ছোটপর্দা, বড়পর্দা, বিজ্ঞাপন— সব মাধ্যমেই নিয়মিত দেখা গেলেও থিয়েটারে নয়। এই ফিরে আসাটা কীভাবে হল?
মানসী (Manashi Sinha) : ফিরে আসা মানে, ঠিক ওভাবে ভাবছি না। আমি থিয়েটারেই ছিলাম। কিছু বছর ব্যক্তিগত কারণে স্টেজ করিনি কিন্তু থিয়েটার থেকে সরে গিয়েছিলাম সেটা নয়। আমার অস্তিত্বটাই যে থিয়েটারময়। তবু ‘এই আমি মাধবীলতা’র কথাটা বলি। এটা সম্ভবপর হয়েছে বিধাননগর নর্থ সোসাইটি ফর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের কর্ণধার মধুসূদন দত্তের কারণে। উনি আমার অভিনয় ভীষণ ভালবাসেন। লকডাউনের সময় একদিন জানালেন, ওঁদের সংস্থার তরফে একটা নাটক করতে চান, একেবারে পেশাদারিভাবে আর সে-দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। আমি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। অনেকদিন মঞ্চ থেকে দূরে থাকার কারণেই, কিন্তু উনি নাছোড়। বললেন, আপনাকেই করতে হবে। তখন এই গল্পের কথা মনে পড়ে আমার। ভাবনা-চিন্তা শুরু করি। এই গল্প কি সাম্প্রতিক?
মানসী (Manashi Sinha) : না, না, এ গল্প আমার স্কুলবেলার। বহু পুরনো। কিন্তু বিষয় হিসেবে চিরকালীন। তবে গল্পটুকুই লেখা ছিল। চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করি গত বছর। মাস দুয়েক লেগেছিল। শেষ করি পুজোর আগে। এরপর মধুদা নির্দেশনার দায়িত্বও চাপিয়ে দেন। তখন আমি, অসীম রায়চৌধুরি, শুভম সিং, অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়— এই চারজন মিলে রিহার্সাল শুরু করি। দু’মাস খুব জোড়তাড় রিহার্সাল হয়। প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৩ নভেম্বর, জ্ঞানমঞ্চে। মাত্র চারটি চরিত্র বলেই হয়তো এত অল্প সময়ে সবটা সম্ভবপর হয়েছে। খরাজের ছেলে বিহু আর ওর স্ত্রী কঙ্কণা আমাদের মিউজিক করে দিয়েছিল। একটা কবিতাপাঠ ছিল, সেটা করেছে কৌশিক সেন। মোটমাট বন্ধুরা মিলেই কাজটা হয়েছে।
‘এই আমি মাধবীলতা’র কাহিনি নিয়ে যদি একটু বলেন। মানসী : এককথায় এটা ভালবাসার কাহিনি। আর সে ভালবাসা, নিজেকে! আমাদের চারপাশে তাকালেই দেখা যায়, আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মেয়ে পরিবারের সকলকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে গিয়ে, আগলে রাখতে গিয়ে, নিজেকে ভালবাসতে, নিজের মর্যাদা দিতে ভুলে যায় বা ভুলে থাকে। এর ফলে এক সময় বড় বেশি টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে ওঠে তারা, তার নিজের মানুষদের কাছেই। অনেকক্ষেত্রে ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও পায় না। একটা সময় পর তার নিজের মধ্যেই কিন্তু প্রশ্ন জাগে, বিরোধ বাধে, কী করছি, কেন করলাম। তখন অনেকখানি সময় সে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু নিজেকে ভালবাসা তখনও যদি সে শুরু করে, অসম্মানের কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, বুঝিয়ে দিতে পারে, তাকে হারানো মানে যারা হারাচ্ছে, ক্ষতি তাদের, সেটুকুও অনেক। মনে হচ্ছে এ একেবারে ব্যক্তিগত অনুভব থেকে কাহিনি হয়ে ওঠা?
