বাঙালির তিনটি প্রধান উৎসব হল বাংলা নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি এবং শারদীয় দুর্গোৎসব। একুশে এবং নববর্ষ পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ। দুর্গোৎসবে সামান্য ধর্মানুষঙ্গ থাকলেও উৎসব হিসেবে তার প্রধান প্রবণতা ধর্মকে ছাপিয়ে সবার উৎসবে ব্যাপ্তিলাভ। ধর্ম মানুষের নিজের-নিজের কিন্তু উৎসব সবার। কথাটা ষোলো-আনা খাঁটি। উৎসবের অংশে সব ধর্মের মানুষ মিলিত হয়ে এক আশ্চর্য সমন্বয় গড়ে তোলে। মানুষকে যেখানে আমরা আনন্দের সঙ্গে মেলাতে পারি তেমন উৎসবকেই আমরা সর্বজনীন নাম দিয়েছি। আমি নিজে ‘সর্বজনীন’ না বলে ‘সার্বজনীন’ বলার পক্ষপাতী। সার্বজনীন মানে হল সবার মঙ্গলদায়ী, দুর্গোৎসবকে বাঙালি মুসলমান সমাজও সবার সঙ্গে এক করে নিয়েছে। এটি ওই উৎসবের সবচেয়ে বেগবান সার্থকতা।
একুশে ফেব্রুয়ারি তো বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যের উৎসব। আরও দুটি উৎসবকে সেই সঙ্গে জুড়তে হবে। বড়দিন ও ইদের উৎসব। রমজানের শেষে যে ইদ, আমি তার কথা বলছি। ছেলেবেলায় গ্রামে এই উৎসবে হিন্দু বাঙালির অংশ গ্রহণ বেশ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ত। সেটি কোনও কারণে ইদানীং কিছুটা কম-কম লাগে। আমাদের শ্রদ্ধেয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি উৎসাহিত করেন, তাহলে ঈদও একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়, বড়দিনও সবার মিলিত উৎসাহে পালন করা উচিত— এ ব্যাপারে বাঙালির উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। এই সবই বাঙালির সমন্বয় ভাবনার পথ। নববর্ষকেও বরণ করতে হবে বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পার্বণ হিসেবে নতুন করে।
বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবরের আমল থেকেই হিন্দু-মুসলমান সবার উৎসব। হালখাতার (Pahela Boisakh) পরবকে কলেজ স্ট্রিট পাড়া গোড়ার দিকে বই-উৎসবের মর্যাদা দিত। বইমেলার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় বাংলা নববর্ষের বই প্রকাশকে ঘিরে উৎসব-উৎসব ভাবটা কিছু আলগা-আলগা হয়েছে, সেটাকে আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলা নববর্ষকে করা হোক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ, অত্যন্ত বাছাই বই প্রকাশ করার উৎসব। সেই সঙ্গে গ্রন্থের ভিতর দিয়ে বাঙালির সমন্বয় ভাবনাকে তুলে ধরার উৎসব। বই প্রকাশে কোয়ালিটি আনা হোক বাংলা নববর্ষে (Pahela Boisakh)। বিষয়-ভাবনায় ও গ্রন্থনায় এবং মলাটে।
আন্তর্জাতিক বইমেলায় হোক গ্রন্থ-বৈচিত্র্যের সমারোহ, বাংলা নববর্ষে হোক কোয়ালিটি-বই আর বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের উজ্জ্বল-উদ্ধার-প্রকল্প-সাধিত উৎসব।
বাঙালির একটি বদনাম শোনা যায় আর তা হচ্ছে, বাঙালি বিস্মৃতি-পরায়ণ জাতি, অতীত-সংরক্ষণে যে সারস্বত জেদ লাগে— এ জাতির সেটা নেই। কথাটা কোনও নবীন জাতির গড়ে ওঠার গোড়ার দিকে কিয়দংশে খাটে, কিন্তু দেখতে দেখতে বাঙালি ভাষা-প্রজাতি হিসেবে যথেষ্ট সেয়ানা হয়েছে, তাকে এখন ঐতিহ্য-সংরক্ষণে মন দিতে হবে— তার ইতিহাস-চেতনাকে বলবান করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক তাঁদের অগ্রণী হতে হবে। যদিও নবীন ভাবনার প্রকাশ ব্যাপারে নবীন প্রকাশকেরাও নিতে পারেন উদ্যোগ।
বাঙালির লোক-উৎসবগুলির মধ্যে যে সমন্বয়বাদী সুর রয়েছে, তার উপর নিবিড় গবেষণা জরুরি, যত হয়েছে, তার সংরক্ষণ চাই, তাকে গ্রন্থবদ্ধ নতুন চেহারা দিতে হবে এবং নবতর পদক্ষেপও নেওয়া চাই, সংগ্রাহক-লেখকদের জন্য প্রকাশনার নতুন পরিসর দিতে হবে। নতুন যুগ আসন্ন, তাই বাঙালির ইতিহাস-চর্চা জরুরি, আমরা ভাষা-জাতি কিংবা বলা যায়, বাঙালি ভাষা-প্রজাতি। এই জাতির নৃগোষ্টিক-পরিচয় বা উৎপত্তি-পরিচয় বুঝতে হলে ভাষা-বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হয়। এমনটাই বিহিত করেছেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। আর্যরাও ভাষা-জাতি ছিলেন, অনার্যরাও ভাষা-জাতি ছিলেন। বাংলার সমাজে আর্য-অনার্য মিশে গিয়েছে— বাংলায় শূদ্ররাও কিয়দংশ অনার্য। বঙ্কিমচন্দ্রের আমল পর্যন্ত ব্রাহ্মণরা বিশুদ্ধ আর্যজাতি হিসেবে স্বতন্ত্র থাকতেন, ধীরে ধীরে সেখানেও মিশ্রণ ঘটেছে— বাঙালি মুসলিমরা সমাজের নিম্নস্তর থেকে বহাল হয়েছে, তারও উৎপত্তি হিন্দু থেকেই। বাংলার মুসলমান বাইরে থেকে আসেনি, বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন— ‘‘বাঙালিসমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালি অনার্য ও মিশ্রিত আর্য ও বাঙালি মুসলমান।”
বিশুদ্ধ আর্যত্ব আজ আর বাংলায় নেই। আর্যত্বের গুমোরও মিলনের আকুতির মধ্যে দ্রব হয়ে মিশে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথও আমাদের রক্ত ও বোধের ভিতরে একটি সজাগ অনুভূতি দান করবার জন্য মনে করাতে চেয়েছেন এ কথা যে, ‘‘বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে, একথা আমরা যেন না ভুলি।’’
রক্তের সম্বন্ধ সত্য বলে জানলে মিলন সহজ হয়। জাতি হিসেবে আমরা এক, ভাষাও আমাদের এক, সাহিত্যও আমাদের মিলনক্ষেত্র। তা হলে বাধা কোথায়? হিন্দু আর মুসলমান একই বৃন্তের জোড়াফুল— একই মাটি থেকে একই শিকড়বাহিত হয়ে ফুটে উঠেছে সেই ফুল দুটি একই রসের প্রবাহে। কোনও বিদ্বেষ বা ঘৃণা যেন আমাদের বিচ্ছিন্ন না করে। নববর্ষে এই দোয়া ও প্রার্থনা বাংলার মহাপ্রকৃতির কাছে, পয়লা বৈশাখ এখনও বসন্তকে চলে যেতে দেয়নি। বসন্তেই নববর্ষ উদ্যাপন করে বাঙালি। নিসর্গ-প্রকৃতি ক্যালেন্ডার মানে না, মানে নিজের নিয়ম। দেখুন, কোকিল এখনও ডাকছে।