রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজ, দুই-ই যদি সচেতন না হয়,তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কিছুতেই প্রতিরোধ করা যাবে না। লিখছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য ড. গৌতম পাল
বর্তমানে অনিয়মিতভাবে ঘটা জলবায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনাবলি এবং আমাদের চারপাশে পরিবেশের অস্বাভাবিকতা নীরবে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের বাসভূমির জলবায়ু আর পূর্বের অবস্থায় নেই।
আরও পড়ুন-KMC 124: শোভনের সাহায্য ছাড়াই ওয়ার্ডে আমূল পরিবর্তন করেছেন রাজীব
শীত ও গ্রীষ্মকালের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বর্ষাকালের সূচনা এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেছে। গ্রীষ্মকালের সূচনা অনেক আগে হচ্ছে। উপকারী মধ্যমানের বৃষ্টিপাত কমে গেছে এবং অপকারী তীব্রমানের বৃষ্টিপাত বেড়ে গেছে। সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের সময় জুলাই- অগাস্ট থেকে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে পিছিয়ে গেছে। গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের হার ও তীব্রতা বেড়েছে। শীতকালে শৈতপ্রবাহ ও কুয়াশা সংঘটনের হার ও তীব্রতা কমেছে এবং অত্যন্ত অনিয়মিত হয়েছে।
সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় অনিয়মিতভাবে অত্যন্ত ঘনঘন হচ্ছে এবং ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে। গ্রীষ্মে কালবৈশাখী ঝড়ের ঘটমানতা হ্রাস পেয়েছে এবং তীব্রতা বেড়েছে। ঋতুবৈচিত্র্য প্রায় বিলীন হয়েছে। জলবায়ুগত বৈপরীত্যে ও ঋতুগত জলবায়ুর আসামঞ্জস্যতায় উদ্ভিদ ও পশুপাখির আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। আগে ঘটেনি এমন অচেনা ধরনের এবং লক্ষণ-সমন্বিত ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-KMC Election: পুরভোটের আগেই হার বিজেপির, দলীয় বৈঠকে স্বীকার করে নিলেন আইটি সেল প্রধান
IPCC-র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির নির্গমন প্রবণতা বর্তমান হারে বজায় থাকলে ২১ শতকের শেষে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার ২.৫ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উষ্ণায়ন ঘটছে বাতাসে মুখ্যত কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাসের ক্রমবর্ধমান নির্গমন এবং মাত্রাতিরিক্ত সঞ্চয়ের কারণে। বাতাস থেকে কার্বন শোষণ করে বাতাসে কার্বনের পরিমাণকে হ্রাস করতে পারে সমুদ্র ও অরণ্যের উদ্ভিদ। উষ্ণায়নের কারণে সামুদ্রিক জলে কার্বনের দ্রাব্যতা কমে যাওয়ায় সমুদ্র যথেষ্ট পরিমাণে কার্বনকে শোষণ করতে পারছে না। কৃষির জন্য জমি বাড়াতে, শহর পত্তন করতে বা শিল্প স্থাপন করতে বিশ্বব্যাপী বেলাগাম অরণ্য-নিধন চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার (ব্রাজিলের অ্যামাজোনিয়ান ফরেস্ট) চিরহরিৎ বৃষ্টি অরণ্য এবং উত্তর আমেরিকার (কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাংশের) উত্তুরে অরণ্য মনুষ্যকৃত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে (দাবানলের মাধ্যমে) ক্রমসঙ্কুচিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-পরিকল্পিত খুন বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশের এফআইআর,
ফলে, উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন বাতাস থেকে যথেষ্ট পরিমাণে শোষিত হতে পারছে না অরণ্যের মাধ্যমে। একদিকে বাতাসে কার্বনের নির্গমন বাড়ছে এবং অন্যদিকে বাতাস থেকে কার্বনের শোষণ কমে যাচ্ছে। ফলে, উষ্ণায়ন সৃষ্টিকারী কার্বনের ঘনত্ব বাতাসে ক্রমশ বাড়ছে (বর্তমান বাতাসে কার্বনের ঘনত্ব প্রায় ৪১২ পিপিএম হয়েছে)।
ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়নের জন্য দক্ষিণ এবং উত্তর মেরুর স্থায়ী হিমবাহ এবং পৃথিবীর পর্বতশৃঙ্গগুলিতে সঞ্চিত বরফ গলে যাচ্ছে। বরফের গলনের কারণে ও উষ্ণায়নজনিত সামুদ্রিক জলের প্রসারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে সমুদ্রতল বেড়েছে প্রায় ৩০ সেমি। আশঙ্কা, একুশ শতকের শেষে ন্যূনতম প্রায় এক মিটারের কাছাকাছি সমুদ্রতল বাড়বে। সুন্দরবন-সহ ১০ শতাংশ উপকূলবর্তী স্থলভূমি, লাক্ষাদ্বীপ, বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ নিচু স্থলভূমি, শ্রীলঙ্কার নিচু স্থলভূমি ও নিচু দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ও টুভালু একুশ শতকের শেষে সমুদ্রে বিলীন হবে। সামুদ্রিক জলের প্লাবনে চাষের জমি কমে যাওয়ায় খাদ্য-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং পানীয় জলের গুরুতর সমস্যা তৈরি হবে। বহু মানুষ বাসস্থান হারাবে ও জীববৈচিত্র্যের স্থায়ী বিনাশ ঘটবে। বিশেষ করে মৎস্যজীবী ও প্রান্তিক চাষীদের জীবন ও জীবিকা চরম সঙ্কটে পড়বে।
