বীরভূম জেলার কালিকাপুর কলোনি। বোলপুর স্টেশনে নেমে রাঙামাটির পথ পেরিয়ে যেতে হয় এই অঞ্চলে। কুটিরশিল্পের জন্য অঞ্চলটির যথেষ্ট সুনাম আছে। এইখানেই থাকেন শিল্পী আশুতোষ ভট্টাচার্য। এলাকায় তাঁর পরিচিতি আশুবাবু নামে। সাদামাটা তাঁর জীবনযাপন। বাতিল জিনিসপত্র দিয়ে তিনি তৈরি করেন অপরূপ শিল্পকর্ম। ছেলেবেলা থেকেই নিজেকে প্রকা করতে চাইতেন। মাটি দিয়ে গড়তেন মূর্তি। সাদা পাতায় আঁকতেন ছবি। একটা সময় তাঁর মনে হল— ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার পরে তার উপর রং লাগাতে হয়। রং কিনতে অনেক খরচ। তখনই তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে বের করলেন নতুন উপায়। যে–সব জিনিস কাজে লাগে না, সে–সব জিনিস দিয়ে তিনি বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী তৈরি করতে শুরু করলেন। খড়, সর, গমের কাঠি, তালপাতা, খেজুরপাতা, পাটকাঠি ইত্যাদি হয়ে উঠল তাঁর শিল্পের কাঁচামাল। কারণ এই জিনিসগুলো সহজলভ্য। পাশাপাশি ইকো ফ্রেন্ডলি। আশুতোষবাবু বললেন, আমি বাতিল জিনিস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরি করেছি। যেমন ব্যাগ, ব্যাজ, কলমদানি, গ্রিটিংস কার্ড, বিয়ের কার্ড, মেনু কার্ড, স্মারক, চাঁদমালা ইত্যাদি। পাশাপাশি নিজের শিল্পকর্ম দিয়ে সাজিয়েছি দুর্গাপুজোর মণ্ডপ। একদিন মনে হল, রাখি বানালে বেশ হয়। সেই শুরু।
আরও পড়ুন-জোটের ভরকেন্দ্র জননেত্রী, বাংলাই এবার পথ দেখাবে দিল্লিকে
তাঁর তৈরি রাখি পেয়েছে বহু মানুষের সমাদর। এখনও তিনি রাখি তৈরি করেন। তবে আগের মতো আর একার হাতে কাজ করেন না। এলাকার মা–বোনেদের নিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন একটি দল। কথাপ্রসঙ্গে আশুতোষবাবু জানালেন, আমি রাখি তৈরি করি মূলত খড় দিয়ে। সোনার রঙের অবহেলিত খড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে। সেটাকেই আমি আমার শিল্পে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। তারসঙ্গে ব্যবহার করি অন্যান্য কাঁচামাল। জেলার বাজারে আমার তৈরি রাখির যথেষ্ট কদর আছে। উৎসবের মরশুমে বহু ক্রেতা লাইন লাগান। মা–বোনেরা রাখি তৈরি করে সামান্য হলেও উপার্জন করছেন। আমি তাঁদের শিখিয়েছি। এখন তাঁরা ধরে ধরে যত্ন নিয়ে কাজ করেন। যত বেশি রাখি তৈরি হয়, তত বেশি উপার্জন। পাঁচ টাকার রাখির পাশাপাশি আমাদের কাছে পাবেন একশো টাকার রাখি। তবে বেশি দামের রাখির চাহিদা খুব কম। অর্ডার পেলে তবেই বানানো হয়। পাঁচ–দশ টাকার রাখির চাহিদাই বেশি। বীরভূম জেলার বেশকিছু দোকানদার আমার কাছে রাখি কেনেন এবং বিক্রি করেন। ভবিষ্যতে আমার রাখি সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।
শুধু দোকানে নয়, মেলাতেও বিক্রি হয় তঁাদের রাখি। আশুতোষবাবু বললেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প মেলায় আমরা অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের কাজ ঘিরে কলকাতার মানুষের উৎসাহ দেখে অবাক হয়েছি। স্টল দিয়েছি শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলাতেও। রাখি ছাড়াও আমরা নিজেদের তৈরি অন্যান্য শিল্পকর্মও মেলায় সাজিয়ে বসি। খুব ভালো বিক্রি হয়।
রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময় পাশে থেকেছে তাঁদের। আশুতোষবাবু জানালেন, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতির সাক্ষরতা দিবসে ৩০ হাজার রাখির অর্ডার পেয়েছিলাম। জেলা পরিষদের মাধ্যমে এসেছিল সেই অর্ডার। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ সহ অন্যান্য প্রয়োজনে আমাদের রাখি নিয়ে যাওয়া হয়।
আশুতোষবাবুর তৈরি শিল্পকর্ম বিভিন্ন সময় প্রশংসিত হয়েছে বহু বিশিষ্ট মানুষের কাছে। তিনি জানালেন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশংসা পেয়েছি। তঁাদের হাতে উঠেছে আমার তৈরি শিল্পকর্ম। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার তৈরি খড়ের শিল্পকর্ম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওকে উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়াও পেয়েছি বেশ কিছু পুরষ্কার, সংবর্ধনা এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। যখন আমার তৈরি রাখি কারও হাতে বঁাধা অবস্থায় দেখি, তখন মন আনন্দে নেচে ওঠে। মনে হয় পরিশ্রম সার্থক। সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমিও বহু মানুষের হাতে বেঁধে দিয়েছি নিজের তৈরি রাখি। এটুকু বলতে পারি, বাজারের আর পঁাচটা রাখির সঙ্গে আমাদের রাখির তফাত আছে। যঁারা দেখেছেন, তঁারা সেটা ভালোমতোই জানেন।
করোনার কারণে এই বছরে রাখির বাজারে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। গতবছরেও পরিস্থিতি একইরকম ছিল। আশুতোষবাবু বললেন, খুচরো বিক্রি আছে। তবে স্কুল, কলেজ বা বিভিন্ন সংস্থার বড়ো বড়ো অর্ডার এই মুহূর্তে বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আবার রাখির বাজারে জোয়ার আসবে। মনে রাখতে হবে, রাখির বাজার কিন্তু সারা বছরের নয়। নির্দিষ্ট সময়ের। অবশ্য এখন রাখিপূর্ণিমা ছাড়াও বেশকিছু সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক উৎসব অনুষ্ঠানে রাখির প্রয়োজন পড়ে। যখন রাখির চাহিদা থাকে না, তখন আমরা অন্যান্য জিনিস তৈরি করি। এইভাবে মোটামুটি সারা বছর ধরেই চলে আমাদের কাজ।
আরও পড়ুন-বিদেশি লিগে খেলতে দিলে ঘরোয়া ক্রিকেট জৌলুস হারাবে : সাবা করিম
বিভিন্ন জিনিস তৈরি করলেও, রাখিই বেশি তৃপ্তি দেয় শিল্পীকে। আশুতোষবাবু বললেন, রাখিবন্ধনের মধ্যে লেগে থাকে ভালোবাসার স্পর্শ। তাই ভার্চুয়াল যুগেও তার কদর একটুও কমেনি। রাখিপূর্ণিমার দিন বোন ভাইয়ের হাতে রাখি বেঁধে দেন। এটা আমাদের প্রচলিত রীতি। পাশাপাশি সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরিতেও রাখির বড়ো ভূমিকা আছে। ফেরা যাক অতীতে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখিবন্ধনের মধ্য দিয়ে একতার বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি গান গাইতে গাইতে রাখি বেঁধেছিলেন মুসলমান ভাইদের হাতে। রাখি মিশে আছে বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানেও। বিপদতারিনী পুজো, ষষ্ঠী পুজো বা বিয়ের সময় হাতে যেটা বাঁধা হয়, সেটাও কিন্তু রাখি। ফলে বোঝা যাচ্ছে রাখির আছে বিভিন্ন রূপ। অবাঙালিদের মধ্যেও রাখির প্রচলন আছে। তাঁরা বলেন, রক্ষাবন্ধন। অনেকেই বন্ধুর পাশাপাশি শত্রুর হাতে রাখি বেঁধে দিয়ে সম্পর্কে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। তাই রাখির গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। রাখি নিয়ে আমার বেশকিছু পরিকল্পনা আছে। আশাকরি আগামী দিনে সে–সব বাস্তবায়িত হবে।