ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব বলে পয়লা বৈশাখের একটা আলাদা তাৎপর্য বরাবরই রয়েছে। বাঙালির কাছে একটা নতুন সূচনার বার্তা হয়ে প্রতিবছর দিনটা ফিরে আসত।
ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে (Pahela Boisakh) হালখাতা করতে দোকানে দোকানে যেতাম বড়দের সঙ্গে। সেইসব দোকান থেকে দেওয়া হত শরবত, মিষ্টির বাক্স আর কালেন্ডার। বাড়ি ফিরে গুনতাম সেইসব বাক্স আর কালেন্ডার!
এখন কলকাতায় থাকলে বেশিরভাগ বছর পয়লা বৈশাখ কাটে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। দে’জ, পত্রভারতী, দেব সাহিত্য কুটীর আরও অনেক প্রকাশনায় বর্ণময় আসর বসে, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা আলাপ চলে সকাল থেকে সন্ধে অবধি।
ঢাকার প্রকাশনাগুলোতেও দেখেছি জমজমাট আসর। ঢাকায় সেদিন রাস্তায় আঁকা থাকে ফুলের আলপনা। প্রভাতফেরি তো ঢাকার সংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত প্রভাতফেরি হয় প্রতি বছর।
গত দু-বছর অতিমারিতে কলেজ স্ট্রিটের আড্ডা হয়নি। ঢাকায় প্রভাতফেরি হয়নি। এই দু-বছরে আসর শূন্য করে অনেকে চলে গেলেন। তবু এ-বছর পয়লা বৈশাখে (Pahela Boisakh) আবার ঢাকা আর কলকাতা গমগম করবে।
বিকেলে ঝড়বৃষ্টির পর মনে পড়বে বহু যুগ আগে ফেলে আসা ছোটবেলার পাড়ার কথা, পাড়ার দোকানগুলোর কথা। যে দোকানগুলো আর নেই, দোকানিরাও হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে তাঁরা আমার খুব কাছে চলে আসেন। যেন মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব তাঁদের দোকানের ঠান্ডা শরবতের গ্লাস আর কালস্রোতে ভেসে মিলিয়ে যাওয়া রঙিন ক্যালেন্ডার।
ক্যালেন্ডারের পাতা খুব দ্রুত বদলায়। ছোটবেলা কেটে যায়। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে পয়লা বৈশাখের কতরকম রূপ দেখা হয় দেশে-বিদেশে।
সারা পৃথিবীর এমন কোনও বাঙালি আছেন কি পয়লা বৈশাখে যিনি স্মৃতিমেদুর হন না? আমেরিকাতে সিএবি বলে যে সাংস্কৃতিক সংস্থাটি বঙ্গ সম্মেলনের অন্যতম কান্ডারি সেই সংস্থার পক্ষ থেকে পয়লা বৈশাখে আয়োজন করা হয় কবিতা, নাচ, গান আর এলাহি খাওয়াদাওয়ার। লন্ডনে বাংলাদেশের আর ভারতের বাঙালিরা মিলেও খুব সুন্দর আয়োজন করেন। সেখানে বাংলা নাটক হয়, দেখানো হয় বাংলা সিনেমা। লন্ডনে অনেক সময় ছুটির অভাবে পয়লা বৈশাখ আর রবীন্দ্রজয়ন্তী একসঙ্গে পালিত হতে দেখেছি। এটা এমনিতেও ছোটবেলা থেকেই আমার বারবার মনেহয় যে বৈশাখ মাসটায় যেন রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র অধিকার আছে। পয়লা বৈশাখ এলেই মনে হয় যেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন কাছে চলে এল। উত্তর লন্ডনে হ্যাম্পস্টেডে ‘ভিক্টোরিয়ান ভিলা’ নামে যে বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছিলেন সেখানেও বাংলা নববর্ষ আর রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে পালিত হয়। লন্ডনে স্থায়ী একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালা করবার জন্য একবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাড়িটি কিনে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাড়িটি যেহেতু হেরিটেজ ঘোষিত তাই ব্রিটিশ আইনের বাধায় বাড়িটি কেনা সম্ভব হয়নি তখন। তবে বাড়িটিতে অনেক উৎসব হয়েছে প্রায় সারা বৈশাখ মাস ধরে, বৈশাখ মাসে লন্ডনে বসন্তকাল। বাংলা থেকে বিদগ্ধ বহু শিল্পী গিয়েছেন হ্যাম্পস্টেডের উৎসবে যোগ দিতে। শিল্পপতি সত্যম রায়চৌধুরির উদ্যোগে হ্যাম্পস্টেডে চমৎকার কিছু অনুষ্ঠান হয়েছে। শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র, ইন্দ্রাণী সেন, সাংবাদিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেক শিল্পী-লেখক-অভিনেতা সেখানে গিয়েছেন। হ্যাম্পস্টেড থেকে একটু দূরে হ্যারোতেও নতুন বছরের উৎসব খুব জমজমাট হয়ে ওঠে। বাঙালির বৈশাখী উদ্দীপনায় যেন হ্যারোর ঠান্ডা নিঃস্তব্ধ পার্কগুলি উষ্ণ হয়ে ওঠে সেইসময়।
চিনে গিয়ে পয়লা বৈশাখ পালনের ধরন দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। চিনের রেস্তরাঁগুলোতে বাঙালি খাবার পাওয়া খুব মুশকিল বলে সাংহাই শহরের এক বাংলাদেশি দম্পতি পয়লা বৈশাখের দিন শরবত, আলুপোস্ত, ইলিশমাছ রান্না করে একবার খাইয়েছিলেন নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের তারপর নাকি তাঁদের চৈনিক কিছু বন্ধু সেইসব খাবার এতই পছন্দ করেন যে সেই বাঙালি দম্পতির সঙ্গে দুজন চিনের নাগরিক মিলে খুলে ফেলেন একটি রেস্তরাঁ। সেই রেস্তরাঁটিতে বেশিরভাগই খেতে আসেন চিনের মানুষ আর বিদেশি পর্যটক। কিন্তু সেখানে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালি খাবার। সেই রেস্তরাঁর নাম ‘বঙ্গভূমি’। আমি বেশ চমকে গিয়েছিলাম চিনের মাটিতে এইরকম বঙ্গভূমির কথা শুনে। সেখানে পয়লা বৈশাখে নাকি প্রতিবছর ঢাকা বা কলকাতা থেকে অন্তত একজন বাঙালি শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় গান গাইবার জন্যে।
এ-সব দেখে একটা কথা বুঝতে পেরেছি যে, উৎসবপ্রিয় বাঙালি যেখানেই যাক পয়লা বৈশাখ এলে একটা বাঙালিয়ানার পতাকা সেখানে সে ওড়াবেই, তা ধনতান্ত্রিক আমেরিকাই হোক বা সমাজতান্ত্রিক চিন!