশি, জলসেচের ব্যবস্থা কীভাবে করলে ভাল ফল পাওয়া যায় তা এই রসায়ন জানান দেয়। এখন এই রসায়নও বিঘ্নিত।
এইসব বিপত্তি দূর করতে বৈজ্ঞানিক মহল জোর দিয়েছেন মাটির নিবিড় অধ্যয়নে। পরিবেশ দূষণ ও ভূমিক্ষয় রোধ, বনসৃজন, দূষিত মাটিকে দূরে কোথাও পরিত্যক্ত জায়গায় স্থানান্তরণ, প্রয়োজনে নির্দিষ্ট জায়গার তাপমাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দূষকগুলোকে বাষ্পীভূত করে মাটি পরিশুদ্ধকরণ, মাইক্রো-অর্গানিজম ও বিশেষ ধরনের ছত্রাক ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ধাতব দূষক একত্রিত করে দূরীকরণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।