প্রতিবেদন : গতিপথ পরিবর্তন করছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ। আরও শক্তি বাড়িয়ে প্রথমে জাওয়াদের অভিমুখ থাকবে উত্তর-পশ্চিম দিকে। অন্ধ্র এবং ওড়িশা উপকূলের কাছে পৌঁছেই গতি পরিবর্তন করবে এটি। গতিপথ পরিবর্তন করলেও শনিবার থেকে বৃষ্টি শুরু হবে কলকাতা সহ দুই চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর ও উপকূলবর্তী এলাকায়।
ল্যান্ডফল: জাওয়াদের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখছে আবহাওয়া দফতর৷ ঠিক কখন জাওয়াদ আছড়ে পড়বে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। কেননা আচমকা আবারও যে এই ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ বদলাবে না, তা স্পষ্ট নয়। তাই এর প্রতি মূহুর্তে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে জাওয়াদকে।
কোন কোন জেলায় প্রভাব: রাজ্যের ১২ টি জেলায় কমবেশি জাওয়াদের প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে প্রভাব বেশি থাকবে। রবিবার ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে অতিভারী বৃষ্টিপাত হবে এই অঞ্চলগুলিতে। কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুরে ভারি থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হবে।তৈরি প্রশাসন: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখছেন। নবান্নয় মুখ্যসচিব-সহ বিভিন্ন দফতরের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। শুক্রবারও নবান্নে ১২টি জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদ্বী। বিপর্যয় মোকাবিলা দল সহ শুকনো খাবার, বেবি ফুড, ওষুধ সহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে মজুত রয়েছে এনডিআরএফের টিমও। স্থানীয় বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলেছে। এই মূহুর্তে গতিপথ: সকালে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে যাবে ওড়িশা উপকূল বরাবর। শুক্রবার বিকেলে আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, অতি গভীর নিম্নচাপ ইতিমধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে মধ্য বঙ্গোপসাগরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে উপকূলের দিকে। এবারে সৈকতে আছড়ে পড়ার পালা। কিন্তু ল্যান্ডফলিং ঠিক কখন হবে সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নয় আবাহাওয়া অফিস। শনি ও রবিবার তো বটেই সোমবার পর্যন্ত থাকবে জাওয়াদের প্রভাব। গন্তব্য: দুপুরে অথবা বিকেলে ঘূর্ণিঝড় পুরীর কাছাকাছি পৌঁছতে পারে বলে মনে করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তারপরে উপকূল ধরে এগিয়ে আসবে বাংলার দিকে। তবে তার আগেই এর প্রভাবে শনিবার পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা। উত্তাল হবে সমুদ্র। ঘন্টায় ৬৫ থেকে ৮০ কিমি হতে পারে বাতাসের গতিবেগ। কি হতে পারে: শনি এবং রবিবার দু’দিনই ঘনিয়ে আসতে পারে দুর্যোগ। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি। রবিবার মহানগরী এবং লাগোয়া অঞ্চলে বৃষ্টির ব্যাপকতা বৃদ্ধির প্রবল সম্ভাবনা। ঘন্টায় ৪০-৫০ কিমি বেগে বইতে পারে ঝড়। সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশ লাগোয়া জেলাগুলি-সহ দক্ষিণবঙ্গের জন্য রয়েছে সতর্কবার্তা। ট্রেন বাতিল: জাওয়াদের কারনে এখনও পর্যন্ত ৯৫টির বেশি ট্রেন বাতিল করেছে রেল। অন্ধ্র, ওড়িশা, কেরালায় যাওয়া সব ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে রেল।।
আরও পড়ুন : বিরাটের আউট নিয়ে তীব্র বিতর্ক
এদিকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের মোকাবিলায় প্রস্তুত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন। শুক্রবার বিকেল থেকে সুন্দরবনের উপকূলের মানুষকে নিরাপদস্থানে তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে প্রশাসন। তিরিশ হাজারের বেশি মানুষকে একশোর বেশি ফ্লাড শেল্টার বা স্কুলে তুলে নিয়ে যাবে প্রশাসন। কুড়িটি শিবির থেকে রান্না করা খাবার দেওয়া হবে। প্রতিটি শিবিরের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীরা মোতায়েন থাকবে। কোভিড বিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হবে। শুক্রবার দুপুরের পর জেলার আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে শুক্রবার গভীর রাত থেকে সুন্দরবন উপকূলে বৃষ্টি শুরুর সম্ভাবনা থাকছে। শনি ও রবিবার বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। রবিবার সকাল থেকে ঘন্টায় ৬০ থেকে ৭০ কিমি বেগে ঝোড়ো বাতাস বইবে। রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে অমাবস্যার কোটাল। কোটাল ও নিম্নচাপের জেরে চিন্তায় রেখেছে সুন্দরবনের বাঁধ এলাকার মানুষদের। সেচদপ্তরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকে খোলা হয়েছে কন্ট্রোলরুম। আগামী তিন দিন কন্ট্রোলরুম চালু থাকবে। প্রতিটি পঞ্চায়েতকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের সংলগ্ন অঞ্চলের উপর নিম্নচাপটি শুক্রবার গভীর নিম্নচাপ রূপে অবস্থান করছে। এদিন রাতে তা পরিণত হবে ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’-এ। শনিবার প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে তা অগ্রসর হবে অন্ধ, ওড়িশ্যা উপকূল হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে। যার জেরে ৪, ৫ ও ৬ তারিখ পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। ৬৫ থেকে ৮০ কিমি বেগে বইতে পারে ঝড়ো হাওয়া। ফলে সতর্ক দুই মেদিনীপুর-সহ ঝাড়গ্রাম জেলা প্রশাসন। শুক্রবারেই কলকাতা থেকে দিঘা উপকূলে এসে কাজ শুরু করে দিয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। ইতিমধ্যেই ৩ ডিসেম্বর থেকে টানা তিন দিন দিঘা-সহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ও উপকূলভাগে সমুদ্রস্নান এবং সমুদ্রের ধারে কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। শুক্রবার দিঘা-সহ উপকূল ভাগের সেই নিষেধাজ্ঞার কথা মাইকিং করে ঘোষণা করে এনডিআরএফ দল। ঝড়ের সময় কী করা উচিত এবং কী উচিত নয় সেই বিষয়গুলো এদিন ঘোষণা করে এনডিআরএফ দল। এদিন দিঘা সমুদ্র সৈকতে রীতিমতো টহল দেয় এই বাহিনী।ঝড় নিয়ে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন একপ্রস্থ বৈঠক করেছে। শুক্রবার ফের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সেচ, স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, পূর্ত, বিদ্যুৎবণ্টন, খাদ্য, বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা, ফরেস্ট ও দমকল প্রভৃতি দফতরের অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করেন জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার। সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিক ও কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : ভারতকে ম্যাচে ফেরালেন মায়াঙ্ক
জাওয়াদ মোকাবিলায় প্রস্তুত হাওড়া জেলা প্রশাসন। জেলার প্রতিটি ব্লকে খোলা হয়েছে একটি করে কণ্ট্রোল রুম। রবিবার পর্যন্ত সবসময় খোলা থাকবে এই কন্ট্রোল রুমগুলি। এ ছাড়াও জেলাশাসকের দফতরে একটি ইন্টিগ্রেটেড কন্ট্রোল রুমও চালু করা হয়েছে। সেখান থেকে সেচ, জল, বিদ্যুৎ, বিপর্যয় মোকাবিলা, দমকলের মতো দফতরগুলির সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। হাওড়া কর্পোরেশনের তরফ থেকেও আলাদাভাবে আরও একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও তৈরি। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ নিয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ দফতরের প্রস্তুতি নিয়ে বিদ্যুৎ ভবনে একটি বৈঠক করেন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডাব্লুবিএসইডিসিএল-এর সিএমডি শান্তনু বোস। মন্ত্রী জানান, শনিবার ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বিদ্যুৎ ভবনে একটি ২৪ ঘণ্টার কন্ট্রোল রুম খোলা হচ্ছে। এছাড়াও যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা হল— বিদ্যুৎ ভবনে কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকবেন ডিরেক্টর ডিস্ট্রিবিউশন ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিবিউশন। প্রত্যেকটি ব্লকে এবং জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের সঙ্গে বিদ্যুৎ দফতর রিজিওনাল ম্যানেজাররা সমন্বয় সাধন করবেন। কোনও জায়গায় জল জমে থাকলে সেখানে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ চালু করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পোল, কন্ডাক্টর কেবল এবং ট্রান্সফর্মার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে। নিম্নলিখিত ৯টি জেলা— উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, নদিয়া ও পূর্ব বর্ধমানে ব্লক ভিত্তিক কর্মীরা থাকবেন। জেলাশাসক, এসডিও ও বিডিওদের কাছে প্রত্যেকটি গ্যাং লিডার ও কর্মীদের নাম ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ভবনে ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ নম্বর দুটি হল ৮৯০০৭-৯৩৫০৩ ও ৮৯০০৭-৯৩৫০৪ কলকাতা পুরসভার ১ থেকে ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডে আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল থাকায় সেখানে থানাভিত্তিক গ্যাং থাকছে। ৮১ ও ৮৯ থেকে ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ডে ওয়ার্ড ভিত্তিক গ্যাং রাখা হবে। যাঁদের নাম ও ফোন নম্বর ওয়ার্ড কো-অর্ডিনেটরদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বজবজ, মহেশতলা, হাওড়া ও উত্তর ২৪ পরগনায়র সিইএসসির অধীন অঞ্চলে প্রতিটি থানায় গ্যাং থাকবে। সিইএসসির কন্ট্রোল রুমের নম্বর— ৯৮৩১০-৭৯৬৬৬ ও ৯৮৩১০-৮৩৭০০ ৪ ডিসেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
সোনালি পাকা ধানে মাঠ ভরা। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে বৃষ্টির আশঙ্কায় দিশেহারা ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহলের হাজার হাজার চাষি। জেলা জুড়ে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। কৃষি দফতর কৃষকদের সতর্ক করার জন্য মাঠে থাকা পাকা আমন ধান দ্রুত বাড়িতে তোলার নির্দেশ দিয়েছে। আলু ও সরষে চাষিদের এই তিন দিন কাজ বন্ধ রাখার আবেদন করেছে। সতর্কবার্তা পেয়ে পাকা আমনধান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশিরভাগ চাষি মেশিনে ধান কাটার কাজ শুরু করেছেন। এমনিতেই এ বছরে পরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে খরিফ মরশুমের ফসল বরবাদ হয়েছে। রবি মরশুমের গোড়াতেই ঝড়-বাদলের পূর্বাভাসে রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ পূর্ব বর্ধমানের কৃষকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কৃষকদের পাশে নানা সতর্কতা ও পরামর্শ নিয়ে হাজির হয়েছেন কৃষিকর্তারা। এমনিতেই দুর্যোগের কারণে ধান রোপণ হয়েছে দেরিতে। ফলে বহু জায়গায় ধান কাটা হয়নি। সবথেকে বেশি না-কাটা ধান মাঠে পড়ে রয়েছে মন্তেশ্বর ব্লকে। ঝড়-বৃষ্টি হলে কতটা ফসল ঘরে তোলা যাবে, সেটাই প্রশ্ন।