কবির সহধর্মিণী

১১ জ্যৈষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। তাঁর সহধর্মিণী প্রমীলা দেবীর জন্মদিন ছিল ২৭ বৈশাখ। তিনি ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। কবির সংসার সামলানোর পাশাপাশি নিজেও কবিতা লিখতেন। তাঁকে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

নজরুলকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। তাঁর এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণতূর্য। পাশাপাশি তিনি ছিলেন তুমুল প্রেমিক। তাঁর প্রেম প্রতিফলিত হয়েছে দেশমায়ের প্রতি, নিজের সৃষ্টির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি। জীবনে এসেছে একাধিক নারী। প্রেম বর্ষিত হয়েছে তাঁদের প্রতিও। তবে কোথাও বেশিদিন থিতু হননি। বাউল মন তাঁর। জীবন কাটিয়েছেন আপন খেয়ালে। তবে সেটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। তারপর তিনি সত্যিই বাঁধা পড়েছিলেন গভীর প্রেমডোরে। তাঁর অশান্ত জীবনকে শান্ত করেছিলেন এক মহীয়সী নারী। তিনি আশালতা সেনগুপ্ত। পরবর্তী সময়ে সবাই তাঁকে চিনেছেন প্রমীলা দেবী নামে।

আরও পড়ুন-কীর্তন থেকে সিনেমার গান কেমন ছিল পঙ্কজ নট্টের জার্নি?

১৩১৫ বঙ্গাব্দের ২৭ বৈশাখ (১০ মে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ) ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার তেওতা গ্রামে আশালতার জন্ম। ডাক নাম ছিল ‘দোলন’ বা ‘দোলনা’। বড়রা আদর করে ‘দুলি’ বলে ডাকতেন। ছোট থেকেই ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। এতটাই ছিল রূপের ঔজ্জ্বল্য, কেউ সহজে চোখ ফেরাতে পারতেন না। ব্যবহারটিও ছিল মিষ্টি। স্বচ্ছল পরিবার। বাবা বসন্তকুমার ভাল চাকরি করতেন। ত্রিপুরায় থাকতেন পরিবার নিয়ে। মা গিরিবালা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। পাশাপাশি সাহিত্যচর্চায় ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তিনি মূলত গল্প লিখতেন। তাঁর বেশকিছু ছোটগল্প অলকা, নারায়ণ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। খুব সুন্দর চিঠি লিখতেন তিনি।
মাকে দেখে মেয়েও কম বয়সেই সাহিত্য-মনোযোগী হয়ে ওঠেন। যা পেতেন, পড়তেন। পাশাপাশি গাইতেন গান। মূলত রবিবাবুর গান। তখন আসানসোলের এক অখ্যাত গ্রাম চুরুলিয়ার দুখু মিয়া হয়তো ঘাম ঝরাচ্ছেন রুটির দোকানে, নিজেকে মেলে ধরছেন লেটোর দলে অথবা আপনমনে নিচ্ছেন সুরের অপূর্ব পাঠ।

আরও পড়ুন-রূপকথার ভুবনজয়ী লক্ষ্যভেদী নারীরা

অকালে ঝরে যান বসন্তকুমার। গিরিবালা দেবী দুলিকে নিয়ে আশ্রয় নেন গোমতী নদীর তীরে কান্দির পাড়ে দেবর ইন্দ্রকুমারের বাড়িতে। ইন্দ্রকুমার ছিলেন কুমিল্লার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বিরজাসুন্দরী দেবী। এই রমণীর কবিতা লেখার হাত ছিল চমৎকার। সেই সময়ের বেশকিছু বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা।
ইন্দ্রকুমার এবং বিরজাসুন্দরী ছিলেন উদার মনের মানুষ। তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন এক স্বাধীন ভারতবর্ষের। দুজনেই বিশেষ স্নেহ করতেন কাজী নজরুল ইসলামকে। অবশ্যই তাঁর দেশভক্তি এবং কবিতার জন্য। নজরুল ততদিনে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বিশেষ কাজে কিছুদিন ছিলেন কুমিল্লায়। তখনই তিনি ইন্দ্রকুমার এবং বিরজাসুন্দরীর স্নেহ পেয়েছিলেন। ভিন্ন ধর্মের মানুষ। তবু এই পরিবারে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। বিরজাসুন্দরীকে তিনি সম্বোধন করতেন ‘মা’ বলে। বিরজাসুন্দরীও নজরুলকে দেখতেন আপন পুত্রের মতো।
নজরুল সম্পাদনা করতেন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। সেই পত্রিকায় লিখতেন বিরজাসুন্দরী। নজরুলের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছিলেন একটি কবিতা। সেটা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ধূমকেতু’র পাতায়।

আরও পড়ুন-‍‘শহিদ মিনারের মাথা লাল রং করা ঠিক হয়নি’

নজরুল তাঁর ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থটি বিরজাসুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন একটি কবিতা।
এমন একটি সাহিত্যমনস্ক পরিবারে বেড়ে ওঠার ফলে কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী আশালতার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মায়। এখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় নজরুলের।
সুপুরুষ নজরুল। ধুতি পাঞ্জাবি। কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল। উজ্জ্বল দুটো চোখ। মুখে পান। যেন দেবদূত। সময় পেলেই আসতেন। হাসতেন প্রাণ খুলে। হইহই করে পাঠ করতেন নিজের কবিতা। হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গাইতেন গান। সবকিছু আকৃষ্ট করত আশালতাকে। অজান্তেই তাঁর কোমল মনে জায়গা করে নেন কবি। শুরুতে টুকটাক কথা। তারপর গান-কবিতার আবদার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা। ঘনিষ্ঠতা ক্রমেই গভীর হয়। এইভাবে আশালতা একদিন হয়ে ওঠেন কবির সহধর্মিণী প্রমীলা।

আরও পড়ুন-লালুকে হেনস্তা

প্রমীলা হিন্দুকন্যা। নজরুল মুসলমান। তাঁদের বিবাহ নিয়ে সমাজে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু কোনও বাধা এই বিয়ে আটকাতে পারেনি। সেইসময়ে দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন গিরিবালা দেবী। তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সম্পর্কে। সমাজের চোখরাঙানি তিনি বিন্দুমাত্র পরোয়া করেননি। নজরুলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন অষ্টাদশী কন্যাকে।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল (১২ বৈশাখ ১৩৩১) সুসম্পন্ন হয়েছিল এই বিয়ে। সাহিত্যিক মইনুদ্দিন হোসেন এই বিয়েতে কাজী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষী ছিলেন আবদুস সালাম, সাংবাদিক মোঃ ওয়াজেদ আলি, কবি খান মুহাম্মদ মাইউদ্দিন।
জানা যায়, বিয়ের তারিখ আগে থেকে কাউকেই জানানো হয়নি। হঠাৎ আয়োজন। আসরে ছিলেন না নজরুলের কোনও বন্ধু বা প্রমীলার আত্মীয়রা।

আরও পড়ুন-সেনার সাফল্য, এই প্রথম দেশে তৈরি জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

এই বিয়ে নজরুলকে অনেক বেশি দায়িত্ববান করে তুলেছিল। প্রমীলাও কবির মনে ঢেলে দিয়েছিলেন অপার শান্তি। অভাব ছিল। সাংসারিক কষ্ট ছিল। হাসি মুখে সব সহ্য করেছেন প্রমীলা। যেটুকু পেয়েছেন, সেটুকু দিয়েই গুছিয়ে তুলেছিলেন কবির সংসার। তাই তো নজরুল নিশ্চিন্তে সুরের মায়াজালে বিস্তার করতে পেরেছিলেন, নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন কবিতার জগতে। আসলে নজরুল খুব ভরসা করতেন এই মহীয়সী নারীর উপর। ‘বিজয়িনী’ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি কবিতা। এই কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন প্রমীলার উদ্দেশ্যে।
সংসার সামলানোর পাশাপাশি প্রমীলা কবিতা লিখতেন। গিরিবালা দেবী, বিরজাসুন্দরী দেবী তো বটেই, তাঁকে উৎসাহ দিতেন নজরুলও। প্রমীলা দেবীর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকার ১৩৩২ সালের বৈশাখ সংখ্যায়। পাশাপাশি লিখেছেন ‘সওগাত’ পত্রিকাতেও। কবিতা ছাড়াও চমৎকার চিঠি লিখতেন তিনি।

আরও পড়ুন-কোনও অন্যায় কাজে থাকবেন না: অনুব্রত

একটা সময় নজরুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। থেমে যায় তাঁর সৃষ্টি। সেই সময় স্বামীর দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রমীলা দেবী। সন্তানরা তখন অনেকটাই বড়। কবিকে তিনি নিজের হাতে খাইয়েও দিতেন। কয়েক বছর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রমীলা দেবী নিজেও। আক্রান্ত হয়েছিলেন পক্ষাঘাতে। এইভাবে দীর্ঘ যন্ত্রণা সহ্য করার পর কবিকে একলা রেখে তিনি একদিন পাড়ি দেন না-ফেরার দেশে। দিনটা ছিল ১৯৬২ সালের ৩০ জুন। সহধর্মিণীর মৃত্যুর পর আরও প্রায় ১৪ বছর জীবিত ছিলেন নজরুল।

Latest article