আরও পড়ুন-বিডিওর উদ্যোগ রুখা মাটিতে আম্রপালি, হিমসাগর
সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণায়নে ‘এল নিনো’ ঘনঘন সংঘটিত হবে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে বহু মানুষ খোলাওয়ালা মাছের মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে। ক্রান্তীয় পীড়া, যথা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রভৃতির পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা বাড়বে। সমুদ্রতল বেড়ে যাওয়ায় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণায়ন ঘটায় নিম্নচাপ বা ক্রান্তীয় সাইক্লোন ঘন ঘন তৈরি হবে, বিশেষ করে উত্তর ভারত মহাসাগরে। এই সাইক্লোনগুলি অধিকাংশই আঘাত হানবে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থলভূমিতে । অতি-বৃষ্টি বা ক্লাউড বার্স্টের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে বন্যা তৈরি হবে, স্থানীয় উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ।এককথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্পদের ক্ষতি হবে এবং মানুষের জীবন ও জীবিকা চরম সঙ্কটে পড়বে।
আরও পড়ুন-অশ্বিন ও জয়ন্তর চার উইকেট, ৪৩ মিনিটেই শেষ কিউয়িদের প্রতিরোধ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বুঝতে পেরে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করার লক্ষ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নেতৃত্বে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোট ২৬টি জলবায়ু সম্মেলন বা কনফারেন্স অব পার্টিস (COP বা কপ) আন্তর্জাতিক স্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাজের কাজ হয়নি কিছুই। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জলবায়ু সম্মেলনে প্রণীত আইনানুগ ‘কিয়োটা চুক্তি’ পরিত্যক্ত হয়েছে। ২০১৫ সালে ২১তম জলবায়ু সম্মেলনে আইনানুগ ‘প্যারিস চুক্তি’ প্রণীত হয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত করা যাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-সম্প্রীতি নষ্ট! ‘রাম কে নাম’,ছবি প্রদর্শন বন্ধের নির্দেশ
সুতরাং উষ্ণায়ন কেবল ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত আগামী দিনে বাড়ানো যাবে। এ যদি করতে হয়, তা হলে কোনও দেশই আর গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করতে পারবে না। সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রগতি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কার্যত প্যারিস চুক্তি অনর্থক হতে যাচ্ছে। ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে (১-১৩ নভেম্বর) মুখরক্ষার জন্য শুধু কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেমন অরণ্যের বিস্তার ঘটানো, তাপ বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা কমানো ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, অবতরণ-ক্রম অনুযায়ী বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিমাণ কার্বন নির্গমনকারী পাঁচটি দেশ হলে যথাক্রমে— চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ভারত, রাশিয়া ও জাপান। যদিও জনপ্রতি বাৎসরিক নির্গমন চিন ও ভারতের অনেক কম। জনপ্রতি নির্গমনে বিশ্বে চিনের অবস্থান ৪৭তম এবং ভারতের স্থান ১০০ ক্রমাঙ্কের কাছাকাছি । তথাপি ভাবী প্রজন্মকে সুস্থ পরিবেশ উপহার দিতে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলির সঙ্গে চিন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি বিকাশশীল দেশগুলিকেও কার্বন নির্গমন হ্রাসে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরও পড়ুন-ডঃ বি আর আম্বেদকরের মৃত্যুদিনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
এজন্য সর্বাগ্রে চাই নাগরিকদের সচেতনতা। নাগিরকদের পুনর্ব্যবহারযোগ্য বস্তু বেশি ব্যবহার করতে হবে, ব্যক্তিগত মোটরযানের ব্যবহার কমাতে হবে, সর্বজনীন পরিবহণ মাধ্যম-এর (যথা বাস, ট্রেন, মেট্রো) ব্যবহার বাড়াতে হবে, সাইকেল বা রিক্সার মতো জ্বালানিবিহীন যানের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং বিদ্যুতের অপচয় কমাতে হবে । এর সঙ্গে অবশ্যই চাই রাষ্ট্রের যোগ্য নেতৃত্ব ও সদিচ্ছা। নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে অরণ্য ধ্বংস বন্ধ করতে হবে, তাপবিদ্যুতের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির (সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ইত্যাদি) ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব না হলেও নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলে ও রাষ্ট্রের বিধিগত নিয়ন্ত্রণ থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে শ্লথ করা যাবে।