বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অশান্তির ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে যারপরনাই উদ্বিগ্ন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভায় কেন্দ্রের কাছে অবিলম্বে জরুরি পদক্ষেপ করার আবেদন করেছেন তিনি। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিদেশমন্ত্রক যাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে কথা বলে অশান্ত বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠায় সেই অনুরোধও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অদ্ভুতভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র বাংলাদেশের মতো সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটেছে। যার মধ্যে নিশ্চিতভাবে রাজনীতি দেখছে ওয়াকিবহাল মহল। তাঁদের বক্তব্য, ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে বাংলাদেশ ইস্যু জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চাইছে বিজেপি।
এখানেই দিল্লির সরকারের সঙ্গে তফাত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাংলা তাঁর মন-প্রাণ। দেশ তাঁর আত্মা।
আরও পড়ুন-ধনকড় এখনও রাজ্যসভা পরিচালনা করছেন কেন? নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তৃণমূলের
হতে পারে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সমগ্র বাংলার কথা ভাবেন তিনি। স্বভাবতই, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত। কাঁটাতারের কোনও সীমা-পরিসীমা এই উদ্বেগে বাধ সাধতে পারে না।
রাজনৈতিক জীবনের একেবারে গোড়া থেকেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের পাশে থাকা তাঁর স্বভাব। ভারতবর্ষের ভিত্তি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে বিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী।
অযোধ্যায় যখন ঐতিহাসিক ধর্মীয় সৌধ বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় একদল ধর্মোন্মাদ তখন টানা কয়েকদিন কলকাতার রাস্তায় থেকে সব সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ছুটে গিয়েছিলেন উত্তেজনাপ্রবণ অঞ্চলে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছিলেন এই সঙ্কটকালে রাজ্য সরকারকে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত তিনি এবং তাঁর দল।
রেড রোডে ইদের নামাজ থেকে, বড়দিনে চার্চের প্রেয়ার, গুরু নানকের জন্মদিনে গুরুদ্বারে প্রার্থনা, গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন পালন, ছট পুজো উপলক্ষে গঙ্গার ঘাটে স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়েছেন তিনি রাজ্যের প্রত্যেকটি মানুষের প্রতিনিধি। দুর্গাপুজো উদ্বোধন থেকে নিজের বাড়ির কালীপুজোয় অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য ভোগ রান্না— সবেতেই তিনি নিখাদ বাংলার ঘরের মেয়ে।
বাংলাদেশ যতই বিদেশি রাষ্ট্র হোক না কেন, ওপার বাংলার ভাষা থেকে সাহিত্যসংস্কৃতি, খাদ্যখানা সবেতেই যে এপারের সঙ্গে বেজায় মিল! সীমান্ত তো ভৌগোলিক দিক থেকে। মনের মিলমিশে কোনও আড়াআড়ি লক্ষ্মণরেখা টানা যে অসম্ভব। পদ্মার ইলিশের জন্য এখনও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে পশ্চিমবঙ্গের ভোজনরসিক বাঙালি। বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগানের জন্য এ বাংলার দিকে তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন-দিল্লিতে বসে জ্ঞান বিতরণ নয়, মাঠে নেমে কাজ করেছেন তৃণমূল সাংসদরা
এমতাবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। আর ততটাই অস্বাভাবিক বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকারের এই স্পিক টু নট থাকা। এই প্রসঙ্গে একটা তুলনাও আসছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সক্রিয় ভূমিকাই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠাকে ত্বরান্বিত করেছিল। পাকিস্তান এবং তার পিছনে থাকা প্রবল শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমানতালে লড়ে পাক শক্তিকে কার্যত পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল ইন্দিরার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ভারত সরকার। আর বাংলাদেশ নিয়ে এই সময়ে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকারের নীরবতা ততোধিক আশ্চর্যজনক। জাতি-দাঙ্গা দীর্ণ মণিপুর নিয়েও যেমন মৌনী মোদিজি। একবারও সময় করে উঠতে পারেননি উপদ্রুত মণিপুর যেতে। তাঁর যত আগ্রহ দেশ-বিদেশ ঘুরে আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম যেন তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সেজন্য আজও দেশের নেতা হয়ে উঠতে পারলেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক ততটাই জননেত্রী। তামাম ভারতের নেত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের সিদ্ধান্তই মেনে চলবে পশ্চিমবঙ্গ। দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। কিন্তু, একইসঙ্গে ক্ষমতাসীন মোদী সরকারের নীরব থাকার চেয়েও অত্যন্ত বৈসাদৃশ্য লাগছে এ রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতা তথাকথিত ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকা। শুভেন্দু যেন একাধারে ‘র’ থেকে বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা দফতর সব সামলাচ্ছেন। অন্তত প্রতিনিয়ত তাঁর ‘ভারসাম্যহীন’ বক্তৃতা এই কথাই স্পষ্ট করছে। ভারত সরকারের এককাঠি নয় বেশ কয়েককাঠি ওপরে অবস্থান করছেন। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য সরব হচ্ছেন, স্থিতাবস্থা ফেরানোর আবেদন জানাচ্ছেন, শান্তির বার্তা দিচ্ছেন তখন শুভেন্দুর বক্তব্য ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। সঙ্গে ফেক নিউজের বন্যা বয়ে যাচ্ছে বিজেপির আইটি সেল মারফত। শান্তি তো দূরস্থান এতে অশান্তির পারদ আরও চড়ছে। অবশ্য বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব খুব সম্ভবত শুভেন্দু অধিকারীর এই নেতিবাচক ভূমিকাকে তলে তলে সমর্থন জোগাচ্ছে। ধর্ম নিয়ে মানুষে মানুষে লড়িয়ে দেওয়া তো বিজেপির পুরনো খেলা। আর সেই খেলাটা বাংলাদেশে খেলছে বিএনপি, জামাতের মতো মৌলবাদী দল। গোবলয়ের সংকীর্ণ সংস্কৃতি গোয়েবলসীয় কায়দায় বাংলায় চাপিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দিন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, শরৎ, মাইকেল মধুসূদন দত্তর ভাষা আমরি বাংলা ভাষা। এই বাংলার সঙ্গে বিদ্বেষ বড় বেমানান।
বাংলা লালিত পালিত হয় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘যত মত তত পথ’-এর আদর্শে। চৈতন্যদেবের সাম্যবাদের পথ আর লালন ফকিরের মানবতার রাস্তা কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার। বাংলা ভাষা কোনওদিন ধর্মের দেওয়াল মানে না। বাংলাদেশ গঠনের ইতিহাসটাই তো সেই ভাষার লড়াইকে কেন্দ্র করে। উর্দু ভাষার দমনপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের গর্বের বাংলা ভাষা। ২১ ফেব্রুয়ারির বলিদান ব্যর্থ হয়নি। হাজারো হাজারো রক্তের বিনিময়ে বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। তাই ধর্মের শিখণ্ডী খাড়া করে যারা বিভাজনের কথা বলে বাংলা তাদের গো-হারান হারায়।
আরও পড়ুন-বিজেপি নেতাকে মেরে ঝুলিয়ে দিল মাওবাদীরা
এই বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস এভাবেই বারংবার ভোকাট্টা করছে বিজেপি নামক বিভেদকামী শক্তিকে। ওপার বাংলাতে বিভেদকামী শক্তি হয়তো সাময়িকভাবে ক্ষমতার পরিসর দখল করেছে। কিন্তু সেই দখলনামা কিছুতেই স্থায়িত্ব পাবে না। আপাতভাবে মুষ্টিমেয় কিছু ধর্মোন্মাদ সেখানে হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেও উদারচেতা বাঙালি অচিরেই রুখে দাঁড়াবে, এদের পিছু হঠতে বাধ্য করবে। নব্য পাকিস্তান গড়ার অপচেষ্টা কোনওভাবেই সাফল্যের মুখ দেখবে না।