তৃতীয় ঢেউয়ের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত সংক্রামক হলেও মারণাত্মক নয়। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এর পিছনে দুটি কারণ। এক, শরীর নিজের মতো করে এক প্রকার রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। দুই, পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা পুরসভা প্রথমদিকে ভ্যাকসিন কম পেলেও, সারা ভারতে সবকটি মেট্রো সিটির মধ্যে টিকাকরণে সব থেকে এগিয়ে ছিল তাই নয়, এখানে টিকার অপচয়ও সব থেকে কম হয়েছে। আর একথা বলেছে, কোউইন ড্যাশবোর্ডে ভারত সরকারের পোর্টাল।
নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে , যতগুলো কেস এখন ধরা পড়েছে, তার প্রায় তিন চতুর্থাংশ হচ্ছে ওমিক্রন। ওমিক্রনে যেহেতু শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা তুলনায় কম সেহেতু অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সতর্ক করছেন – ১শতাংশ মানুষেরও যদি অক্সিজেন সহায়তা দরকার হয় বা হাসপাতালে ভর্তির দরকার পরে, তা মারাত্মক হবে। কারণ ১৪০কোটি লোকসংখ্যার দেশে ১শতাংশ মানে দেড় কোটি মানুষ। যা মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব । সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কলকাতা পুরসভা কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে একাধিক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
১। টেস্টিং / পরীক্ষা
কলকাতা এবং পাশ্বর্বর্তী এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৮০০০ টেস্ট হচ্ছে যার অধিকাংশই করছে কলকাতা পুরসভা। প্রতিটি ওয়ার্ডে রেপিড টেস্ট হচ্ছে। ১৬টা বোরোর প্রতিটিতে বোরো ভিত্তিক RT-PCR টেস্ট হচ্ছে।
2 সেফ হাউস / নিরাপদ আশ্রয়
হাসপাতালে শয্যা থাকলেও রোগী ভর্তির প্রবণতা খুব কম। অর্থাৎ মৃদু উপসর্গ নিয়ে যারা আছেন তারা বাড়িতেই থাকছেন। তবে কলকাতা শহরে থাকলেও বেশিরভাগ মানুষই একটা কী দুটো ঘরে বসবাস করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে পরিবারে একজন সংক্রমিত হলেই তার দুদিন তিনদিনের মাথাতেই ওই একই পরিবারের অন্য সদস্যরাও সংক্রমিত হচ্ছেন। এই সব অসুবিধা মাথায় রেখেই কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম এবং ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের উদ্যোগে দুটি সেফ হাউস চালু হয়েছে। একটি গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে এবং অপরটি বাইপাসের ওপর প্রতিদিন ভাবনে। প্রায় পাঁচশোর মতো বেড আছে। তবে এখনও প্রয়োজন পড়েনি। প্রয়োজনে উত্তর কলকাতায় তিন নম্বর সেফ হাউসটিও খুলে দেওয়া হবে।
3. জনসংযোগ
পুরপ্রতিনিধিরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করছেন। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ওষুধের জোগান দিচ্ছেন। প্রয়োজনে মেডিক্যাল অফিসাররা রোগীর সঙ্গে টেলি মেডিসিনের মাধ্যমে, ভিডিও কনফারেনসিংয়ের মাধ্যমে পরিষেবা দিচ্ছেন।
৪. বিশেষ কোভিড পরীক্ষা এবং টিকাকরণ কেন্দ্র
হাইকোর্টের নির্দেশে গঙ্গাসাগর মেলা এবছর হচ্ছে। ফলে প্রতিবছরের মতো বাবুঘাটের কাছে এক বিরাট অংশের পূর্ণার্থীরা গঙ্গার ধারে ভিড় করতে শুরু করেছেন। সেখান থেকেও যাতে সংক্রমণ না ছড়ায় তার জন্য সেখানে স্যানেটাইজেশনের কাজ চলছে । পূর্ণার্থীদের যাদের দুটি ডোজ সম্পূর্ণ হয়নি তাদেরও টিকাকরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যাপকহারে রেপিড ও RTPCR দুই ধরনের টেস্টের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
৫. দ্রুত টিকাকরণ কর্মসূচি
এখন আমাদের লক্ষ ১৫ থেকে ১৮বছর বয়সিদের দ্রুত টিকাকরণ সম্পূর্ণ করা। কলকাতা পুরসভার মোট ১৬টি বোরো। আমরা প্রথমে প্রত্যেকটি বোরোতে একটি করে কেন্দ্র নির্বাচন করেছিলাম। এখন প্রায় প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বিভিন্ন স্কুলকে টিকাকরণ কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এবং আশপাশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের এর সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, আমার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে খানপুর গার্লস হাইস্কুলকে নির্বাচন করেছিলাম। এখানে ৫৭২ জন ছাত্রীকে টিকাকরণের লক্ষ রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি নাকতলা হাই স্কুল, মুকুলবোস স্কুল, আদর্শপল্লী স্কুল রয়েছে। এদেরও খানপুর গার্লস হাই স্কুলেই টিকাকরণ হচ্ছে। যেমন বিজয়গড়ে বিজয়গড় শিক্ষনিকেতন স্কুলের সঙ্গে বাঘাযতীন স্কুল, বিজয়গড় বিদ্যাপীঠ হতে পারে, গান্ধি কলোনি স্কুল হতে পারে এরকমভাবে অনেক স্কুলকে একসঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে যাতে ১৫-১৮ বছর বয়সিদের ১০০ শতাংশ টিকাকরণ সম্পূর্ণ করা যায় সেই লক্ষ্যেই কলকাতা পুরসভা এগোচ্ছে ।
৬. সতর্কতামূলক ডোজ
কলকাতা পুরসভা সতর্কতামূলক ডোজ দেওয়া শুরু করছে। যাদের বয়স ষাটোর্ধ, যাদের কোমর্বিডিটি আছে বা যারা স্বাস্থ্যপরিষেবা বা জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত, যাদের দুটি ডোজ নেওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, MCA গাইডলাইন অনুসারে, কলকাতা পুরসভা তাদের এই তৃতীয় ডোজ দেওয়া শুরু করছে।
ডাক্তারবাবুরা আশঙ্কা করছেন -জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই সংক্রমনের হার দ্রুতগতিতে চূড়ায় পৌঁছবে এবং ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে নিচে নামতে থাকবে।
কলকাতা যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, সেহেতু কলকাতার বিপুল জনসংখ্যা বাদেও বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ পেটের তাগিদে কলকাতায় আসেন ট্রেনে বাসে চড়ে। সেখানে যথাযথ দূরত্ববিধি মেনে চলা সম্ভব নয়। আবার লকডাউনও সম্ভব নয়। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবে। ফলে সরকারকে একটি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হচ্ছে। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও জননেত্রী হাল না ছেড়ে অভিভাবকের মতো বাংলার মানুষের পাশে আছেন। সুতরাং, আতঙ্ক নয়, সতর্ক থাকুন।
পরিশেষে, নাগরিক কবিয়ালের কথা ধার করেই সহনাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলব –
“ছেড়েছ তো অনেক কিছুই পুরনো অভ্যেস, /অসুখ বিসুখ হবার পরে জিলিপি সন্দেশ,/ছেড়েছ তো অনেক কিছুই পুরনো বোলচাল,/পুরনো ঘর, পুরনো ঘর, কুড়োনো জঞ্জাল,/ হাল ছেড়ো না…/ হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে,/ দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে।”