সারা সপ্তাহ ধরে কাজের ব্যস্ততার পর সপ্তাহান্তে একটু ছুটির আমেজ কে না চায়! ইট কাঠ পাথরের শহর ছেড়ে সেই ছুটি কাটানোর জায়গা যদি হয় প্রকৃতির কাছাকাছি, তাহলে তো বলাই বাহুল্য হাতে চাঁদ পাওয়ার জোগাড়। নিশ্চয়ই ভাবছেন এমন কোনও জায়গা কি সত্যিই আছে? যেখানে খুব কম সময়ের মধ্যে কম টাকা খরচ করে সপ্তাহান্তের ছুটির দিনটা কাটিয়ে আসা যায়। অবশ্যই আছে, আর তারই সুলুকসন্ধান দিতে কলম ধরা।
পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট-এর নামটা অনেকেই হয়তো শুনেছেন। অনেকেই আবার যাব-যাব করেও শেষপর্যন্ত গিয়ে উঠতে পারেননি। তবে হলফ করে বলতে পারি, প্রকৃতির রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
ঘন জঙ্গল। যেদিকে তাকাবেন চারপাশে শুধুই সবুজের সমারোহ। চৈত্রের ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও কিন্তু এখানকার আবহাওয়া এতটাই স্নিগ্ধ যে নিজের অজান্তেই মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দের কবিতার ক’টা লাইন—
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; / পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; / সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায়-এ জীবনের সব লেনদেন/ থাকে শুধু অন্ধকার…
প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে যদি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়েন, তাতে ক্ষতি কী?
আর ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন থাকে তাহলে হঠাৎ আসা কয়েক পশলা বৃষ্টি পুরো পরিবেশকেই একটা অন্য মাত্রা দেবে। তখন, গাছের পাতায় বৃষ্টির জলের কনসার্ট আপনার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা হবে বইকি। তখন মনে হবে হাতে সময় কম থাকলেও একটা ইচ্ছে তো পূরণ হল! তা-ও আবার ঘরের কাছেই। পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট এমনই একটা জায়গা, যেখানে প্রকৃতি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কীভাবে যাবেন ?
সড়ক পথে কলকাতা থেকে ভলভো বাসে চেপে চলে যান আসানসোল। সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বরাকর হয়ে গড়পঞ্চকোট।
রেলপথ : রেলপথে গড়পঞ্চকোটের নিকটবর্তী স্টেশন হল বরাকর। সেখান থেকে সরাসরি গড়পঞ্চকোটে যাবার গাড়ি পেয়ে যাবেন।
থাকবেন কোথায় ?
বেশ কয়েকটি হোটেল আছে থাকার জন্য। দুটি মাত্র কটেজও আছে। তবে আগে থেকে বুকিং করে যেতে হবে। বন দফতরের বাংলোতেও থাকার ব্যবস্থা আছে।
কী কী দেখবেন ?
বড়ন্তি হ্রদ – এই হ্রদে রোদের সৌন্দর্য অসাধারণ। শীতের সময় এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি দেখতে পাওয়া যায়।
পাঞ্চেত বাঁধ – পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে এই বাঁধ অবস্থিত। পাহাড়ের ওপর থেকে এর সৌন্দর্য অসাধারণ।
মাইথন বাঁধ – বরাকর নদীর উপর এই বাঁধ দেখতে পাওয়া যায়। নীল জলরাশিতে এই বাঁধের সৌন্দর্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
জয়চণ্ডী পাহাড় – সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছিল এই জায়গায়। মূলত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের একটি পাহাড়।
পঞ্চরত্ন মন্দির – ৬০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বিগ্রহবিহীন এই মন্দিরটি গড়পঞ্চকোটের সবথেকে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য শিল্পরীতির নিদর্শন। মন্দিরটি তৈরি হয়েছে টেরাকোটা শিল্পের আদলে। দক্ষিণ ও পূর্ব দুয়ারে আছে রাস মন্দির। মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন রকমের ফুল, পাখি, ফল, আলপনা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যরত মানব-মানবীর মূর্তি খোদাই রয়েছে।
কঙ্কালী মাতার মন্দির – গড়পঞ্চকোটের পশ্চিম দিকে এই ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি অবস্থান করছে। মন্দিরের সামনের অংশ অক্ষত থাকলেও; পিছনের অংশ প্রায় ধ্বংসের মুখে। কঙ্কালীমাতা ছিলেন গড়পঞ্চকোটের শেখর রাজবংশের কুলদেবী। কিন্তু বর্তমানে এই মন্দিরে বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না।
আদি কল্যাণেশ্বরী দেবী মন্দির – গড়পঞ্চকোটের বাঁদিকে রয়েছে প্রস্তর দ্বারা নির্মিত কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
কখন যাবেন ?
ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময় হল জুন থেকে থেকে সেপ্টেম্বর।
গড়পঞ্চকোটে পৌঁছনোর পর প্রথম চোখে পড়বে সম্প্রতি সংস্কার করা পঞ্চরত্ন মন্দির। কয়েক পা এগোলেই তার সামনেই কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান দেখতে পাবেন। সেখানে চা-বিস্কুটের সঙ্গে ছৌ মুখোশও বিক্রি হচ্ছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ চলে যাবে পাঞ্চেত পাহাড়ের দিকে। ঘন জঙ্গলের মোড়কে ঘেরা এই পাহাড় আপনাকে হাতছানি দেবে যা এড়ানো মুশকিল। পাহাড়ের মাথার উপর থেকে গোটা অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। পাঞ্চেত বাঁধও চোখে পড়বে। পাহাড়ের উপর থেকে যেদিকে তাকাবেন চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এরপর দেখে নিন গড়পঞ্চকোটের গেট, জোড় বাংলা, ওয়াচ টাওয়ার, রানি মহল, যা পঞ্চকোট রাজত্বের ভগ্নাবশেষ হয়ে বহন করে চলেছে তার স্মৃতি। তথ্য বলছে, এক সময় রাজা-প্রজা-সৈন্য নিয়ে গমগম করত এই চত্বর।
রাজা দামোদর শেখর ছিলেন পঞ্চকোটের প্রথম রাজা। সময়টা ছিল ৯০ খ্রিস্টাব্দ। পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে এখানে তিনি রাজত্ব গড়ে তোলেন। আর সেই থেকেই নাম হয় গড়পঞ্চকোট। ‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী।
ইতিহাস বলছে, এই রাজার উত্তরসূরিরাই পঞ্চকোটে ছোট বড় মিলে প্রায় ৪০টি মন্দির তৈরি করেছিলেন। কোনওটা পোড়ামাটির তো আবার কোনওটা পাথরের। যার মধ্যে এখন দু’-একটির ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য কিছু ইতিহাসবিদের বক্তব্য রাজারা নন, ধনী বণিকরা এই মন্দিরগুলি তৈরি করেছিলেন।
আসলে এমন মত পোষণ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, সে-সময় দামোদর অববাহিকা জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ছিল। বাংলায় বর্গিদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এই রাজত্ব। জনশ্রুতি, শেষ রাজার ১৭ জন রানি সম্মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছিলেন।
গড়পঞ্চকোট আসার আগে একদিন মাইথনে থাকতে পারেন। এই অঞ্চল থেকে মাইথন ২০ কিমি মধ্যে। মাইথন থেকে অটো ভাড়া করে পাঞ্চেত বাঁধ ও শক্তিপীঠ কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে সহজেই ঘুরে আসা যায়। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই দেবীর মন্দির আগে ছিল পঞ্চকোটে। বর্গি হামলার সময় দেবীকে নিয়ে চলে আসা হয় এখানে। বিহারীনাথ পাহাড়, বড়ন্তি ও জয়চণ্ডী পাহাড়। সবগুলো জায়গাই গড়পঞ্চকোট থেকে মাত্র ২০-৩০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
কেন যাবেন গড়পঞ্চকোট ?
এটি একটি অফবিট গন্তব্য।
পুরুলিয়ার উত্তর দিকে পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে শাল, পিয়াল, আর ঘন মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা গড়পঞ্চকোট (Garhpanchkot) ভ্রমণের জন্য আদর্শ জায়গা। চারিদিকে সবুজ জঙ্গলে ঘেরা।
গড়পঞ্চকোটে প্রায় পাঁচ মাইল বিস্তৃত একটি দুর্গ ছিল। বিশাল পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই দুর্গের স্থাপত্য বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং অবলুপ্তির পথে। পাঞ্চেত পাহাড়ের একদিকে পাঞ্চেত বাঁধ আর অন্যদিকে গড়পঞ্চকোট (Garhpanchkot) দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখে মন ভরে যাবে।
সপ্তাহান্তে মনটাকে একটু সতেজ করার জন্য গড়পঞ্চকোট ভায়া মাইথন এক কথায় অনবদ্য। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার ঢুঁ মেরে আসুন পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোটে।