বাস্তব পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে একটা কথা পরিষ্কার, তৃণমূল কংগ্রেসকে সরিয়ে রেখে বিরোধী জোট গঠন সম্ভব নয়। এটাও স্পষ্ট যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব অস্বীকার করে এই জোট গঠনও সম্ভব নয়। মোদি বিরোধী সংহত শক্তির অনিবার্য নেতৃত্ব জননেত্রীর হাতে। লিখছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে ওপেন করার দৌড়ে পূজারাও
বিজেপি বিরোধী জোট যদি সময়ের দাবি হয়, তবে সে জোটের মুখ যে তৃণমূল কংগ্রেস এবং দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্যটিতে তৃণমূল কংগ্রেস সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিশালী দল। বিজেপি-র মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতার জন্য যে দলের সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আর নেতৃত্বদানের প্রশ্নে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোনও বিকল্প নেই, সে কথা আজ মানছেন দিল্লির অলিন্দের পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ বা আমলা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের মুখরাও।
আরও পড়ুন-৭ নম্বর ব্যালন ডি’অর অবিশ্বাস্য লাগছে মেসির
জনস্বার্থে তিনি যেসব প্রশাসনিক পদক্ষেপ করেছেন, তা গোটা দুনিয়ার কাছে রোল মডেল হিসেব স্বীকৃতি পাচ্ছে। তারই জেরে, সারাভারতে তৃণমূল কংগ্রেস একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে, ২০১৯-এও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার কিন্তু আগের তুলনায় বেশি ছিল। প্রশাসনিক সাফল্যের সঙ্গেই নেত্রীর ঝুলিতে আছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও তাতে জয়লাভের অভিজ্ঞতা। সুতরাং, বিজেপিকে রুখতে, আর যে কোনও বিষয়েই আলোচনার অবকাশ থাকুক না কেন, নেতৃত্বের জায়গা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
আরও পড়ুন-কিউয়ি ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন সানির
৫৪৩টি লোকসভা আসন বিশিষ্ট ভারত একটা সুবিশাল দেশ। সারা দেশের প্রতিনিধিত্ব এককভাবে করতে পারে, এরকম কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব এই মুহূর্তে অন্তত দেখা যাচ্ছে না। অথচ কেন্দ্রে এখন যে সরকার ক্ষমতাসীন, সেটি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সবচেয়ে বিপজ্জনক সরকার। সেই সরকারকে জনস্বার্থে উৎখাত করা প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন বিরোধী দলগুলির পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি। নিজেদের মধ্যে আরও বেশি করে আলাপ আলোচনা এবং পরস্পর পরস্পরের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা।
আরও পড়ুন-ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে
একমাত্র এই ভাবেই মোদি-শাহের কুশাসনের বিরোধী জোটের ২০২৪-এ সরকারে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। এই বিরোধী রসায়ণটা গড়ে তোলার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস উদ্যোগী ভূমিকা নিতে আগ্রহী। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবারের জন্যও বলেননি তিনি বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইতে ‘একলা চলো রে’ নীতির পক্ষপাতী। তিনি বার বার বলেছেন বিজেপি বিরোধী দলগুলোর জোটবদ্ধ হওয়ার কথা। তৃণমূল স্তর থেকে বিজেপি বিরোধিতার শক্তিকে মজবুত করার কথা। জননেত্রী চান এবং সঠিক অর্থেই চান, এই বিরোধী জোটে তৃণমূল কংগ্রেস অন্যান্য দলগুলির পরিপূরক হয়ে আপন ভূমিকা পালন করবে।
আরও পড়ুন-স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপ সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
এই বিরাট দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কিছু-না-কিছু কারণে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা আছে। তৃণমূল কংগ্রেসের যেমন আছে, তেমনই কংগ্রেসেরও আছে। মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে কংগ্রেস অন্য দলের লেজুড় হয়ে সরকারে আছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। অসম ও উত্তরপূর্ব ভারতে সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনগুলিতে কংগ্রেস একটি আসনেও জিততে পারেনি। মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকে কংগ্রেস সরকার গড়েও, নেতৃত্বের অযোগ্যতার জন্য তা ধরে রাখতে পারেনি।
