বড় পর্দায় প্রথম মর্জিনা সাধনা বসু

নাচে গানে অভিনয়ে যিনি সবাক ছবির গোড়ার দিকে দর্শকমন জয় করে নিয়েছিলেন, সেই সাধনা বসুর পরিচয় তুলে ধরেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ।

Must read

কথামুখ
কাশেম আর সাকিনার বিশাল প্রাসাদে অজস্র বাঁদির মধ্যে একজন মর্জিনা। সঙ্গে রয়েছে আবদাল্লা। এই বাড়ির বাঁদি হলেও মর্জিনার টান রয়েছে কাশেমের দাদা-বৌদি আলি আর ফাতিমার জন্য। আরেকজনের জন্য টান আছে সে এদেরই পুত্র হুসেন। আচমকা বিরাট গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে আলি রাতারাতি ধনী বনে যাওয়ায়, কাশেম সেই পথে গুপ্তধন হাতাতে গিয়ে দস্যুসর্দারের হাতে নিহত হয়। সেই লাশ-কাটা জোড়া দিতে বাবা মুস্তাফার শরণাপন্ন হয় মর্জিনা। দস্যুসর্দারের ছদ্মবেশে ধরা পড়ে যায় মর্জিনার চোখে। দস্যুসর্দার খুন হয় মর্জিনার হাতে। আলিবাবা ও তার পরিবারকে এই ভাবেই রক্ষা করে মর্জিনা। বহু প্রচারিত আলিবাবার কাহিনি রচয়িতা ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। এই নাটক নিয়ে একসময় মঞ্চ কাঁপিয়ে ছিলেন বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক মধু বসু। এই নাটকের চিত্ররূপ দিতে তিনি যখন উদ্যোগী হলেন, তখন একে একে প্রযোজকেরা মুখ ফেরালেন। তাঁদের ধারণা থিয়েটারের আর্টিস্টরা গুণী শিল্পী হতে পারেন কিন্তু সিনেমায় তাঁরা সফল হবেন না। মধু বসু তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরলেন না। অবশেষে এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ভারত লক্ষ্মী পিকচারার্সের বাবুলাল চোখানি। নির্মিত হল মধু বসুর নির্দেশনায় ‘আলিবাবা’ ছবিটি (১৯৩৭)। মর্জিনা সাধনা বসু। আবদাল্লার চরিত্রে অভিনয় করলেন মধু বসু। সাধনা বসু প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করলেন। তাঁর গাওয়া ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’ গানটি একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত।

আরও পড়ুন-কবির সহধর্মিণী

জীবনকথা
সাধনা বসুর জন্ম ১৯১৪ সালের ২০ এপ্রিল কলকাতায়। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন তাঁর ঠাকুরদা। ব্যারিস্টার সরলচন্দ্র সেন ও নির্মলার দ্বিতীয় কন্যা তিনি। ঠাকুরদার লিলি কটেজে সাধনারা তিন বোন মিলে নানা অনুষ্ঠান করতেন। তাঁরা হলেন বিনীতা, সাধনা, নিলিনা। সাধনা কত্থক নাচ শিখেছিলেন তারকনাথ বাগচীর কাছে। ফ্রাঙ্কো পোলোর কাছ থেকে শিখেছিলেন পিয়ানো বাজনা। সংগীত অনুশীলন বহুদিনের। শচীন দেববর্মনের কাছ থেকে শিখেছেন গান। মণিপুর থেকে সেনারিক রাজকুমার তাঁকে নৃত্যশিক্ষা দিলেন। স্কুলের পাঠ তিনি নিয়েছিলেন ঠাকুরদা প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। কলেজ জীবন লোরেটোতে।

আরও পড়ুন-রূপকথার ভুবনজয়ী লক্ষ্যভেদী নারীরা

বিশিষ্ট মানুষদের সান্নিধ্য লাভ
লেখক রমেশচন্দ্র দত্তের মেয়ে কমলা বসু ও টাটা জামশেদপুর এর বিশ্ববিস্তৃত দরবারের স্মরণীয় পুরুষ প্রমথনাথ বসুর ছেলে মধু বসু। ছেলেবেলা থেকেই সাধনা ও মধুবাবুর বাড়ির মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ইতিমধ্যে মধুর নানা নাটকে অভিনয় করার সুবাদে দুটি হৃদয় কাছে আসার সুযোগ পায়। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে ছাতনাতলায় এসে গেলেন এই মানুষ দুটি। একদিন রবীন্দ্রনাথ, সরলচন্দ্র সেন, মধু ও সাধনা বসু একই গাড়িতে চলেছেন বরানগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়িতে। সবাই নিমন্ত্রিত সেখানে। সরল সেন তাঁর কন্যা ও জামাতাকে দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বললেন ‘এই হল মধুর সাধনা’। রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘না সরল, মধুর সাধনা নয়, মধুর মাধবী।’ রবীন্দ্রনাথের দালিয়া নাটকে তিনি তিন্নির ভূমিকায়। অভিনয় শিক্ষা সাধনাকে দিয়েছলেন রবীন্দ্রনাথ। দালিয়ার অভিনয় পুস্তিকার মুখপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সাধনাকে আমার আশীর্বাদের সঙ্গে। আমি আনন্দিত।’ বাল্যকালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্য পেয়ে ছিলেন। তাঁদের রাজাবাজারের বাড়ি লিলি কটেজে গান্ধীজি একবার এসেছিলেন। সবাই খদ্দর পড়েছিলেন। শুধু সাধনা মিলের শাড়ি পরেছিলেন। তবে তা দেশীয় বিলিতি নয়। গান্ধীজিকে মাল্যদান করেছিলেন সাধনা।

