অধ্যাপক সুমিত মুখোপাধ্যায়:
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একনিষ্ঠ অনুগামীরূপে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তখন থেকেই জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সংহতির প্রশ্নটি তাঁর মনে জাগরূক ছিল। পরে যখন তিনি জাতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি অর্জন করলেন তখনও জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। কিন্তু তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্নকে তিনি বাস্তবরূপ দিতে সফল হননি। এর কারণ ভারতীয় রাজনীতির মধ্যে নানা পরস্পরবিরোধী শক্তির ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সুভাষচন্দ্রের কমর্মপ্রয়াসের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে তা শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে অতিক্রম করা সুভাষচন্দ্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। ১৯৪১ সালে মহানিষ্ক্রমণের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ এবং দূর প্রাচ্যের আপামর জনসাধারণের দ্বারা নেতাজি অভিধায় ভূষিত হবার পর সুভাষচন্দ্র সাম্প্রদায়িক বিভেদকে ধ্বংস করে আজাদ হিন্দ ফৌজকে ভারতাত্মার তীর্থভূমি করে তোলেন, যেখানে সকল ধর্ম ও ভাষাগত ব্যবধানের বেড়াজাল অতিক্রম করে এক মহাজাতীয়তার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। নেতা হিসাবে যা তিনি করতে পারেননি, নেতাজি হিসাবে তা পেরেছিলেন। সুভাষচন্দ্রের জনসম্মোহনশক্তি ছাড়াও এর প্রকৃত কারণ ছিল এই যে, এখানে সুভাষচন্দ্র দলীয় রাজনীতির নাগপাশ থেকে মুক্ত ছিলেন, ফলে তাঁর উপর কােনও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়নি।
আরও পড়ুন-বিজেপিতে ডামাডোল
সুভাষচন্দ্র যখন কংগ্রেসের সভাপতি তখন বন্দে মাতরমকে জাতীয় সংগীত রূপে গ্রহণ করার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং রবীন্দ্রনাথের মতানুসারে গানের প্রথম দুটি স্তবককেই ব্যবহার করা সাব্যস্ত হয়। ভারতে সুভাষচন্দ্রের প্রদত্ত ভাষণগুলির প্রায় প্রত্যেকটির উপসংহারে বন্দে মাতরম থাকত ও সেই সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীদের উল্লেখ অনুপস্থিত, সেই সঙ্গে বন্দে মাতরমকেও তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন সম্ভবত অভিজ্ঞতা স্মরণ করেই। বন্দে মাতরমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে একটি ধ্বনি বা মন্ত্র যা ভারতের চিরন্তন, শাশ্বত সত্তা ও মর্মবাণীকে বাঙময় করে তুলেছে। এই ধ্বনি হল জয় হিন্দ।
আরও পড়ুন-বিজেপিতে ডামাডোল
জয় হিন্দ এমনই একটি ধ্বনি যা রাজনৈতিক স্লোগানের চেয়ে অনেক উপরে অবস্থান করে। এর মধ্যে রাজনীতি শুধু নয়, সাম্প্রদায়িকতা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। এর ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে জার্মানির ইন্ডিয়ন লিজিয়নের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের দিনগুলিতে। সেই অবিস্মরণীয় সাবমেরিন যাত্রার সঙ্গী আবিদ হাসান সাফরানি জানিয়েছেন, ইন্ডিয়ান লিজিয়নের ট্রেনিং ক্যাম্পে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিজস্ব উপাসনার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু কিছুদিন বাদেই তাঁদের মধ্যে এমন ভ্রাতৃত্ববোধ সঞ্চারিত হল যে তাঁরা মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বারে বিভক্ত হয়ে উপাসনা করতে চাইলেন না। তাঁরা একটি সমবেত প্রার্থনা রচনা করলেন দুনিয়ার মালিকের উদ্দেশ্যে।
নেতাজি খুশি হওয়া দূরে থাক, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আবিদ হাসানকে বললেন, ‘এ-সব কী ননসেন্স শুরু করেছ? এই আন্দোলনের ভিত্তি হল জাতীয়তাবাদ, আর এর চরিত্র রাজনৈতিক। যদি তোমরা ধর্মের নামে কাউকে এক হতে বল তা হলে আবার ধর্মের নামে বিভেদ ডেকে আনাও সহজ হবে। আমাদের একতার মূল হচ্ছে, জাতীয়তাবাদ, আমরা সকলে ভারতীয়, সেই আমাদের পরিচয়। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের বিভিন্ন ধর্ম থাকতে পারে এবং সেই ধর্মাচরণের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সকলের থাকবে কিন্তু ধর্মের নামে একতার চেষ্টার এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, ওতে শুধু বিভেদের বীজ বপন করা হয়। প্রথমে একটু আঘাত পেলেও অচিরেই আবিদ হাসানের চক্ষুরুন্মীলন হয়। তাঁর দুই শিখ বন্ধুকে তিনি সৎশ্রী আকাল বলে অভিবাদন করতে থাকেন। একদিন তাঁদের একজন তাঁকে এভাবে অভিবাদন করতে বারণ করেন। আবিদ হাসান ব্যথিত হয়ে বলেন, আমি তো শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলি। উত্তর আসে, ‘তুমি অশ্রদ্ধা করবে কেন? কিন্তু আমার তো তা হলে তোমাকে সেলাম আলেকম বলা উচিত। কিন্তু ওটা আমার মুখ দিয়ে বার হবে না।’
আরও পড়ুন-স্মৃতি রক্ষায় লাল-হলুদের উদ্যোগ সুভাষের মূর্তি সংগ্রশালায়
এরপর আবিদ হাসান ‘জয় হিন্দ’ প্রস্তাব করেন এবার নেতাজিও অনুমোদন করেন তবে অনেকবার রিহার্সালের পর। এই ‘জয় হিন্দ’ অভিবাদনসূচক সম্ভাষণরূপে স্বীকৃতি পেলেও বৃহত্তর অর্থে তা ছিল বিবিধের মাঝে মহান মিলনের প্রতীক। ‘একম সদ্বিপ্রা বহুতা বদন্তি’, ঋকবেদের এই বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল তাঁর মধ্যে। কোনও ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়, কোনও ধর্মের আবাসভূমিও নয়। এমন ধর্মনিরপেক্ষ বাণী ইতিপূর্বে উচ্চারিত হয়নি। অন্নদাশঙ্কর রায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কোথাও সহমত না হয়েও তাঁর ‘দিল্লি চলো’ আহ্বানকে শব্দব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জয় হিন্দও এই শব্দব্রহ্মেরই প্রকাশ। নেতাজির সিক্রেট সার্ভিসের ক্যাপ্টেন বিপুল সরকার প্রবন্ধকারকে বলেছেন নেতাজি বলতেন, ‘ধর্মকে নিজের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে। ঘরের বাইরে তোমার প্রথম ও শেষ পরিচয় তুমি হিন্দুস্থানি। ধর্মকে কখনও তিনি রাজনীতির সঙ্গে মেশাননি কারণ, তাঁর জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ধর্ম নয় ধর্মনিরপেক্ষতা। এই বৃহত্তর মতাদর্শের সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র রচিত হয়েছিল। কমন কিচেন বা সর্বসাধারণের একত্রে আহারের ব্যবস্থা এখানে ছিল। ক্যাপ্টেন বিপুল সরকার ও সুশীল খাস্তগির প্রবন্ধকারকে বলেছেন, নেতাজি হালাল ও ঝটকার সমস্যার সমাধান করেছিলেন। ৯ জুলাই ১৯৪৪ রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ককে এক কোট টাকা দান করেন এক গুজরাতি মুসলমান যেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি। এই দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীকে নেতাজি সেবক-ই-হিন্দ মেডেল উপহার দেন। গুলাম হোসেন সুলতাখ রাণদেরি ছিলেন আরেক গুজরাটি মুসলমান যাঁকে নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের রিক্রুটিং অফিসার করেছিলেন।
আরও পড়ুন-ভালবাসার অলিন্দে : দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু
দক্ষিণ ভারতের বেটিয়ার সম্প্রদায়ের প্রধান পুরোহিত যখন নেতাজিকে দশেরা উৎসবের জন্য নিমন্ত্রণ করতে আসেন, নেতাজি তাঁকে বলেন, ‘যদি সব সম্প্রদায়ের মানষকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল তবেই আমি যাব।’ ভবতে অবাক লাগে রক্ষণশীলতার অচলায়তন ভেঙে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে ওই মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয়। আবিদ হাসান মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন এবং নেতাজির সঙ্গে তাঁর কপালেও পুরোহিত তিলক পরিয়ে দেন। তাঁর অবিস্মরণীয় ভাষণ নেতাজি এই বলে শুরু করেছিলেন, ‘আমরা প্রথমে ভারতীয়, তারপর অন্যসব সত্তা।’ এই জন্যই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সুভাষচন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে আজও প্রাসঙ্গিক মনে করেন। একটি প্রশ্ন মনে জাগে যে, আজন্ম শক্তিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সুভাষচন্দ্র কি বন্দে মাতরমকে চিরতরে বিসর্জন দিয়েছিলেন? আসলে আগে যা ছিল প্রকটিত, এবার তা প্রচ্ছন্নরূপে দেখা দিল ব্যক্তির জীবনে, সমষ্টি জীবনে নয়। সুভাষ সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মিশনের নির্ভৃত কক্ষে গভীর রাত্রে ধ্যান করতেন।
অমূল্যচরণ ভদ্রর সাক্ষ্য অনুযায়ী প্রবল বোমাবর্ষণের মধ্যে সুভাষ শ্যামাসংগীত গাইতেন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি মহাকালীর তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছেন কিন্তু প্রকাশ্যে ধর্মীয় প্রতীককে এড়িয়ে চলেছেন। ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি বন্দে মাতরমকেও যেন কিছুটা পিছনে ফেলে দিয়েছিল এ সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ‘যখন সম্পাদক ছিলাম গ্রন্থে’। ধর্ম যা করতে পারেনি ধর্মনিরপেক্ষতা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল এবং কবিগুরুর ভারততীর্থের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।