আজ থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। এই মেলা ঘিরে অনেক স্মৃতি, অনেক স্বপ্ন, অনেক মনে রাখার মুহূর্ত। তেমনই কিছু কথা নস্টালজিয়ায় মাখামাখি হতে হতে ভাগ করে নিলেন কবি অধ্যাপক অভীক মজুমদার
তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। সাল ১৯৮১। বইমেলায় গিয়েছি। তখন বইমেলা হত রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকের মাঠে। এখন যেখানে ‘মোহরকুঞ্জ’। সেই মাঠকেই মনে হত কত বিরাট। কত বই, কত মানুষ, কত আশ্চর্য রুচিশীল পরিবেশ। বই দেখতে দেখতে, কিনতে কিনতে মশগুল হয়ে আছি। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। হঠাৎ দেখি, ঘাসে বসে গল্প করছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নবনীতা দেবসেন। দু’জনের দুটি বই হাতে নিয়ে দুরুদুরু বুকে দাঁড়ালাম, সস্নেহে স্বাক্ষর করে দিলেন দু’জন প্রিয় লেখক-লেখিকা। নাম জানতে চাইলেন। সে বই এখনও আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে। সেই সন্ধেটা আজও ছুঁতে পারি। স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার সেই অল্পবয়স যেন ফিরে পাই।
আরও পড়ুন-ব্যাটিং উপভোগ করছেন জাদেজা
সেই কথাটাই বলতে বসেছি। ‘বইমেলা’ প্রকৃতপক্ষে, অন্তত আমার কাছে ‘স্মৃতিমেলা’। সেই কবে থেকে বইমেলায় যাচ্ছি। জীবনের পর্বে-পর্বে তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে স্মৃতির মিছিল। অনেক মুখ, অনেক হাসি-হুল্লোড়-বই নির্মাণ-পত্রিকা-গান-বন্ধুসঙ্গ। বইমেলার কত ব্যক্তিত্ব, কত বন্ধু, কত খ্যাত-অখ্যাত মানুষ আজ আর ইহজগতে নেই, কত বন্ধু-স্বজনের সঙ্গে জীবনক্ষেত্রে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, কেউ স্থায়ীভাবে চলে গিয়েছে বিদেশে। মেলার মাঠে ঢুকলে আনন্দ উত্তেজনার পাশাপাশি একটা বিষাদের বাতাস হু-হু করে বুকে বয়ে যায়। স্মৃতি-বিস্মৃতি-আবহমান মিলেমিশে মেলার মাঠকে স্থান-কাল-এর চৌহদ্দি ভেঙে মায়াবাস্তবে পৌঁছে দেয়। এবছর বইমেলার ক্ষেত্রে অবশ্য আনন্দের পাল্লাটা বেশ ভারী। অতিমারির ঝড়-ঝাপটা কাটিয়ে দু’-দু’বছর পর আবার বিধাননগর সেন্ট্রাল পার্কে বইমেলার অনবদ্য উৎসব। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় প্রিয় পার্বণ এই বইমেলা। তাঁর হাত দিয়েই উদ্বোধন হয় এই মননশীলতার মিলনক্ষেত্রের। প্রতি বছর তিনি প্রথম দিনেই যান ‘জাগোবাংলা’-র মুক্তসজ্জার পুঁথিপরিসরে, যান ‘পশ্চিমবঙ্গ মণ্ডপে’। খোঁজখবর নেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’-সহ অন্যান্য সরকারি আকাদেমি এবং সরকারি প্রকাশনাগুলির। ঘুরে দেখেন মাঠের বইপত্রের সম্ভার। তিনি নিজে একজন লেখিকা। ফলে গ্রন্থকার-প্রকাশনা-পাঠক আর সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটে যায় ওই মুহূর্তেই। বইমেলা মেলে দেয় ডানা। গত দু’বছরের শূন্যতা থেকে এই ২০২২ সালে সেই মেলা যেন আরও অপরূপ সৌন্দর্যে উত্থিত হবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি, বেলা সাড়ে তিনটেয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের নিরলস পরিচর্যায়।
আরও পড়ুন-মৃত সেনার তথ্য গোপন ? ইউক্রেনের রাস্তায় রুশ ভ্রাম্যমাণ চুল্লি
বইমেলায় বহু মানুষের ভিড়, নানান বয়সি মানুষের অবিরাম ব্যস্ততায় মনে হয়, বইয়েরাও যেন তাকে-তাকে, শেল্ফে, টেবিলে অপেক্ষা করে আছে প্রিয় পাঠকের জন্য। কলকাতা বইমেলা প্রতিবছর আরও নতুন হিল্লোলে তরঙ্গিত হয়। রবীন্দ্রসদনের বিপরীত মাঠ থেকে পার্ক স্ট্রিটে, সল্টলেক স্টেডিয়ামের বাইরে, বাইপাসের মিলনমেলা প্রাঙ্গণে, তারপর সেন্ট্রাল পার্কে। সর্বত্রই বইয়ের নবীন ইশারা। ক্রমবর্ধমান বিস্তার।
কত প্রিয় কবি-লেখকের দেখা পেয়েছি বইমেলার মাঠে। অক্ষরে আর শব্দে তাঁদের সঙ্গে পরিচয়। আগে কোনওদিন চোখেই দেখিনি। হঠাৎ সামনে দেখে থতমত খেয়ে যেতাম। রোমাঞ্চও হত। ওই যে শ্বেতশুভ্র পোশাকে হেঁটে যাচ্ছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সঙ্গের দু’জন কে? চিনিস না? রমাপদ চৌধুরী আর মতি নন্দী। দেখেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে, তারাপদ রায় কিংবা সমুজ্জ্বল সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। বারংবার দেখা হত ভাস্কর চক্রবর্তী, নবারুণ ভট্টাচার্য থেকে তখনকার তরুণ জয় গোস্বামীর সঙ্গে। সসম্ভ্রমে দেখতাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অথবা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। শুধু সাহিত্যিকরাই বা কেন, চিত্রকলা-নাটক-চলচ্চিত্র-সংগীত কিংবা সাংবাদিকতা জগতের মহীরুহদের, দূর থেকে দেখতাম বইমেলায়। কয়েকবছর আগে একটি স্টলে ছবি এঁকে এঁকে সই দিচ্ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। সৃষ্টিশীলতার মহাপৃথিবী বইমেলা উন্মোচিত হয় বইয়ের সাহচর্যে, বইয়ের উপস্থিতিতে। এমন মেলার তুলনা আছে?
আরও পড়ুন-শান্তির ভোট দেখিয়ে দিল জলপাইগুড়ি
আমার পুত্র একবার শৈশবের সারল্যে বছর দশেক আগে বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করেছিল, জটায়ুর বইগুলো কোথায় পাওয়া যায়? জটায়ু কি বইমেলায় আসেন? প্রশ্নটা শুনে থমকে যাই। সত্যিই তো, বইমেলার ভিড়ে কি ঘুরে বেড়ান না, ফেলুদা, তোপসে, ব্যোমকেশ, অজিত, টেনিদা, ঘনাদা, গোয়েন্দা বরদাচরণ, সাধু কালাচাঁদ, স্ট্রাইকার প্রসূন ভটচায, অপরাজিত আনন্দ, ঋজুদা, বিমল কুমার কিংবা গন্ডালু? হয়তো দেখা হবে গােগোল কিংবা কিরীটী রায়ের সঙ্গে। শুধু ছোটরাই বা কেন, আমরা বড়রাও কি প্রিয় সাহিত্যচরিত্রদের বইমেলায় খুঁজি না?
আরও পড়ুন-গণতন্ত্রের শাসন এবার ফিরল পাহাড়ে
লিটল ম্যাগাজিন মণ্ডপে পরিবেশটাই তারুণ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল। তরুণতম কবি আর প্রবীণ কবি একই মগ্নতায় শিল্পসাহিত্য নিয়ে কথা বলেন। কত রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার চিহ্ন সযত্নে ছাপেন সম্পাদকেরা। কত স্বপ্ন, কত বিকল্প চিন্তা, কত নতুন অভিযাত্রাকে কেন্দ্রে রেখে পত্রপত্রিকায় সাহিত্যচর্চার মহাক্ষেত্র! এখানে এসে পরিচিত হলাম শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, থেকে কমল চক্রবর্তী, দেবদাস আচার্য, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের সঙ্গে। ‘সে ছিল এক দিন আমাদের যৌবনে কলকাতা।’
আরও পড়ুন-খোশমেজাজে ভোট ময়দানে রবীন্দ্রনাথ
মায়াবী আলোয় ভরে থাকে বইমেলার সান্ধ্য পরিসর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে তখন মাইকে বাজছে, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে…’, অপার্থিব এক মমত্বে ঝলমল করে বইমেলা। প্রতি বছর একটা শহর যেন কয়েকদিনের জন্য তৈরি হয়। বাড়িগুলোর গায়ে লেখা থাকে ঠিকানা। ওদিকে ‘দে’জ, এদিক দিয়ে ডানহাতে পড়বে ‘মিত্র ও ঘোষ’, তার পাশে ‘আনন্দ’, ওদিকে ‘গাঙচিল’…, পিছনের সারিতে অজস্র পুরনো বইয়ের মণিমানিক নিয়ে ‘সুবর্ণরেখা’…। এছাড়াও কত ভাষার বই, কত দেশের বই, কত সংস্কৃতির বই। ওদিকের মঞ্চে চলছে ‘কৃত্তিবাস’-এর কবিতাপাঠের আসর, এদিকে বাউল গান, পথচলতি মানুষের হাতে কোথাও বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে বাংলা বাইবেল বা বাংলা কোরান কিংবা গৌতম বুদ্ধের বাণী। মহাগ্রন্থের, মহাসম্প্রীতির আর মহামানবের সেই সাগরতীরে দাঁড়িয়ে প্রণাম করি মেধা-মনন আর কল্পনা প্রতিভার এই মহোৎসবকে। বইমেলা শেষ হয়, শহর ভেঙে যায়। আবার নতুন সাজে তৈরি হয় নতুন শহর। না, এখনই বিসর্জনের ঢাকের কথা বলব না। এখন আগমনির সুর। আগমনির গানে ভরে থাকুক বইমেলার অনবদ্য আয়োজন। দেখা হচ্ছে। দেখা হবে। হবেই।