ইয়া ডিজিটাল সর্বভূতেষু

টেকনোলজি টেক অফ করেছে বেশ কিছু বছর। এখন শুধু ডানা ছড়িয়ে গতি বাড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে আরও বেশি করে নিজেকে মেলে ধরার পালা। আমাদের দৈনন্দিন জীবন হোক বা বিশেষ দিন কিছুই বাদ পড়ে না এর হাত থেকে। টেকনোলজিই মিলিয়ে দেয় কিংবা মুছিয়ে দেয় মনখারাপও। এই পয়লা বৈশাখেও এমনটাই হবে আশা রাখছেন দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। 

Must read

শুভ নববর্ষ। এই যে শুভেচ্ছা সম্বোধনটা করলাম, সেটা লিখছি একটা ডিজিটাল মাধ্যমে। মানে লিখছি না। রেলের ইস্টিশনে বসে আমার ফোনকে গুনগুন করে বলছি আর সে কথাদের অক্ষরে বদলে নিচ্ছে তার ডিজিটাল পর্দায়। এরপর সংবাদপত্রের দফতরে এইটে যাবেও ডিজিটাল মাধ্যম বেয়ে। আর তারপর, যখন তা বের হবে তখন কাগজের গায়ে ছেপে বেরোবার পাশাপাশি ছবিটবিশুদ্ধ ডিজিটাল মাধ্যমেও দেখা দেবে সে, আর দুনিয়াশুদ্ধু মানুষ তাকে পড়ে ফেলবে নিজের নিজের ডিজিটাল পর্দায়। বিশ বছর আগে, এইটে ছিল সায়েন্স ফিকশান। দশ বছর আগে, খানিক খানিক সত্যি, তা-ও কিঞ্চিৎ নাক উঁচু এলিট মহলে। আর আজ? গোটা বাংলা জুড়ে সবার পকেটে পকেটে ঢুকে পড়েছে সর্বভূতেষু ‘ডিজিটাল’।

সেই নিয়ে কতই না নালিশ। কতই না হাহুতাশ, “যখন রাম রাজা ছিলেন, বাংলার সেই স্বর্ণযুগে কেমন মুখোমুখি আড্ডা হত আমাদের রকে বসে, আর আজকের জেন এক্স ওয়াই জেড মোবাইল মুখে… ছ্যা ছ্যা। এরা জীবনটাকে চিনতেই শিখল না।”

মজা হল, যাঁরা এই ব্যথার কাকলি শোনান তাঁরা কিন্তু প্রায়শই অফিসে কিংবা বাড়িতে বসে বসে কিংবা রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ডিজিটাল যন্ত্র হাতে ধরে ডিজিটাল (Digital) সমাজমাধ্যমেই এহেন ডিজিটালের নিন্দেমন্দ করছেন। ব্যাপারটা একদিক দিয়ে বেশ মজার। যে মাধ্যমের নিন্দে, সেই নিন্দেটাকে জনসমক্ষে আনতে গিয়েও সেই মাধ্যমেরই শরণাপন্ন হওয়া! এবং তারপর সেখানেই হাজারো তর্কেবিতর্কে ডিজিটাল আড্ডারুম চালু করা।

অর্থাৎ দোকান বাজার, ব্যাঙ্কিং, অ্যাপো, প্রেম, ঘৃণা, বিচ্ছেদ, ঠগবাজি, দুর্গা ঠাকুর দেখা, প্যান্ডেল হপিং— এই সবকিছুতেই ডিজিটাল জীবনযাপনের পাশাপাশি, ডিজিটাল ইউনিভার্সের নিন্দাবাদ করতেও সেই ডিজিটালকেই আশ্রয় করতে হচ্ছে বাঙালিকে এই মুহূর্তে। সর্বব্যাপী হয়ে ওঠবার প্রাথমিক শর্তটা এইভাবেই পূরণ করেছে ডিজিটাল (Digital) মাধ্যম। তার শত্রুতাটুকুও তাকেই আশ্রয় করে করতে হবে। সে বিনে নান্য পন্থা।

আসলে যেকোনও সামাজিক তুলকালামই জীবনের কিছু কিছু এলাকায় কিছু চিরস্থায়ী বদল নিয়ে আসে। সদ্য অতিক্রান্ত (?) অতিমারির তুলকালামটা আমাদের জীবনের বহু ক্ষেত্রেই সেই বদল এনে দিয়েছে। তার অধিকাংশই এখনও ততটা সুপরিস্ফুট নয়। ধীরে ধীরে আমরা তাদের টের পাব। কিন্তু যে বিষয়টা একদম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তা হল, ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে আমাদের যত দ্বিধা, যত প্রতিরোধ, যত সঙ্কোচ, তাকে একেবারে ধুয়েমুছে দিয়ে আমাদের পাকাপাকিভাবে ডিজিটাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে গেল এই অতিমারি। পরিকাঠামোটা আগে থেকেই ছিল। অভাব ছিল তার বিপুল সংখ্যক গ্রহীতার।

প্রাক্‌ অতিমারি সময়ে আমবাঙালির ডিজিটালচর্চা মূলত সীমাবদ্ধ থাকত ইমেইল, হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুকে উদ্দাম পিএনপিসিতে, বিনিপয়সার ই-পেপারে কিংবা বড়জোর টরেন্ট (বে-আইনিভাবে) বা ওটিটিতে (আইনিভাবে) চলচ্চিত্র ও সিরিয়ালচর্চায়। আর থাকত… ইয়ে মানে… ওই একটু আধটু ইয়ে ছবিটবি দেখা লুকিয়েচুরিয়ে… ওই তাইতে। এক টেকনোক্র্যাট ছোকরা যাকে আদর করে নাম দিয়েছিল ডিজিরক বা ডিজিটাল রকবাজি।

কিন্তু অতিমারিটা এসে চারটে বিরাট এলাকায় ‘ডিজিটাল’কে প্রচণ্ড শক্তিতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল আমাদের জীবনে। এক. শিক্ষা। দুই. কর্ম। তিন. লেনদেন। চার. পাঠাভ্যাস। বঙ্গজীবনের এই যে চার প্রধান অক্ষ বা অ্যাক্সিস, গত দু’বছরের ক্রমাগত গৃহবন্দিত্ব ও সামাজিক দূরত্ববিধি এই চার অ্যাক্সিসেই ডিজিটালকে সাদরে বরণ করে নিতে বাধ্য করেছে আমাদের।

কতটা সাদরে?

অতিমারির সময়ে শিক্ষা ও কর্মজীবনে ডিজিটাল মাধ্যমের সর্বব্যাপী প্রয়োগ নতুন করে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হল, স্কুল কলেজ চালু হয়ে গেলেও এখনও কিন্তু অনলাইন ক্লাস, অথবা অনলাইন অফিসের কাজকর্ম— বিষয় দুটোর জনপ্রিয়তা দিব্যি রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মত সঠিক হলে এ জিনিস থাকতে এসেছে। আগামী দিনে সশরীর স্কুল কলেজ ও অফিসকাছারির পাশাপাশি এদের একটা বড় অংশ কিন্তু ডিজিটাল থেকে যাবে। থেকে যাবে তার নিজস্ব পরিকাঠামোগত কিছু সুবিধের কারণে। যথা— ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ফলে খানিক ব্যয়সঙ্কোচ, যথা— এই মাধ্যমে কাজের বা ক্লাসের সময়ের স্থিতিস্থাপকতা, যথা— প্রকৃতির খামখেয়ালিতে রোদে-জলে-ঝড়ে এ-মাধ্যমের কার্যকরী থাকবার ও কার্যকরী রাখবার অসীম ক্ষমতা।

লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ২০১৯-’২০তে অতিমারি সূচনার সময় এদেশে ডিজিটাল পেমেন্টের মোট পরিমাণ ছিল ৪৫০০ কোটি টাকা। ২০২১-’২২-এ সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪২২ কোটি টাকায়। দু’বছরে ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি! অতিমারি চলে গেছে প্রায়, কিন্তু সে-সময়টা মোবাইলে যে গুগলপে/ফোনপে একরকম বাধ্য হয়েই ইনস্টল করেছিলেন, ‘আমি টেকনোলজি বুঝি না’ বলা মানুষটি তিনি কিন্তু সেটা আর ফোন থেকে আন ইনস্টল করেননি। সরে যাননি রাতে টিভি দেখতে দেখতে আরামে ইলেকট্রিসিটি বিলটা কিংবা ছেলের মাস্টারের মাইনেটাও ডিজিটালি পে করে দেবার সুবিধেটার থেকে।

