সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে (Soumitra Chatterjee) নিয়ে ডকু-ফিচার বানানোর ভাবনাটা সায়ন্তনের মাথায় এসেছিল ২০১৩ সালে প্রথম যখন লেজেন্ড-এর সঙ্গে কাজ করেন তাঁর ‘অদ্ভুত’ ছবিতে। শ্যুটিং-এর ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা-কথায় সায়ন্তন মুগ্ধ হয়ে শুনতেন অভিনেতার আত্মদর্শন-কাহিনি। সে যেন সত্যি একটা সফর। একা যাত্রী হতে মন চায় না। শরিক যাতে সবাই হয় তাই প্রস্তাবটা তখনই পেড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু স্বভাব-লাজুক অন্তর্মুখিতায় এড়িয়ে গিয়েছিলেন শিল্পী। সায়ন্তন হাল ছাড়েননি। কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন। আর এভাবেই কখনও স্বয়ং সৌমিত্র, কখনও কন্যা পৌলমী, পুত্র সৌগতর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন আলাপচারিতা চলত। আর ভাবনাটা জোরদার হত। তারপর শুরু সিরিয়াস রিসার্চ ওয়ার্ক আর চিত্রনাট্য লেখার কাজ। এ-কাজে সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন পৌলমী। কিন্তু স্বয়ং সৌমিত্র তো চূড়ান্ত ব্যস্ত। ছবির শ্যুটিং ছাড়াও আছে থিয়েটার, মহড়া, লেখা, ছবি আঁকা এবং আরও অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য। এভাবেই চলছিল। সুযোগ এনে দিল ২০২০-র কোভিড-কাল। জীবিত থাকাকালীনই অভিনেতা নানা সময়ে বলেছেন, কর্মহীন, ব্যস্ততাহীন এ-সময়টা তিনি মোটেও ভাল কাটাননি। ব্যস্ত থাকার অনেক উপায়ও তাঁকে ভাল রাখতে পারেনি। হয়তো একা থাকার এই সময়টাতেই তিনি পেয়েছিলেন সময় ফুরনোর ইঙ্গিত। নাহলে নিজেই কেন মেয়েকে ডেকে বলেছিলেন, “তোরা কাজটা করে নে এইবার, আমার অনেক কিছু বলে যাওয়ার আছে!”
‘‘উনি বলা মাত্রই কাজে লেগে পড়েছিলাম আমরা। চিত্রনাট্যের কাজ আমি আর পৌলমীদি অনেকটাই রেডি করে রেখেছিলাম। কিন্তু ওই অল্প সময়ের মধ্যে প্রোডিউসার পেয়ে পুরোটা এক্সিকিউট করা সোজা ছিল না। অরিন্দম চ্যাটার্জি সে-সময় এগিয়ে না এলে সম্ভব হত না হয়তো। আমরা তাই ওঁর কাছে খুব কৃতজ্ঞ। এ-ছাড়াও রাজ্য সরকারের তরফেও পেয়েছিলাম প্রচুর সহযোগিতা। সৌমিত্রবাবুর ওপর কাজ হচ্ছে শুনে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী মাননীয় ইন্দ্রনীল সেন অনেক সাহায্য করেছিলেন। ভরতলক্ষ্মী স্টুডিওর জ্যোতি চৌখানিও তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে কাজটা যে আমরা করে ফেলতে পেরেছিলাম এটাই আমাদের বিরাট প্রাপ্তি’’ জানালেন সায়ন্তন। দু ঘণ্টা ঊনচল্লিশ মিনিটের এই ডকু-ফিচারটিতে মূলত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আপাত-অপরিচিত দিকগুলির ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছে। বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটির ভাবনা, জীবনদর্শন, আদর্শ, রাজনৈতিক চেতনা— যা বলে যেতে তিনি নিজেই উন্মুখ ছিলেন শেষ দিকে। সে-ছাড়াও সায়ন্তন ধরেছেন আরও অনেক দিক, নিঃসন্দেহে যার আর্কাইভাল ভ্যালু আজীবনের।
আরও পড়ুন-লক্ষ্যপূরণ হয়নি, তবু রেলে বিলগ্নীকরণের জেদ কেন্দ্রের
“আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক মহাতারকা হলেও তাঁর থিয়েটারের দিকটিতে আলোকপাত তুলনামূলক যেমন কম হয়েছে তেমনই তিনি নিজেও তাঁর অনেকদিক নিজেই আড়ালে রেখে চলতে ভালবাসতেন। তাঁর লেখালিখি, কবিতা, ছবি আঁকা এসব ছিল নিজস্ব অবসরের একান্ত যাপন। আমি সেগুলোয় আলোকপাত করেছি। যেমন, সবাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্ক নিয়ে বলেন কিন্তু শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তা অতটা চর্চিত নয়। সিনেমায় অভিনয় তাঁকে তারকা বানিয়েছিল কিন্তু নিজে মনে-প্রাণে শেষদিন অবধি একজন একনিষ্ঠ থিয়েটার কর্মী হিসেবেই বেঁচে ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামটা ব্যবহার করতেন থিয়েটারের হল ভরানোর জন্য, আসল উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল দর্শকদের একটা উচ্চমানের শিল্প-প্রদর্শন। ছবির জন্য থিয়েটারে সেভাবে সময় দিতে পারেননি পরবর্তীতে কিন্তু এ নিয়ে চরম আক্ষেপ ছিল তাঁর।”
এ-ছাড়াও ছিল তাঁর কবিতার জগৎ। তাঁর প্রিয় কবি বন্ধুরা সুনীল-শক্তি বিশ্বাস করতেন শুধু মাত্র যদি কবিতা চর্চাই করতেন সৌমিত্র সমমানেরই একজন কবি হয়েই মানুষের মনে জায়গা করে নিতেন। কিন্তু এ নিয়ে তাঁকে কিছু বলতে গেলেই ফের সেই লাজুক বিনয়ী হাসি, নিজেকে আড়াল করা। বরং বলতেন নিজের ছেলের কথা, “আমি তো শখের কবি। কবি তো বুবু (সৌগত চট্টোপাধ্যায়)। ওর কবিতার মানের ধারে-কাছে আমি নই। নিজের জন্য লিখি সামান্য।” আর এই কবিতার খাতায় কাটাকুটি আঁকিবুঁকি করতে গিয়েই ছবি আঁকার হাতে খড়ি। পরে অনুপ্রেরণা ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ওঁর খেরো খাতায় চিত্রনাট্যের সঙ্গে স্কেচ দেখার প্রভাব পড়েছিল সৌমিত্রর মনেও। “সব সময় একটা খাতা থাকত ওঁর সঙ্গে। তাতে শ্যুটিং-এর ফাঁকে, কাজের অবসরে লেখা, আঁকা চলত। যথারীতি এটাও নিজে সিরিয়াসলি নেননি। পরের দিকে উৎসাহ হওয়ায় স্কেচ ছেড়ে অ্যাক্রেলিক, জল রং-এ আঁকা শুরু করেন। সে-সবও তোলা থাকত ব্যক্তি পরিসরেই। বন্ধু যোগেন চৌধুরী আবিষ্কার করেন একদিন আর তাঁর জহুরির চোখ বোঝে এ শুধু শখ নয়, এ একজন পুরোদস্তুর শিল্পীর হাতের কাজ। জোর করে তিনিই এক প্রদর্শনী করান।” সায়ন্তন জানালেন। এ-সব গল্পই রয়েছে ডকু-ফিচারের সিংহভাগ জুড়ে।
“আসলে, বলা যেতে পারে, এটা সৌমিত্রবাবুর (Soumitra Chatterjee) আনটোল্ড স্টোরি! আমাকে যখন সায়ন্তন বলল কাজটার কথা, প্রথমেই যেটা মনে হয়েছিল, এরকম একজন স্টলওয়ার্টের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটাই ভাগ্যের। তাই এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবা যায় না ওরকম একজন মানুষ, স্টুডিও ফ্লোরে দেখা হলেই সবার আগে নমস্কার করতেন। ক্রিকেট নিয়ে কত আড্ডা হত।” বললেন প্রযোজক অরিন্দম চ্যাটার্জি। বাদ পড়েনি স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিল্পীর ‘পোয়েটিক’ সম্পর্কের দিকটিও। শেষ বয়স অবধি দু’জন প্রেমে ছিলেন। নিজের সব লেখা, আঁকা সবার আগে স্ত্রীকেই দেখাতেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বাইরে ছিলেন পরস্পরের প্রিয়তম বন্ধু। একই রকম সম্পর্ক ছেলে-মেয়ের সঙ্গেও। মহাতারকা হয়েও যে মাটির কাছাকাছি থাকা যায় তার সেরা উদাহরণ ছিলেন সৌমিত্র।
এ-সব কিছু নিয়েই তথ্যচিত্রে নিজেদের মতো করে বলেছেন সন্দীপ রায়, যোগেন চৌধুরী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল সেন, কৌশিক সেন, দেবশঙ্কর হালদার, অতনু ঘোষ, শিলাদিত্য সেন, অনিরুদ্ধ ধর, বিলু দত্ত, সর্বোপরি দীপা চট্টোপাধ্যায়, সৌগত চট্টোপাধ্যায়, পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। জীবনের শেষ শট সৌমিত্র দিয়েছেন তাঁর জীবন আধারিত এই ডকু-ফিচারেই। প্রয়াণের দিন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পীর শেষযাত্রায় পুরো পথ হেঁটে শশ্মানে পৌঁছেছিলেন। সায়ন্তন ছবিতে সেটাও ব্যবহার করেছেন সুন্দর ভাবে। ফেস্টিভ্যাল কমিটি চেয়েছিলেন ডকু-ফিচারের মুক্তি এখানেই হোক। কিন্তু এ-ছাড়াও জাতীয় পুরস্কারের জন্য ও অন্যান্য ফেস্টিভ্যালে পাঠানো হবে ‘আমি সৌমিত্র’।