আজ এক যুগপুরুষের আবির্ভাব তিথি

মধ্যযুগীয় রাঢ় বঙ্গভূমির ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাহানা নাগ চৌধুরী

Must read

শতনামে বিকশিত শ্রীচৈতন্যদেব (Chaitanya Mahaprabhu) ছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী চৈতন্যদেব শৈশব থেকেই ছিলেন প্রখর মেধাবী,তার্কিক এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান। জগন্নাথ মিশ্র এবং শচীমাতার কনিষ্ঠ পুত্রটির শৈশবের নানারকম কার্যকলাপ বুঝিয়ে দেয় যে পরবর্তীকালে এক মহাপুরুষরূপে তিনি আপামর বাঙালি সমাজে প্রতিভাত হবেন। তাঁর শৈশবের নাম ছিল বিশ্বম্ভর। তাঁর অগ্রজ সহোদর বিশ্বরূপ বিশ্বম্ভরের ৬-৭ বছরে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। এই ঘটনাটি জগন্নাথ মিশ্রের পরিবারে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকে। ওই শিশু বয়সেই নিমাইয়ের উপনয়ন হয়। পরে স্থানীয় গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার অধ্যয়ন করে ক্রমে অসাধারণ পাণ্ডিত্য লাভ করেন নিমাইচন্দ্র। এই পাণ্ডিত্যই তাঁকে নবদ্বীপের টোলে পরিচিত করে তোলে।

১৬ বছর বয়সে লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর বিবাহ ঘটে। ইতিমধ্যে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় অধ্যাপনার মাধ্যমে। এই কর্মসূত্রেই তিনি বিবাহের পর কিছুদিন নবদ্বীপের বাইরে যান। নবদ্বীপে ফিরে এসে শোনেন সদ্য বিবাহিত স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটেছে। এরপরেই লক্ষ্য করা যায় নিমাইচন্দ্রের ক্রমশই সংসারের প্রতি বৈরাগ্য বাড়ছে। এরপর পরিবার থেকে তাঁকে পুর্নবিবাহ দেওয়া হয় সুন্দরী বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে।
ইতিমধ্যে তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্রের মৃত্যু হয়েছে। পিতার পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে তিনি গয়ায় যান। সেখানেই তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে। ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ এই সাক্ষাৎকারের পরেই তাঁর জীবনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেন নিমাইচন্দ্রের পরিবার ও নবদ্বীপবাসী। ঈশ্বরপুরী তাঁকে গোপালমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। এই ঘটনা তাঁর জীবনে এক আলোড়ন তোলে। পরবর্তীকালে দেখা যায় নিমাইচন্দ্র নদীয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে এইটুকু গৌরচন্দ্রিকা করা বাহুল্য নয় বলেই মনে হয়।

শ্রীচৈতন্যদেবের পারিবারিক পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা উচিত। তিনি যেসময়ে জন্মগ্রহণ করেন (১৪৮৬-১৫৩৩) সেইসময় বাংলায় চলছিল মুসলিম শাসনকাল। তার আগেই বাংলায় স্বাধীন হিন্দু রাজাদের শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে। গৌড়বঙ্গ তখন সারা দেশের কাছে সংস্কৃতি, সাহিত্য, এমনকী ধর্মেও এক পীঠস্থান ছিল। এই প্রসঙ্গেই চলে আসে নবদ্বীপের নাম। বস্তুত এই নবদ্বীপেই ছিল বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেনেদের রাজত্ব। তাঁদের হাত ধরেই এই নবদ্বীপে চর্চা ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের, চর্চা ছিল ন্যায়শাস্ত্র বা বেদান্ত চর্চার। তাই নবদ্বীপে আসা-যাওয়া চলতেই থাকত দেশ-বিদেশের সব মহা পণ্ডিতদের। তখনও রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোনও আগ্রহ ছিল না। তবে ধর্মদ্বারা বিভাজিত হতে শুরু হয় এই সমাজটি। মুসলিম শাসকরা ক্রমশ কারণে-অকারণে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতে শুরু করে। শুরু হয় জাতপাত নিয়ে নানা ছুঁৎমার্গও।

