জোটের ভরকেন্দ্র জননেত্রী, বাংলাই এবার পথ দেখাবে দিল্লিকে

২০২৪-এ যে প্রদীপ জ্বলবে, তার সলতে পাকানো শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সূত্রে স্মৃতির সরণিতে টুকরো টুকরো ছবি। অতীতের অ্যালবাম ঘেঁটে আগামীর ইঙ্গিত খুঁজে নিয়েছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Must read

প্রধানমন্ত্রী তখন নরসিংহ রাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেবার প্রথম মন্ত্রী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষা, ক্রীড়া, যুব কল্যাণ, শিশু ও নারী কল্যাণ মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন অর্জুন সিংহ। তাঁর প্রতিমন্ত্রী হলেন তিনি। এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম এলাহাবাদ সফরে। একরাত্রি সেখানে ছিলাম আমরা। সরকারি কিছু কর্মসূচি ছিল। কিন্তু মমতা মমতাই। এলাহাবাদে যখন এসেছি তখন ত্রিবেণী সঙ্গম দেখব না তা কী করে হয়? সুতরাং প্রথমে ত্রিবেণী সঙ্গম, তারপর স্থানীয় প্রখ্যাত কালীবাড়ি, এসবই আমরা দেখলাম। পরদিন জনসভা এবং অন্যান্য কর্মসূচি সেরে আমরা দিল্লিতে ফেরার ট্রেনে উঠলাম। এখনও বেশ মনে আছে, সেই সময়, যে কর্মসূচিতে গেছি বা যে অনুষ্ঠানে গেছি, দেখেছি কীভাবে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আইডেন্টিফাই করছে। মানুষ মানে আমজনতা। এমনকী স্টেশনে যখন ট্রেনে উঠছি তখনও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকারী রতন মুখোপাধ্যায়। তাঁকে পর্যন্ত মানুষ নানারকমের অভাব-অভিযোগ সম্বলিত কাগজপত্র তাঁর হাতে ধরাচ্ছেন এবং সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। এখন পিছন দিকে ফিরে তাকালে ভাবি, এসব তো ১৯৯১ সালের কথা। সেই সময়েই গোটা দেশের মানুষের কাছে, এমনকী উত্তরপ্রদেশের হিন্দি বলয় এলাহাবাদে মানে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর তীরে এলাহাবাদ নগরীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বিপুল পরিমাণে জনপ্রিয় ছিলেন! এসবই কিন্তু নিজের চোখে দেখা।

আরও পড়ুন-মুণ্ডেশ্বরী সেতু, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি পালনে প্রশাসন

তখন দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসতেন। ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে তাঁর প্রথম দিল্লি আসা। সেই থেকে তিনি দিল্লিতে আসছেন এবং তাঁর সঙ্গে যখনই গাড়িতে বসে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় গেছি, এমনকী বাড়ি থেকে যখন বিমানবন্দর এসেছি, দেখেছি পাশে জ্যামে আটকে যাওয়া মমতার গাড়ি। পাশে হয়তো একটা বাস আটকে আছে এবং বাসের মধ্যে হয়তো অনেক মানুষ। তারা বাসের জানলা দিয়ে হাত নেড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিবাদন জানাচ্ছে। ‘দিদি দিদি’ করে কথা বলছে। এই যে জনপ্রিয়তা, সেটা কিন্তু কোনও সোশ্যাল মিডিয়া বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে উৎপাদিত একটা ফসল নয়। এটা একটা রাজনৈতিক স্বতঃস্ফূর্ততা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে এসে জনপ্রিয় হওয়ার কোনও চেষ্টা করেননি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাম ঘাঁটিতে যেভাবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট সিপিএম নেতাকে পরাস্ত করেন, তাতে তিনি তখনই জায়েন্ট কিলার হিসেবে মান্যতা পেতে শুরু করেছেন।

অতএব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা যে আছে, সে-কথা অনস্বীকার্য। আর এই গ্রহণযোগ্যতা যে আজ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ইতিহাসে জয়ের পর তৈরি হয়েছে, তা নয়। এটা সেদিন, যেদিন ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে পা রেখেছিলেন, সেই দিন থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে, গড়ে উঠেছে, এবং জনপ্রিয় মহিলা রাজনীতিক হিসেবে গোটা দেশের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন অনেক যুগ আগেই।

কিছুদিন আগে গেছিলাম বেনারসে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন আসছে। তাই সর্বত্র রাজনৈতিক চর্চা। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রামেশ্বরম ঘাট পর্যন্ত। একটা চায়ের দোকানে বসেই হিন্দি খবরের কাগজ পড়ছি। সেখানে জোরদার আলোচনা হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের আসন্ন ভোট নিয়ে। সেখানে বিজেপি যে সমস্যায় আছে, সেটা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন এবং যোগী আদিত্যনাথের সরকারের জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে ধাক্কা খেয়েছে, তা মেনে নিচ্ছেন। চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষদের কথোপকথনে হঠাৎ উঠে এল তৃণমূলনেত্রীর নাম। আমি যে চায়ের দোকান থেকে চা খাচ্ছিলাম, তার দোকানদারের নাম ঝগরু। হঠাৎ সেই বৃদ্ধ ঝগরু বলে উঠল, ‘‘শুনছি তো এবারের ভোটে আমাদের রাজ্যে মমতা দিদি আসছেন। তিনি এবারে এখানে ভোট প্রচার করবেন এবং তাঁর দলও এখানে সক্রিয় ভূমিকা নেবে। দেখা যাক, উনি এখন ভরসার একটা কারণ।’’ জানতে চাইলাম, কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। ঝগরু কিন্তু জানে না আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার কী পরিচয়। আমি যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, বাঙালি, তাও সে জানে না। আমাকে দেখে যে সে আমার পরিচয় ঠাহর করতে পেরেছে, এমনও নয়। তা এহেন ঝগরুর বক্তব্য, এখানে যেমন বিজেপি তেমন সমাজবাদী পার্টি, তেমনই মায়াবতী। আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি। বরং দিদি যদি আসেন তাহলে কিছু একটা হতে পারে। আমি কী করে ঝগরুকে বোঝাই যে এখানে মানে উত্তরপ্রদেশে তৃণমূল কংগ্রেসের তো সেই প্রাসঙ্গিকতাটা নেই, যেটা পশ্চিমবঙ্গে আছে। কিন্তু ওসব যুক্তি-তর্ক দিয়ে নয়, কোনও অঙ্কের হিসেব দিয়ে নয়, ঝগরুর মনে হয়েছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানে একটা রাজ্যে শান্তি এবং ওদের ভাল থাকার একটা পাসওয়ার্ড। আসলে গরিব মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে এবং মহিলাদের প্রতিনিধি হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশে তাঁর নিজের একটা ব্র্যান্ড ইকুইটি তৈরি করেছেন।

আরও পড়ুন-১০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ, গ্রেফতার বিজেপি নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

আর একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তাঁর রাজনীতির যে প্রথম অধ্যায়, তা শুরু করেছিলেন এই রাজধানী দিল্লি থেকেই। অর্থাৎ, তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন, তারপর তিনি বিভিন্ন কলেজে, তখন নকশাল আন্দোলন চলছে সেই রকম একটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শৈশবের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন, সেটা যেমন সত্য, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে তিনি দিল্লিতে লোকসভার সদস্য হয়ে আসেন এবং তিনি লোকসভাতে সকলের কাছেই একটা আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল ছিলেন, সেটাও তেমনই সত্য। এর কারণ, একজন অত্যন্ত সাধারণ ঘরের মেয়ে, মাটি থেকে উঠে আসা এমন এক মহিলা, যিনি তথাকথিত ব্যারিস্টোক্রেসি অথবা অ্যারিস্টোক্রেসি থেকে উদ্ভূত নেত্রী নন। একদম মাঠ-ঘাট-ময়দান থেকে রাজনীতি করে উঠে আসা একটি মুখ। সত্যি কথা বলতে কী, দিল্লির অভিজাত বৃত্তে এই ধরনের অবয়ব যেমন একদিক থেকে সহজলভ্য নন, তেমন আবার অভিজাত বৃত্তের কিন্তু কৌতূহল এবং একটা রেসপেক্ট বা একটা শ্রদ্ধা এই ধরনের নেত্রীদের প্রতি থাকে। ৫০০ সাংসদের ভিড়ের মধ্যে এই ধরনের চরিত্র মিশে থাকেন। কিন্তু যখন তিনি তাঁর এলাকায় স্বমহিমায় বন্দিত হন, তখন কিন্তু সংসদে এসেও পৃথক মর্যাদা পান।

এরপর আগামিকাল

Latest article