আরও পড়ুন-এ মাসেই স্মার্ট ফোনে মিলবে মেট্রোর টিকিট
সরকার গড়ার পক্ষে সুবিধাজনক জায়গায় থাকা সত্ত্বেও গোয়া ও মণিপুরে কংগ্রেস শেষমেষ রণে ভঙ্গ দিয়েছে। বিজেপি-র কাছে কার্যত নতিস্বীকার করেছে। এই সার্বিক পরিস্থিতিতে, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বার বার বিরোধীদের জোট গড়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন, ক্ংগ্রেসের তরফে তা নিয়ে কোনও সদর্থক উদ্যোগ এখনও অবধি দেখা যাচ্ছে না। যে তৎপরতা দরকার ছিল বিরোধী জোট গড়ে তোলার জন্য তা কংগ্রেসের দীর্ঘসূত্রিতায় আটকা পড়ে যাচ্ছে। এই কারণই তৃণমূল কংগ্রেসকে বেশি তৎপর হতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-১৩১-এ রত্নাই ফোটাবেন জোড়াফুল
তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ্য স্থির। বিজেপি বিরোধিতায় ধারাবাহিকতায় কোনও ঘাটতি নেই। বাস্তব অবস্থা উপলব্ধির ব্যাপারেও কোনও খামতি নেই। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই যথার্থই বলেছেন, বিজেপি বিরোধিতায় কংগ্রেস যে জায়গাটা ছেড়ে দিচ্ছে সেই জায়গাটা পূরণ করার জন্য বার বার এগিয়ে আসতে হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। এটা ভুললেও চলবে না, বঙ্গে সিপিএম আর সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে কংগ্রেসের হঠকারিতার কারণে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র ভোট শতাংশ প্রায় ৪০-এ পৌঁছেছিল।
এরকম একটা অবস্থায়, কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিরোধী জোট গড়া সম্ভব নয়, এমন ভেবে কেউ যদি গোঁসা ঘরে খিল তুলে দেয়, তবে তার দায় তৃণমূল নেবে কেন? রাজ্যে রাজ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমীকরণ ও সামাজিক রসায়ণ মেনে আলাদা আলাদা কৌশলে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। এটাই সময়ের দাবি। সেই দাবির ডাকে সাড়া না দিয়ে কেউ যদি মুখ ফিরিয়ে থাকে, তবে তার দায় আমাদের দলের নয়। কেউ যদি বাংলায় যাদের সঙ্গে দোস্তি করে বিধানসভায় লড়েছে কেরলে তাদের সঙ্গেই কুস্তি করে, কেউ যদি বিহারের উপনির্বাচনে জোট সঙ্গীর বিরুদ্ধেই প্রার্থী দেয় আর তা যদি দোষের না হয়—বা বহুজন সমাজ পার্টি থেকে পাঁচ বিধায়ক হোন বা সিপিআই থেকে কানহাইয়া কুমার, তাঁদের যোগদানে যদি কোনও রাজনৈতিক দলের নীতি নৈতিকতা যদি ক্ষুণ্ণ না হয়; তাহলে গোয়া বা ত্রিপুরার মত বিজেপিশাসিত রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে অসুবিধা কোথায়? বিজেপি বিরোধী প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের উচিত নিজ নিজ শক্তি সামর্থ্য বাড়িয়ে, সংহত করে, আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য তৈরি হওয়া। সেটাই বরং হবে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন-ক্ষোভ-বিক্ষোভ ভাঙছে বিরোধীরা
দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাত বার লোকসভা নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়েছেন। তিনবার ভিন্ন ভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে জয়ের হ্যাটট্রিক করেছে। সুতরাং, সমমনস্ক, উদার মনোভাবাপন্ন, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জোটে তিনি সবচেয়ে বড় সম্পদ। রাজনৈতিক জীবনের ব্যাপ্তি, অভিজ্ঞতা ও সাফল্য- তিন মানদণ্ডেই এই মুহূর্তে দেশে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। বিজেপি বিরোধী জোটর মুখ হওয়ার সমস্ত যোগ্যতাই তাঁর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত– একথা অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই। তবু, তিনিই বার বার জোর গলায় বলছেন, বিরোধী জোটের নেতা কে হবেন, সেটা গৌণ বিষয়, আসল প্রয়োজন অবিলম্বে জোট গঠন।
আরও পড়ুন-পেগাসাস বিরোধিতা করায় ১২ সাংসদকে একতরফা বহিষ্কার
সেই আহ্বান বধির কর্ণে পতিত হোক আর তার সুযোগ গেরুয়া পার্টি নিক, এটা নিশ্চয়ই জনস্বার্থে তৃণমূল কংগ্রেস মেনে নিতে পারে না। স্বাধীনতা আন্দোলন হোক, বা পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন বা সংস্কার ও পরিবর্তন—বাংলা বারবার পথ দেখিয়েছে দেশকে। আজকের এই কঠিন পরিস্থিতিতেও, প্রয়োজনে বাংলাই ফের রাস্তা দেখাবে। তথাকথিত দিল্লির দল, তাতে যোগ দিক বা না দিক।