আরও পড়ুন-‍‘শহিদ মিনারের মাথা লাল রং করা ঠিক হয়নি’

ছবির জগতে ব্যাপ্তি
বাংলা হিন্দি ইংরেজি মিলিয়ে বেশ কিছু ছবিতে তিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সবাক চলচ্চিত্রের গোড়ার দিকে একটি ইংরেজি ছবিতেও তিনি নায়িকা। সেই ছবিটি ছিল ত্রিভাষিক (বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি)। বাংলা ও হিন্দিতে তাঁর নাম রাজনর্তকী । তিনি নাম ভূমিকায়। চরিত্রের নাম ইন্দ্রাণী। ইংরেজিতে ছবির নাম দ্য কোর্ট ডান্সার। তিনি নায়িকা চরিত্রে। তাঁর বিপরীতে জ্যোতিপ্রকাশ বাংলা ছবিতে। ইংরাজি ও হিন্দিতে তাঁর বিপরীতে কাজ করেছিলেন বোম্বের পৃথ্বীরাজ কাপুর। ছবিটির টাইটেল কার্ডে লেখা হয়েছিল ‘the first Indian film with dialogue in English to be entally produced in India with an all Indian personnel.’ তখন তো ডাবিং সিস্টেম ছিল না। সাধনা তাঁর ইংরেজি সংলাপ নিজেই বলেছেন এবং সেই উচ্চারণ অত্যন্ত সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর অভিনীত ছবির তালিকায় রয়েছে আলিবাবা, অভিনয়, কুমকুম, রাজনর্তকী, মীনাক্ষী, শেষের কবিতা, মা ও ছেলে। হিন্দিতে কাজ করেছেন ডান্সার, রাজনর্তকী, শংকর পার্বতী, বিষকন্যা, নন্দকিশোর, সিনসিনাকি বুবলাবু, তিতলি প্রভৃতি ছবিতে। বিভিন্ন ছবিতে তিনি তাঁর বিপরীতে নায়ক হিসেবে পেয়েছেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, জ্যোতিপ্রকাশ, পৃথ্বীরাজ কাপুর, নাজমুল হোসেন, সুরেন্দ্র, অরুণকুমার প্রমুখ শিল্পীদের।

আরও পড়ুন-লালুকে হেনস্তা

মঞ্চসাফল্য
কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাটকের নায়িকার চরিত্রগুলোতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যার মধ্যে আছে আলিবাবা, দালিয়া, জেরিনা, মন্দির, সাবিত্রী, বিদ্যুৎপর্ণা, রাজনটী, রূপকথা প্রভৃতি। ব্যালে নৃত্য পরিচালনা করেছেন এবং মূল চরিত্রগুলোতে তিনি অংশ নিয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে ডিফাইন সোর্স, রিদিম অফ ভিকট্রি, বার্থ অফ ফ্রিডম প্রভৃতি। এইচএমভি রেকর্ডে তিনটি গান তিনি গেয়েছেন— ছড়ায়ে রূপের ফাঁক, অধরে বেনুদিয়া, ওরে ভ্রমরা।

আরও পড়ুন-কোনও অন্যায় কাজে থাকবেন না: অনুব্রত

জীবনসায়াহ্নে
মিলন-বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদ-মিলন নিয়ে সাধনা ও মধু বসু তাঁদের জীবন কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বাণী ‘মধুর সাধনা নয়, মধুর মাধবী’। গুরুদেবের বাণী ছিল অমোঘ। তাই দীর্ঘ ১৫ বছরের ব্যবধানে আবার মিলিত হলেন মধু ও সাধনা। সাধনার সঙ্গে কারনানি ম্যানসনে থাকাকালীন মধু বসু মারা যান। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে দিন কেটেছে সাধনার। জনশ্রুতি আছে মল্লিক বাজার থেকে বেকবাগান পর্যন্ত নানা স্থানে রাস্তায় ভিক্ষা করেছেন। যা পেতেন মদ্যপানে বেরিয়ে যেত। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল ১৯৭৩ সালের তেসরা অক্টোবর। তেমনভাবে সেই সময়ের ছবিগুলি সংরক্ষিত করা যায়নি। যদি করা যেত তাহলে এ-প্রজন্মের দর্শকেরা দেখতে পেতেন সাধনা বসু কত বড় মাপের অভিনেত্রী ছিলেন। শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারে আগ্রহী অভিজাত পরিবারের মেয়েদের তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন অভিনয়ের জগতে।

Latest article