চৈতন্যদেবের জন্মগ্রহণের প্রেক্ষাপটটি ছিল এইরকমই। চৈতন্যর সময় থেকেই হিন্দুদের উপর মুসলিম শাসকের অত্যাচার স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। এইসব তথ্য আমরা পাই চৈতন্যদেবকে ঘিরে যেসব সাহিত্য তখন গড়ে উঠেছিল সেইসব গ্রন্থ থেকে। এর মধ্যে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল উল্লেখযোগ্য।
জয়ানন্দের লেখা থেকে তখনকার নবদ্বীপ শহরের প্রকৃতরূপ বেরিয়ে আসে। মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে তখন হিন্দুরা জর্জরিত। শুধু তাই-ই নয়, তখন নিমাইচন্দ্র নবদ্বীপের টোলে ছাত্রদের বিদ্যাশিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁদের মুখ থেকেও তিনি জানতে পারছেন নবদ্বীপের সামাজিক সমস্যা কী ভয়ঙ্কর। নবদ্বীপ তখন বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে যেভাবে এক উৎকৃষ্ট স্থানে পৌঁছেছিল তাতে শাসক গোষ্ঠীর ধারণা হয়, পরবর্তীকালে সিংহাসনের দাবিদার এই হিন্দু পণ্ডিতমহল থেকেই হতে পারে। ফলে তাদের অত্যাচারে ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ সবারই প্রাণের আশঙ্কা শুরু হল। এইরকম এক বিশৃঙ্খল সমাজে থেকেই তিনি নিজের ক্ষমতায় হয়ে উঠলেন এক সমাজ সংস্কারক।
সেটা কি একদিনে? তা তো নয়। তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণ্যসমাজের তীব্র লোকাচার থেকে বরাবরই তফাতে থাকতেন। আর থাকতেন বলেই তাঁর শৈশব ছিল দুষ্টামিতে ভরা। আবার সেই দুষ্টু বালক বিদ্যাশিক্ষার সময়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ন্যায়শাস্ত্র বুঝতে দেরি করতেন না। এই দুই বৈপরীত্য গুণের মধ্যে দিয়ে যে নিমাই সন্ন্যাসকে আমরা দেখি তিনি কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর।

আরও পড়ুন-কন্যাশ্রীর পর মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পও পেল বিশ্বসেরার স্বীকৃতি

ব্রাহ্মণত্বের ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছেই তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। সেই সময়ের অহংকারী বৈষ্ণব সমাজের গন্ডি পেরিয়ে নিমাই সন্ন্যাসী মিশে যাচ্ছেন সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে। দরিদ্র, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ জনের সঙ্গে বাড়ছে সখ্যতা, ভালবাসা। জাতিধর্মবর্ণ সর্বশ্রেণি নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে শুধুমাত্র কৃষ্ণ নাম দিয়ে যেভাবে একত্র করেছিলেন তা এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি এক উদার ধর্মের প্রবক্তা। চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধি দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কৃষ্ণপ্রেম এমনভাবে চারিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে কৃষ্ণকে মথুরা, বৃন্দাবনের সিংহাসনে দূরাগত দেবতার স্থানে উপবিষ্ট না রেখে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন সবার মনে। হরিনামে উতরোল হয়েছে তাঁর নবদ্বীপের ধূলিকণা। তাঁর আহ্বানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ জড়ো হয়েছিল। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক ছাতার তলায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন অগণিত মানুষ। চৈতন্য মহাপ্রভুর এই আহ্বান বিফলে যায়নি। তাঁর এই সহজ সরল, ধর্মবোধেই আকৃষ্ট হয়েছিল আপামর জনতা। চৈতন্য মহাপ্রভুর সাফল্য এখানেই।

ওই সময়ে গৌড়বঙ্গের সামাজিক, রাজনৈতিক যে অবস্থা ছিল, তাতে ধর্ম সংস্কারের বদলে তিনি যদি রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করতেন তাতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন মহামানব তাই সেই রাস্তাতেই হাঁটেননি বরং নিজেকে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁকে ঘিরে ভক্তদের যে উন্মাদনা সেই উন্মাদনার মধ্যেও এই বোধ কাজ করেছে যে তিনি সমাজের আপামর জনতার দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে পারতেন এবং তাঁর বাণীর মাধ্যমে তাঁর ভক্তদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করতেন। তাঁর এই অহিংস ভক্তি আন্দোলন তাঁকে বাংলা থেকে ওড়িশাতেও নিয়ে যায়। তিনি নবদ্বীপ ত্যাগ করে নীলাচলে থিতু হন।

আজকের দিনে এই শ্রীচৈতন্যদেবকে কি বড়ই প্রয়োজন মনে হয় না? ধর্ম মানুষের হৃদয়কে প্রসারিত করে। অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। এখন উদার, পরধর্মে সহিষ্ণুতা কি ভারতবর্ষে দেখা যাচ্ছে?
পরিশেষে বলি শ্রীচৈতন্যদেব বাঙালিদের মধ্যে এক বিরলতম ব্যক্তিত্ব যাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন বৈষ্ণব ধর্ম। তৈরি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারা, জন্ম নিয়েছে নতুন সংগীতের যার নাম কীর্তন। তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম সিংহাসনে আরূঢ দেবতাকে মাটিতে নামিয়ে আনেন, মিলিয়ে দেন আম জনতার মধ্যে। আপামর জনগণের দেবতা নিজের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষের মধ্যেই দেবতা থাকেন। দেবতার মধ্যে মানুষ। তাঁর এই উদার ধর্মনীতি চৈতন্যদেবকে আমাদের গোষ্ঠীভুক্ত না করে অনেক অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছেন। তাই তিনি যুগপুরুষ, তাই তিনি মহাপ্রভু।

Latest article