সুন্দর হাতের লেখার জন্য বহু মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন সুজন বেরা। তাঁর ছোট হাতের লেখা শোভা পেয়েছে বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ, বিয়ের কার্ড, মানপত্র, আমন্ত্রণপত্র, নাটকের পোস্টারে। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের। লিখলেন
অংশুমান চক্রবর্তী
কোলাঘাটের সুজন বেরা। পেশায় শিক্ষক। তাঁর সুন্দর হাতের লেখা মুগ্ধ করেছে বহু মানুষকে। ছেলেবেলায় হাতের লেখা সুন্দর করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বাবার কাছে। বাবা শক্তিময় বেরা ছিলেন ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের ড্রাফটসম্যান। লিখতেন বিভিন্ন স্টাইলে। তাঁর ছোট হাতের লেখাও ছিল ছবির মতো। সেগুলো দেখে নকল করার চেষ্টা করতেন সুজন। শিক্ষক তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। রঙিন চকে তাঁর বোর্ড ওয়ার্কও সুজনকে আকৃষ্ট করত। এইভাবে তিনি নিজের হাতের লেখাও সুন্দর করার চেষ্টা করতেন। কীভাবে চর্চা করতেন? সুজন জানালেন, ‘‘ছোটবেলায় স্লেট-পেন্সিল বা চকের মাধ্যমে লেখা শুরু। পরবর্তীকালে নিবপেনে। রুল টানা খাতায় লিখে স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম। বাবা-মা যা যা রুল টানা খাতায় লিখে দিতেন, তাই অনেকবার অনুশীলন করতে হত। তবে বলপেনে ছোটবেলায় খুব বেশি লিখতাম না। পাছে লেখা নষ্ট হয়ে যায়। ছোটবেলায় সুন্দর হাতের লেখার জন্য বাবা, মা, গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয়দের ভালবাসা পেয়েছি। তাঁদের প্রশংসা পরবর্তীকালে আমাকে ছোট হাতের লেখা আরও সুন্দর করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে। আমার লেখা খাতা দেখিয়ে অন্য ছাত্রদেরও উৎসাহিত করা হত। সুন্দর হাতের লেখার জন্য ছোট বয়সে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে জুনিয়র সেকশনে ওয়াল ম্যাগাজিন লেখার সুযোগ পাওয়া আমায় ভীষণভাবে আনন্দ দিয়েছিল।”
আরও পড়ুন-পর্যটনের নয়া ঠিকানা বায়ো ডাইভারসিটি পার্ক
বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন সুজন বেরা। সেই সুবাদে ছাত্রছাত্রীদের হাতের লেখা সুন্দর করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। কীভাবে? তিনি জানালেন, ‘‘প্রথমত বোর্ড ওয়ার্ক করার সময় ছবি-সহ সুন্দর হাতের লেখায় রঙিন চকে বিষয়টিকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রাণবন্ত করে তোলার চেষ্টা করি। ওদের বাড়ির বা ক্লাসের খাতায় হাতের লেখা নিয়ে মন্তব্য করি। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে কীভাবে ভাল হাতের লেখা করা যায়, সেই বিষয়ে জানাই। মাসে একবার বা দু’বার শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে হাতের লেখার প্রতিযোগিতা করা হয়। তাদের বোঝাই সুন্দর হাতের লেখার অধিকারী সাধারণত সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তোমরাও সেভাবে বেড়ে ওঠো।”
আরও পড়ুন-ফুলকপি রে ফুলকপি, কমলা না হলদে হবি
সুজন মনে করেন, হাতের লেখাও একটি শিল্প। এই কথা কখন মনে হয়েছিল? তিনি বলেন, ‘‘এটা প্রথম মনে হয়েছিল যখন কোলাঘাটের মিলেনিয়াম গ্রাফিক্স প্রেসের ইন্দুদা আমাকে বইয়ের নামকরণ করতে দেন। প্রথম বইটির নাম ছিল ‘শব্দমালা’, পরেরটি ‘ভাষামৃগ’। তারপর আমার দাদার বিয়ের কার্ড লিখি। তখন প্রথম উপলব্ধি করি, ডিজিটাল যুগেও হাতের লেখা নিয়ে অনেক কিছু করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে ছোট হাতের লেখা দিয়ে বিভিন্ন রকমের কাজ করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি। যেমন বইয়ের প্রচ্ছদের নামকরণ, বিয়ের কার্ড, মানপত্র, ছোট ছোট আমন্ত্রণপত্র, নাটকের পোস্টার, পেপার ওয়েট-এ লেখা, ফটো স্ট্যান্ড, ব্যাগে লেখা, শাড়ি বা স্টোলের উপর লেখা, ডিজিটাল কার্ড, লোগো প্রভৃতি। এই কাজ আমি ভালবেসে করি। পারিশ্রমিক নিই না। তবে আমার মনে হয় এই ডিজিটাল যুগেও হাতের লেখা মানুষের পেশা হতে পারে। আজও যে কোনও জায়গায় হাতের লেখার সমাদর রয়েছে। সুন্দর হাতের লেখা আজও সকলের মন ছুঁয়ে যায়। যদি সঠিক ভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কেউ হাতের লেখা নিয়ে এগিয়ে আসেন তিনি সাফল্য পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।”
আরও পড়ুন-নিলামে চোখ বেবি এবি’র দিকে : অশ্বিন
ছোট লেখার জন্য সুজনকে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জনপ্রিয় টিভি শো ‘দাদাগিরি’তে ডাকা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সুজনের নানা কাজ দেখে প্রশংসা করেন। পরবর্তীকালে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, জাদুকর পি সি সরকার, মূকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্ত, সুরকার কল্যাণ সেন বরাট, লেখক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, গায়ক সিধু, গায়ক অনিন্দ্য বসু, চলচ্চিত্র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্ত, অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী মৌবনী সরকার, ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহা, ক্রিকেটার অশোক দিন্দা, গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া, দেবসাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রূপা মজুমদার-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর তীব্র অসন্তোষ মণিপুরে, পুড়ল মোদির কুশপুতুল
ছোট হাতের লেখা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? সুজন জানালেন, ‘‘রাজশেখর বসুর মতো হাতে লিখে একটা বই বার করব। কাজ চলছে। লেখক আমার হাতের লেখায় ভরসা রেখেছেন। আশা করি খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। এ-ছাড়া নতুন আঙ্গিকে বিয়ের কার্ড বা অন্যান্য আমন্ত্রণপত্র তৈরি করতে চাই। ছোটদের হাতের লেখা ভাল করার ব্যাপারে ওয়ার্কশপ করতে চাই। পেশাগত ভাবে হাতের লেখাকে কীভাবে আঁকড়ে ধরা যায়, সেই বিষয়েও ওয়ার্কশপের চিন্তাভাবনা রয়েছে।”
সুজন বেরা আজ বহু মানুষের আদর্শ। অনেকেই তাঁকে দেখে নিজেদের হাতের লেখা সুন্দর করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছেন। সুন্দর হাতের লেখা পেশা হতে পারে, এই বিশ্বাস সুজনের। সেটা সত্যি হলে উপকৃত হবে নতুন প্রজন্ম। খুলে যাবে স্বাধীন জীবিকার আরও একটা পথ।