আইএএস/ আইপিএস-দের ক্যাডারবিধিতে সংশোধনী কতটা হানিকর তা নিয়ে কলম ধরলেন বিশিষ্ট আইনজীবী সঞ্জয় বসু
আজ সাধারণতন্ত্র দিবস। আজকের দিনে সংবিধান গৃহীত হয় ও কার্যকর হয়। আজ হল সেই দিন যে দিনে দেশটি সাধারণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল। তবে সংবিধানে যা বলা আছে আর সংবিধান প্রণেতাদের যা বক্তব্য তার থেকে সহস্র যোজন পার্থক্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মের।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার আইএএস/আইপিএস/আইএফএস ক্যাডার বিধি ৬(১) নং রুলে একটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাতে বলা হচ্ছে—
(১) সংশ্লিষ্ট সময়ে রাজ্যে যতজন স্টেট ক্যাডারের অফিসার আছেন তাঁদের মোট সংখ্যার সঙ্গে রাজ্য সরকারের কাজের জন্য কতজন অফিসার দরকার, সেই অনুপাতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেন্ট্রাল ডেপুটেশন রিজার্ভ (সিডিআর)-এর জন্য যতজন অফিসারকে দেওয়া যাবে, সেই সংখ্যক অফিসারকে সিডিআর-এর জন্য ছাড়তে তৈরি থাকবে রাজ্য। এটি ‘প্রস্তাব তালিকা’ বা অফার লিস্ট-এর আকারে প্রণয়ন করতে হবে।
(২) কতজন অফিসারকে ডেপুটেশনে পাঠানো হবে তার প্রকৃত সংখ্যাটি রাজ্যের তৈরি করা তালিকার ভিত্তিতে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে স্থির করবে কেন্দ্রীয় সরকার।
আরও পড়ুন-ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উদ্যোগ প্রাণিসম্পদ দফতরের
(৩) এ বিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে কোনও মতানৈক্য দেখা দিলে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই সিদ্ধান্তমাফিক কাজ করাটাই হবে রাজ্য সরকারের কাজ।
(৪) যদি রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পালনে ব্যর্থ হয় তবে ওই অফিসারদের রাজ্যের ক্যাডার থেকে মুক্ত বলে ধরে নেওয়া হবে।
(৫) সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যেখানে জনস্বার্থে ক্যাডার অফিসারদের পরিষেবা কেন্দ্রের আবশ্যক, সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে।
বর্তমানে ক্যাডার অফিসারদের কেন্দ্রে ডেপুটেশনে পাঠানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ঐকমত্যের যে ব্যবস্থা ছিল, সেটা এড়ানোর জন্যই যে এই প্রস্তাবিত সংশোধনী, তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই।
এটার প্রেক্ষাপটে রয়েছে দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা যেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আইপিএস (ক্যাডার) বিধি, ১৯৫৪-র রুল ৬ মোতাবেক তাদের অফিসারদের কেন্দ্রের ডেপুটেশনের জন্য ছাড়তে চায়নি, কারণ বর্তমানে যে বিধি বহাল রয়েছে তদনুসারে কেন্দ্রের চাহিদার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সহমত হওয়া আবশ্যক।
আরও পড়ুন-আক্রান্ত কমলেও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে মৃত্যু
ডিসেম্বর ২০২০তে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সেন্ট্রাল ডেপুটেশনে তিনজন আইপিএস অফিসার রাজীব মিশ্র, প্রবীণকুমার ত্রিপাঠী ও ড. ভোলানাথ পাণ্ডেকে ছাড়ার জন্য বলে। একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল যখন রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যসচিব ও আইএএস আধিকারিক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর অবসর গ্রহণের দিনটিতে কেন্দ্রে ডেপুটেশনের জন্য তলব করা হয় এবং রাজ্য সরকার তাতে সম্মতি দেয় না।
বর্তমানে কেন্দ্রে ডেপুটেশনে পাঠানোর জন্য যে ব্যবস্থা আছে সেটি সময় দ্বারা পরীক্ষিত এবং সারা দেশে আধিকারিক নিয়োগে ভারসাম্য বজায় রাখার পক্ষে উপযুক্ত। সর্বভারতীয় রাষ্ট্র কৃত্যকের অধীন আধিকারিকদের পরিষেবা যাতে কেন্দ্র ও রাজ্যের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যথাযোগ্যভাবে উপলব্ধ হয় সেই ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও বর্তমান ব্যবস্থা ভালরকম কার্যকরী। যদি সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না-করে এবং রাজ্যের অনুমোদনের পরোয়া না-করে একতরফাভাবে একজন আধিকারিককে ডেকে পাঠানো হয় তবে তা সংশ্লিষ্ট ক্যাডার অফিসারের মনোবল নষ্ট করে দেয়। স্মর্তব্য, এই ক্যাডার অফিসাররা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই প্রশাসনের স্তম্ভবিশেষ।
আরও পড়ুন-ভোটে প্রতিশ্রুতি গুরুতর সমস্যা, ক্ষুব্ধ মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে কার্যকর ব্যবস্থায় যদি কোনও আধিকারিক কেন্দ্রের ডেপুটেশনে যোগ দিতে অপারঙ্গম হন, তবে তিনি কেন্দ্রীয় স্টাফিং স্কিম বা বিদেশে নিযুক্তি বা প্রশিক্ষণ থেকে ৫ বছরের জন্য বঞ্চিত হন। তদুপরি, এই ব্যবস্থায় যে রাজ্য সরকারের অধীনে ওই আধিকারিক কর্মরত সেই রাজ্য সরকারকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা জরিমানা আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হচ্ছে রাজ্য সরকার যদি সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে না-ছাড়েন তবে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নির্দিষ্ট দিন থেকে ওই সংশ্লিষ্ট অফিসার আর রাজ্যের ক্যাডার অফিসার থাকবেন না, সে দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন। প্রস্তাবগুলো পাশ হয়ে গেলে আধিকারিকরা রাজ্যের হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রের মর্জির অধীনে চলে যাবেন। এটা বিশেষ উদ্বেগজনক কারণ জনস্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার সার্ভিস ক্যাডারদের পরিষেবা চাইলে রাজ্য তাঁদের ছাড়তে বাধ্য কিন্তু বিষয়টা জনস্বার্থ কি না সেটা পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করবে।
আরও পড়ুন-ধোনির নয়া লুকে মজে শেহবাগ
আর কেন্দ্রের ডেপুটেশনে পাঠানোর আগে রাজ্যের সঙ্গে যে বাধ্যতামূলক আলোচনার কথা বলা হচ্ছে তা নেহাতই কথার কথা কারণ কেন্দ্রের সঙ্গে সহমত না হলেও রাজ্য কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পালন করতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ২৮২গ অনুচ্ছেদ নিয়ে গণপরিষদে যে আলোচনা হয়েছিল তা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ২৮২গ অনুচ্ছেদটিই কালক্রমে সংবিধানের ৩১২ নং ধারায় পরিণত হয়েছে। এই আলোচনায় ড. বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘‘২৮২ অনুচ্ছেদ বলে কেন্দ্র রাষ্ট্রীয় কৃত্যকের জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং যাঁরা রাজ্যের অধীনে কাজ করবেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজের শর্তাবলি ঠিক করতে পারবে। ২৮২ নং অনুচ্ছেদে প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসনের খানিকটা ক্ষুণ্ণ হলেও কেন্দ্র রাজ্যের ওই স্বাধীনতায় তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারবে যখন উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তা অনুমোদন করবেন। ২৮২ নং অনুচ্ছেদে কেবল উচ্চকক্ষের কথাই বলা আছে। যেহেতু উচ্চকক্ষ রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু এখানে রাজ্যগুলিকেই এই বিষয়টি স্থির করার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, একথা বলাই যায়, এজন্যই ২৮২গ অনুচ্ছেদে এই কথাগুলি বলা হয়েছে।”
আরও পড়ুন-ধোঁকাবাজ বিজেপি থেকে সাবধান : যশোবন্ত সিনহা
সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কৃত্যক আইন ১৯৫১ চালু হয়েছিল সংবিধানের ৩১২ নং ধারা মোতাবেক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং কেন্দ্র ও রাজ্যসমূহ উভয়েরই আধিকারিকদের কাজের শর্তাবলি স্থির করার জন্য। রাজ্যসভায় অনুমোদিত হয়েছিল বলেই এই সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কৃত্যক কার্যকর হয় ৩১২ নং ধারার অধীনে। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কৃত্যকের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির অনুমোদনের বিষয়টিকে সংবিধানই যথাবিহিত গুরুত্ব প্রদান করেছে।
সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কৃত্যক গঠনের পেছনে কাজ করেছিল এমন একটা ব্যবস্থার চিন্তাভাবনা যা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই কাজে লাগাবে এবং রাজ্য প্রশাসনে জাতীয় সংহতির ধ্যানধারণা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ এই সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাজ্য এতদিন ধরে যে ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল তা থেকে তাদের বঞ্চিত করছে, অবশ্যই এই ক্ষমতা আধিকারিকদের কোন জায়গায় নিয়োগ করা হবে, সেই পোস্টিং সংক্রান্ত। আলাপ-আলোচনার পদ্ধতিটি পরিহার করার মধ্যে দিয়ে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণার মূলেই কুঠারাঘাত করছে, যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের অন্যতম মান্য নীতি।
আমাদের দেশের মূলগত কাঠামো রক্ষার বিষয়টি সংবিধানের কথা এবং আদর্শ অনুসরণের সঙ্গে জড়িত। প্রস্তাবিত সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে কেন্দ্র যা করতে চলেছে তা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে।