রাতুল দত্ত: রাখির রক্ষা বন্ধন উৎসব, প্রতি বছর শ্রাবন মাসের পূর্ণিমার দিন ভাইবোনের মধ্যকার স্বর্গীয় সম্পর্ক উদযাপনের উৎসব। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ১৯০৫-এর সেদিন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়েছিলেন রাখি বন্ধনের উৎসব পালনের ডাকে । কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট (অবিভক্ত বাংলা) থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোনকে রবিকবি সেদিন আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য। শ্রাবণ মাসে হিন্দু ভাইবোনদের মধ্যে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন।
এটা যদি হয়, সেদিনের বাস্তব ঘটনা; পৌরাণিক মতে, বোনেদের কাছে এই দিন ভাইদের মঙ্গল কামনার দিন। কোনও বোন বা দিদি যেমন তার ভাইয়ের কোনও রকম কষ্ট, অমঙ্গল সহ্য করতে পারে না; ভাইয়ের কষ্ট দুর করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তেমনি ভাইও তার বোনকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করে, সারাজীবন তাঁকে রক্ষা করে যায়, যে রকম শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রাজসভায় চরমতম কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই আজও মনে করা হয়, পরিবেশে যম বা দুষ্টু ও অশুভ তত্ত্ব বেশি থাকলে ভাইয়ের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রাখি বন্ধনের ফলে তা দূর হয়ে যায়। রাখী পূর্ণিমাকে ঘিরে তাই তৈরি হয়েছে নানান পৌরাণিক কাহিনি।
আরও পড়ুন- সম্প্রীতির আবহে শোকের পরব
পুরাণে সুভদ্রা কৃষ্ণের ছোট বোন, কৃষ্ণ সুভদ্রাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তবে আপন বোন না হয়েও দ্রৌপদী ছিলেন কৃষ্ণের অতীব স্নেহভাজন। একদিন সুভদ্রা কিছুটা অভিমান ভরে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, এর কারণ কী। উত্তরে কৃষ্ণ জানান, যথা সময়ে এর কারন তুমি বুঝতে পারবে। এর কিছুদিন পর শ্রীকৃষ্ণের হাত কেটে রক্ত ঝরছিল। তা দেখে সুভদ্রা রক্ত বন্ধ করার জন্য কাপড় খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথাও কোনও পাতলা সাধারণ কাপড় পাচ্ছিলেন না। এর মাঝে দ্রৌপদী সেখানে এসে দেখেন কৃষ্ণের হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। সেই ঘটনা দেখামাত্রই বিন্দুমাত্র দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুল্যবান রেশম শাড়ি ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাত বেধে দেন। কিছুক্ষণ পর রক্তপাত বন্ধ হয়। এতে কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে যান। তিনি বোন সুভদ্রাকে ডেকে বলেন-এখন বুঝতে পেরেছ কেন আমি দ্রৌপদীকে এত স্নেহ করি? সুভদ্রা তখন বুঝতে পারলেন, ভক্তি ও পবিত্র ভালবাসা, শ্রদ্ধা কী জিনিস! দাদা কৃষ্ণের চেয়ে মুল্যবান বস্ত্র নিজের কাছে বেশি প্রিয় বলে নিজের বস্ত্র ছিঁড়তে পারেননি, এটা ভেবে সুভদ্রা দারুণ লজ্জিত হয়ে পড়েন। দ্রৌপদী তাঁর অনাত্মীয়া হলেও, তিনি দ্রৌপদীকে নিজের বোন বলে ঘোষণা করেন এবং দ্রৌপদীকে এর প্রতিদান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বহু বছর পরে, পাশাখেলায় কৌরবরা দ্রৌপদীকে অপমান করে তাঁর বস্ত্রহরণ করতে গেলে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করে সেই প্রতিদান দেন। এইভাবেই কৃষ্ণ-দ্রৌপদীর মধ্যে রাখীবন্ধনের প্রচলন হয়।
আরও পড়ুন- ভাইবোনের সম্প্রীতির রাখিতে বাঁধা বাংলা, সিংহ গর্জনই থমকে দেবে ভাঙার অপচেষ্টা
রাখির পুরাণের গল্পে আছে গণেশও। বলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র জয় সন্তোষী মা-এ (১৯৭৫) রক্ষাবন্ধন সংক্রান্ত একটি গল্প বলা হয়েছে। রাখীবন্ধনের দিন গণেশের বোন গণেশের হাতে একটি রাখি বেঁধে দেন। এতে গণেশের দুই ছেলে শুভ ও লাভের হিংসে হয়। তাদের কোনও বোন ছিল না। তারা বাবার কাছে একটা বোনের বায়না ধরে। গণেশ তখন তাঁর দুই ছেলের সন্তোষ বিধানের জন্য দিব্য আগুন থেকে একটি কন্যার জন্ম দেন। পুরাণমতে, এই দেবী হলেন গণেশের মেয়ে সন্তোষী মা। সন্তোষী মা, শুভ ও লাভের হাতে রাখি বেঁধে দেন।
অন্য একটি গল্পে রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভীষণ ভক্ত। বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন। লক্ষ্মী বলিকে বলেন, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। যতদিন না স্বামী ফিরে আসেন, ততদিন যেন বলি তাঁকে আশ্রয় দেন। বলিরাজা ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দিতে রাজি হন। শ্রাবণ পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। মনে করা হয়, সেই থেকেও শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।
আরও পড়ুন- আল-কায়েদা ঘনিষ্ঠ হাক্কানি জঙ্গিরাই এখন কাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্বে
ঐতিহাসিক ঘটনায় মহামতি আলেকজান্ডার ও পুরু রাজার মধ্যে, রাখি নিয়ে একটি ঘটনার কথা জানা যায়। ইতিহাস অনুসারে, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। বীর পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুনের মধ্যেও রাখির একটি ঘটনা, ইতিহাসের পাতায় আছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাখী পাঠানোর গল্পটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। শোনা যায়, চিতোরের রানি কর্ণবতী নাকি ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। ঘটনাটা হল, গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রানি কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। রানি কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য পাঠালেন। তবে সেদিন, হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রানির দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ, রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। খবর কানে পৌঁছল, মুঘল সম্রাটের। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখী প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না।