হ্যাঁ, বাধা এসেছে। হঠাৎ বিপুল চাহিদার সঙ্গে প্রথমে পাল্লা দিতে পারেনি দেশের ডিজিটাল পরিকাঠামো। ব্যান্ডউইডথের অপ্রতুলতা (চলতি ভাষায় ‘পর্দায় চাকা ঘুরেই যায় ঘুরেই যায়’) ছিল শুরুতে। কিন্তু আমাদের আদতে ঘাত-সহ দেশি পরিকাঠামো সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব দ্রুত তার মোকাবিলা করেছে। আর বৌদ্ধিক প্রাচীনপন্থীদের নিন্দায় ভূষিত ‘ডিজিটাল’ নীরবে তার অন্নসংস্থান, সন্তানের শিক্ষা এবং জরুরি কেনাকাটায় অনলস, ক্লান্তিহীন সেবা করে গিয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কঠিন দিনগুলোতে। কেবল বাঁচিয়েই রাখেনি, কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জমে ওঠা তীব্র অসন্তোষ ও উষ্মার বাষ্পকে ক্রমাগত বের করে দেবার পথ করে দিয়ে সামাজিক সেফটি ভালভ হিসেবে অসামান্য অবদানও রেখেছে এই ডিজিটাল মাধ্যমই। এই দু’বছর জুড়ে ইনটেলেকচুয়াল, নন ইনটেলেকচুয়াল নির্বিশেষে সামাজিক মাধ্যমে অজস্র মানুষের বমি করে চলা অসন্তোষের হলাহলের সামান্য নমুনা পরীক্ষা করলেই সেটা টের পাওয়া যায়।

এ-যেন সেই ক্লাসিকাল বাংলা সিনেমার গল্প। সদ্য বিয়ে হয়ে ঘরে আসা পরের মেয়েটি প্রথমে এসেই হাজারো অসন্তোষ, অসম্মান, ঘৃণা, নির্দয় ব্যবহার, কর্কশ কথার মুখোমুখি হল। তারপর কোনও প্রতিবাদ না করে মুখটি বুজে দুটি বছর শ্বশুরকুলের সেবা করবার পর অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছায় শ্বশুরকুল স্বীকার করে নিলেন বউটি ভালই তো! বেশ কাজের। (যদিও আগের বউটির মতো অত ভালো নয়!)

তা আমাদের বাংলার ঘরে কিছুকাল হল আসা ডিজিটাল মাধ্যমকেও শুরুতে এই অসূয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শুরুতে সে ছিল বাড়ির লোকের খানিক মজা, খানিক রাগটাগ প্রকাশের পাত্রী। কমবয়েসিদের খানিক কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। তার বেশিকিছু নয়। তারপর অতিমারির দু’বছরের অনলস সেবা, গুরুতর পারিবারিক বিষয়গুলোতেও তার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে তার বাড়ির লোকজনকে। নিমরাজি হয়েও স্বীকার করতে হয়েছে তাঁদের যে, এর প্রয়োজন আছে।

এই স্বীকৃতির সেরা উদাহরণ বোধ হয় আমাদের চুরানব্বই ও ছিয়াশি বছরের বাড়িওয়ালা দম্পতি। সন্তানরা তাঁদের দিল্লি ও বিলেতে ছড়িয়ে আছেন। দূরপাল্লার সাপ্তাহিক ফোন কল আগে তাঁদের একমাত্র যোগসূত্র ছিল। ইদানীং রাতে খাবার সময় ওপর থেকে গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারি মহাদেশীয় দূরত্বের দুপাশে বসে বাপ-মা ও সন্তানরা ডিজিটাল সেতুতে দাঁড়িয়ে শেয়ার করে নিচ্ছেন নিজেদের ডাইনিং টেবিলকে। খাওয়াদাওয়া হতে হতেই খোশগল্প চলেছে মহাসাগরের তলা দিয়ে যাওয়া কেবল কিংবা মহাকাশে বসে থাকা উপগ্রহে ভর করে।

আর এমনি করেই অতিমারির দুটো বছর কেটে গিয়ে এবারে ফের একটা মুক্ত নববর্ষ এল। এবারে আবার নববর্ষে কলেজ স্ট্রিট জমে উঠবে, জমে উঠবে গোটা বাংলা জুড়েই অজস্র আনন্দ উৎসব। মুখোমুখি গা- ঘেঁষাঘেঁষি আনন্দের স্বাদ ফের পাব আমরা। কিন্তু ওরই মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেক বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় তাঁর বিদেশবাসী ছেলে বা মেয়েটাকে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে দেখিয়ে দেবেন কেমন সুন্দর মেলায় সেজে উঠেছে কলেজ স্কোয়্যারের মাঠ, অথবা দেখে নেবেন লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের কোনও বঙ্গীয় বর্ষবরণের উৎসবে কেমন সুরেলা গান ধরেছে তাঁর নাতনিটি। বহু তরুণ তার হাতে ধরা মোবাইল ফোনের অ্যাপে নতুন কোনও বইয়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে আরেকখানা অ্যাপে বুক করে নেবে বাড়ি ফেরবার গাড়িটাকে। কফি হাউসের জমজমাট আড্ডার মধ্যে কোনও তরুণী হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিককে বলবে, “আজ যাই, খানিক বাদে একটা পডকাস্ট আছে রে!” যতই নিন্দে করি আর অবিশ্বাস করি, এই নববর্ষে ডিজিটাল মাধ্যম যেন আর এক বোরোলিন— ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ।’

Latest article