মানসী : একেবারে ঠিক বলেছ। ওই যে বললাম, আমার স্কুলবেলায় এ গল্পের শুরু। আমি আমার মাকে দেখেছি। কী দুর্দান্ত অভিনয় করতেন মা, কত গুণ ছিল মায়ের। কিন্তু সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ হয়েও সংসারের জন্য সব বিসর্জন দিয়ে অনেক কিছু ভুলে থেকেছেন। পরবর্তীতে আমি আমার শাশুড়িমাকে দেখেছি, দারুণ নাচতেন, গান গাইতেন, এমনকী উচ্চপদে চাকরিও করতেন। কিন্তু বিয়ের পর একে একে সব ছাড়তে হয়েছে। আমার বড় ননদ, পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল, দারুণ গানের গলা কিন্তু কোনও চর্চাই থাকেনি সংসারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। এ দুঃখগুলো তো হারিয়ে যায় না, চাপা থাকে মাত্র। এগুলো আমি আমার বাড়ির কথা বললাম মাত্র, এ ছবি কিন্তু ঘরে ঘরে। আর আমি যা বুঝি, মেয়েরা নিজেরা নিজেদের ভাল না বাসলে, নিজেকে নিজে সম্মান না দিলে, নিজের ভাললাগাকে নিজ উদ্যোগে বাঁচিয়ে না রাখলে তাদের হয়ে আর কেউ কাজটা করার জন্য এগিয়ে আসবে না। নিজের কথা নিজেকেই ভাবতে হবে। কেউ না বুঝলে তাকে বুঝিয়েও দিতে হবে!
তার মানে এ-নাটক অনেকটা আপনার ইচ্ছেপূরণ?
মানসী : আমার ইচ্ছেপূরণ আর হল কই? মা দেখে যেতে পারল না এই নাটক। ২০২০-র ৪ অগাস্ট মা চলে গেলেন। বলতে পারো, এটা আমার মায়ের ইচ্ছেপূরণ। মা খুব চাইত আমি অভিনয়ের পাশাপাশি লিখি, ডিরেকশন দিই। কিন্তু সময় করে উঠতে পারতাম না। মধুদা যখন জোর করলেন, মায়ের কথা ভেবেই আরও রাজি হয়ে যাই। আসলে আমি জীবনের সবকিছুই করতাম, মায়ের জন্য। মা দেখবেন, মা প্রশংসা করবেন, মা আনন্দ পাবেন। তাই মায়ের চলে যাওয়াটা বড় ধাক্কা যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি কাজ দিয়ে।
নাটকের নামকরণ নিয়ে কিছু বলবেন?
মানসী : অবশ্যই। সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজি-র মাধবীলতা, অনিমেষ আমার অলটাইম পছন্দের দুই চরিত্র। মাধবীলতা নামটা অবচেতনে থেকেই যায়। সেখান থেকেই এই নাম।
কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মানসী : ভীষণ দ্বিধায় ছিলাম বলে প্রথমে কাউকে সেভাবে আমন্ত্রণ জানাইনি, শুধু ফেসবুক পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু তার থেকেই কত পরিচিত জনই যে এসেছিলেন দেখতে, যাঁরা নাট্যজগতের অতি স্বনামধন্য। কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম, থিয়েটার তার মানে আমাকে ভোলেনি! এরপর অনেকগুলো কল শো পেয়েছি, পাচ্ছি নানা দিক থেকে।
তার মানে নির্দেশনার কাজ এবার চলবে?
মানসী : দ্যাখো, শরীরের কারণে অভিনয়, মানে মঞ্চে অভিনয় খুব বেশিদিন আর করতে পারব বলে মনে হয় না, তাই মনে মনে জানি নির্দেশনাই আমার ভবিষ্যৎ। একটা ছবির ডিরেকশনও শুরু করেছিলাম ২০২০-র শুরুতে, ‘এটা আমাদের গল্প’। প্রোডিউসার-ফিনান্সারের ঝামেলায় আটকে আছে। শাশ্বত, অপরাজিতা, খরাজ, কনীনিকা, সোহাগ সেন কাস্ট ছিল। নাটকও আরও দুটো লেখা আছে। হবে সব ধীরে ধীরে। আমার তাড়া নেই!