শারদোৎসব এখন আর শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, সংস্কৃতির মহামিলন। হয়ে উঠেছে সকলের উৎসব। তাই ইউনেস্কো কমিটির সম্মেলনে স্বীকৃতি পেল কলকাতার দুর্গাপুজো। লিখলেন অমর মিত্র
মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-ঝঞ্ঝা লেগেই আছে গত দুটি বছর। কলকাতা তার ভিতরেই উঠে দাঁড়িয়েছে বারবার। এই বছর শীত এসেও আসে না। বঙ্গোপসাগরের গভীরে সেই নিম্নচাপ, অকাল বর্ষণ মানুষের জীবনকে বিড়ম্বিত করে দিয়েও শান্ত হয় না। কলকাতার মানুষ তবুও প্রাণশক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শীতের ভিতরে, কুয়াশা, মেঘে ঢাকা আকাশে ভিতর এক বাতাস এল ভিনদেশ থেকে। সেই বাতাস উড়িয়ে দিল মেঘ, ফিরিয়ে আনল বর্ষা অবসানের নীল আকাশ, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে বকের পালকের মতো মেঘ। অকালে শরৎকাল ফিরে এল। ইউনেস্কো কলকাতার শরৎকালীন দুর্গোৎসবকে বহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।
আরও পড়ুন-Firhad Hakim: “টক টু মেয়র” এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, এবার লক্ষ্য আরও স্বচ্ছ প্রশাসন
১৫-ই ডিসেম্বর প্যারিসে আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষার ইউনেস্কো কমিটির সম্মেলনে স্বীকৃতি পেল কলকাতার দুর্গাপুজো। বিশ্বের নানা দেশের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ৪৫টি প্রস্তাবের ৩১টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে চিরকালীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিতর। আমাদের দুর্গোৎসব রয়েছে তার ভিতরে। সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের পরম্পরা এখন বিপন্ন। কোভিড এসে বড় আঘাত করেছে নানা উৎসব, সাংস্কৃতিক জীবনের প্রবহমানতায়। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে তার অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক জীবন নিয়েও। সেই বেঁচে থাকাকে সম্মান দিতে এই ঘোষণা।
আরও পড়ুন-নানা রূপে চির ভাস্বর
মানুষের মুখের হাসিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই ভাইরাস আক্রান্ত পৃথিবীতে। পৃথিবীর মানুষ চিরকালই যুদ্ধ বিগ্রহ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারী, অতিমারীর থেকে মুক্তি পেয়ে হেসেছে তার নিজস্ব উৎসবে শামিল হতে পেরে। গত দু’বছর কলকাতা কখনও ভয় পেয়ে গুটিয়ে থেকেছে, কখনও অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে পড়েছে মাতৃমুখ দর্শনে। দুর্গোৎসব শেষ অবধি বিশ্বজনীন হল, এই ঘোষণায় আনন্দ আছে শরতের সোনালি রোদ আর পালক মেঘ ভাসা আকাশের মতো।
আরও পড়ুন-কলকাতায় ১৩৫টার বেশি আসন পেয়ে জয়ী হবে তৃণমূল কংগ্রেস, আত্মবিশ্বাসী অভিষেক
কলকাতা তুমি পারলে। কলকাতা কেন, পশ্চিমবঙ্গ তুমি পারলে। কলকাতাবাসী তুমি পারলে প্রবহমান জীবনের উৎসবে শামিল হতে। আসলে বাঙালির জীবনে দেবী দুর্গা হলেন ঘরের মেয়ে। বৎসরান্তে স্বামী-সন্তান নিয়ে পিতৃগৃহে আসেন। যেমন হয়ে থাকে এই জীবনে। আরাধ্যা দেবী হয়েছেন আমাদের কন্যা। এর চেয়ে বড় জীবনের উৎসব আর কী হতে পারে। পরিবার, সংসার সব মিলে গেছে উৎসবে।
আরও পড়ুন-কারও জন্য দল বিন্দুমাত্র কলুষিত হলে তাঁকে বহিষ্কার স্পষ্ট জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
একটি উৎসবের আরম্ভ হয় দিনক্ষণ দেখে। পঞ্জিকা পুঁথি মতে উৎসবের দিন ঠিক হয়। আসলে তা মানুষের মনে আসন পেতে বসে বর্ষা অবসানে। তখন প্রকৃতি বদলায়। প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে প্রবেশ করে কুহু দেয়, পুজো আসছে। কবে পুজো? কতদিন আর? দিন গুনতাম আমরা ভাইবোনেরা আমাদের বালকবেলায়, বালিকাবেলায়। এখন টেলিভিশন বলে দেয় আর কতদিন মহালয়া, কতদিন বাকি মহাসপ্তমীর। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী। বিজয়া দশমী। বিজয়া দশমী হল মিষ্টান্নর উৎসব।
আরও পড়ুন-পুর প্রচারে প্রণবপুত্র অভিজিৎ বিজেপি পরাজিত দিদির রাজ্যে
সেদিন কলকাতার মিষ্টান্ন ভাণ্ডারগুলি অগণিত মিষ্টান্নে ভরা থাকে। কী তার সুগন্ধ, কী তার বাহার! সবই দুর্গোৎসবের অন্তর্গত। আমাদের এই দুর্গোৎসব শুধু ধর্মীয় আচার বিচারের উৎসব নয়। ছোটবেলা থেকে দেখছি দুর্গোৎসব গানের উৎসব, সাহিত্যের উৎসব, সিনেমার উৎসব, থিয়েটারের উৎসব। আর খাদ্যের উৎসব। মুখের হাসির উৎসব। নতুন বস্ত্রের উৎসব। আর তা শুরু হত উৎসবের মাস খানেক আগে থেকে। রেকর্ড কোম্পানির রেকর্ড বাজারে আসত।
আরও পড়ুন-কারও জন্য দল বিন্দুমাত্র কলুষিত হলে তাঁকে বহিষ্কার স্পষ্ট জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
পুজোর গানের বই বাজারে আসত। সেই বইয়ে গায়ক আর সুরকারের সঙ্গে গানের বাণী মুদ্রিত হত গীতিকারের নাম দিয়ে। গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আরও কত সব নাম। গানের বাণীতেই মুগ্ধ হত বাঙালি, ও পলাশ ও শিমুল, আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে…, ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে কত যে খেলা… উৎসবের আগেই আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে বাজতে আরম্ভ করত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় থেকে কত সব মহৎ আর অখ্যাত নতুন শিল্পীর কণ্ঠস্বর। আমরা অপেক্ষা করছি আকাশবাণী কবে ঘোষণা করবে দেবী আসছেন।
আরও পড়ুন-সব নদী মহাসমুদ্রে প্রচারে ঝড় তুললেন অভিষেক
পুরাণ আর শাস্ত্রীয় মতে পিতৃপক্ষ শেষ হল ভাদ্রের অমাবস্যায়। আশ্বিনের শুক্লপক্ষ শুরু হল। অমাবস্যার দিনে হিম নীলাভ উষাকালে ঘরে ঘরে বাজতে লাগল রেডিও। মহিষাসুরমর্দিনী গীতি আলেখ্য শুরু হল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর উদাত্ত কণ্ঠে শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠের ভিতর দিয়ে। গানে গানে ভরা এই মহিষাসুরমর্দিনী শিরোনামের গীতি আলেখ্য প্রথম বেজেছিল ১৯৩৭ সালের আশ্বিনের শুক্লপক্ষের সূচনায়। কৃষ্ণপক্ষের অবসানে। এই গীতি আলেখ্যই বেঁধে দেয় উৎসবের সুর। এটি রচনা করেছিলেন বাণী কুমার, সংগীত পরিচালনা পঙ্কজকুমার মল্লিক। গান আর শ্লোক পাঠে দুর্গোৎসবের সূচনা হল যেন।
আরও পড়ুন-Primary Education: প্রাথমিক শিক্ষায় ‘ভারত সেরা’ পশ্চিমবঙ্গ, মমতা সরকারকে স্বীকৃতি মোদি সরকারের
কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনী গীতি আলেখ্য কোনও ধর্মীয় আচার নয়। পুরাণ এবং মিথলোজি মিশ্রণে নির্মিত এক অনন্য অনুভূতিমালা। আমাদের দুর্গোৎসব যে সাহিত্যের উৎসব তা কে না জানে। এই সময় প্রতিটি পত্রিকা তার সাধ্যমতো সাহিত্য অর্ঘ নিয়ে বিশেষ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে। আমি দেখেছি কোনও কোনও শারদীয় সংখ্যা কেনার জন্য দীর্ঘ সারি। হকাররা অপেক্ষা করছেন কখন এসে পৌঁছয় পত্রিকা। বাণিজ্যিক এবং অবাণিজ্যিক, সব পত্রিকাই বিশেষ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে। পৃথিবীর কোনও শহরে উৎসব উপলক্ষে এত পত্রিকা প্রকাশিত হয় না। শারদোৎসব লেখনমালার উৎসবও।
আরও পড়ুন-বিজেপির ধরনামঞ্চে গোবরজল
এত পত্রিকা এই সময় কেনাবেচা হয়, তার কোনও হিসেব নেই। আগে উৎসবের দিনগুলিতে নতুন থিয়েটার, নতুন সিনেমা মুক্তি পেত। মনে পড়ে যাচ্ছে, মহাঅষ্টমীর দিনে গিরিশ মঞ্চে দেখেছি ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ নাটক। নান্দীকারের নাটকের উৎসব নতুন গড়ে ওঠা রঙ্গমঞ্চ রঙ্গনা থিয়েটারে। সিনেমার মুক্তি। হ্যাঁ, চিড়িয়াখানা মনে হয় পুজোয় মুক্তি পেয়েছিল। উত্তমকুমার- মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনীত শঙ্খবেলা, উত্তমকুমার- তনুজা অভিনীত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী…। কত আর তালিকা দেব। এসে গেছে দুর্গোৎসব। মধু বিধু দুই ভাই আনন্দে দু’হাত তুলে নাচে। নতুন বস্ত্র, কারওর বা সাটিনের জামা, কারওর ছিট কাপড়ের, দুয়েই এক আনন্দ। দর্জির দোকানে অর্ডার নেওয়া শেষ।
আরও পড়ুন-West Bengal Weather Update: আজ মরশুমের শীতলতম দিন
রাত জেগে তারা সেলাই করছে। বেশিরভাগ মুসলমান। এ কাজে তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারির প্যান্ডেল শুরু হয়ে গেছে। ঘরামিরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। ধর্মাধর্ম এখানে মানে কে ? হ্যাঁ, দুর্গা প্রতিমা নিয়ে কুমারটুলি আজ জগদ্বিখ্যাত। আমাদের বাল্যকালে রমেশ পাল ছিলেন শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পী। পরে মোহনবাঁশি রুদ্র পাল। তারপর তাঁর সন্তানরাও আছেন এই শিল্পে। আরও কত গুণী শিল্পী ক’দিনের জন্য নির্মাণ করেন অপরূপ প্রতিমা।
দুর্গোৎসব সর্বজনীন। বারোয়ারি পুজোর প্রধান সংগঠক হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান। কলকাতার পুজোয় যে বিপুল জনস্রোত হয়, সেই সব জনস্রোত সামলাতে পুলিশের সঙ্গে পাড়ার মানুষ হাত লাগান। আমাদের বেলগাছিয়ার ভিনধর্মের মানুষ মঞ্চ বেঁধে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেন সন্ধ্যায়। আমন কমিটি। উর্দু এবং বাংলায় মানুষকে সতর্ক করেই যান। শারদোৎসব এখন আর ধর্মীয় উৎসব নয়। ক্রমশ ধর্মের নিগড় মুক্ত হয়ে সকলের উৎসব হয়ে উঠেছে। তা যত হবে তত মঙ্গল। উৎসব যত আকর্ষণীয় করে তোলা হবে, ভিনদেশি পর্যটক আসবেন দেখতে। কলকাতা আরও বিশ্বজনীন হবে। উৎসবে কতরকম পরিকল্পনা হয় এখন। কতরকম থিম আর মণ্ডপসজ্জা।
আরও পড়ুন-Saugata Roy: বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে প্রশ্ন সৌগত রায়ের
তবে শব্দদূষণ থেকে যেন মুক্ত থাকে উৎসব তা যেন উদ্যোক্তারা মনে রাখেন। উল্লাস যেন আর্তনাদ না হয়ে ওঠে। আমার উৎসব নিভৃতে সাহিত্যপাঠ। স্মৃতিতে আছে কালীঘাটের সংঘশ্রীর অসামান্য আলোর বাহার। এখন আরও সুন্দর হয়েছে মণ্ডপ আর আলোকসজ্জা। কিন্তু সংঘশ্রী যে মাথা থেকে যায় না। থাকুক তা স্মৃতিতে। স্মৃতির কোনও প্রদর্শনী হয় না। হলে দেখিয়ে দেওয়া কীভাবে কীভাবে কলকাতার দুর্গোৎসব প্যারিসের দুর্গোৎসব হয়ে গেল। লন্ডন, প্যারিস, রোম, ভেনিসের মানুষ আসছেন উৎসব শেষে অপরূপ সব প্রতিমা নিয়ে কার্নিভালে। এই শহরই হয়ে উঠুক পরিচ্ছন্ন এক সত্যিকারের সুরুচির শহর। উৎসবের শহর।