ডেজা ভিউ (Deja Vu)
মানবদেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গ হল মস্তিষ্ক। গঠন বা কার্য যে দিক থেকেই বিচার করা হোক না কেন এর থেকে জটিলতম অংশ পাওয়া দুষ্কর। চিন্তা-ভাবনা, আবেগ, বিচার-ক্ষমতা সবেতেই জড়িয়ে এই মস্তিষ্ক। এককথায় মস্তিষ্ক ছাড়া আমরা জড় বস্তু বই তো আর কিছু নয়। তবে এই মস্তিষ্কের কার্যকারিতা একই হলেও এর জটিলতা মানুষ-বিশেষে পরিবর্তিত হতেই থাকে। এই যে আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, কী সরল সাধাসিধে লোক বা কী জটিল লোক-রে বাবা— এই সমস্ত কিন্তু তাদের ভাবনা-চিন্তাকে মাথায় রেখেই বলা হয়, এখানেও জড়িয়ে থাকে সেই মস্তিষ্ক। বিভিন্ন মানুষের বিচিত্র সব চরিত্র নির্ধারিত হয় তাদের মস্তিষ্ক দ্বারা। আসলে মানুষের মনের গভীরতা বোঝা বা জানা খুব কঠিন ব্যাপার, একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এক-একজনের মস্তিষ্ক এক-এক ভাবে কাজ করতে পারে আবার একই জিনিসকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে দেখে থাকে। যদিও এই দেখা বা ভাবা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতার ওপর নির্ভর করে, তবে এই দুটির পরিচায়কও কিন্তু সেই মস্তিষ্কই। তাহলে এই সমস্ত আলোচনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে আমরা যা দেখি, শুনি বা বুঝি সবই আসলে এই মস্তিষ্কেরই কেরামতি। তবে আমাদের এত ভরসার মস্তিষ্কও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলেই বাধে গোল, দেখা দেয় মহাবিপদ। সাধারণ বাংলায় একেই বলে পাগল। তবে মনস্তত্ত্ব বা শারীরবিদ্যায় এর অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও আজ আমরা আর এসব জটিলতায় যাব না তার চেয়ে বরং আজ এখানে আমরা এমন একটি মস্তিষ্ক-সংক্রান্ত রোগ নিয়ে কথা বলব যার সঙ্গে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কথাটি বেশ যায়। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠবে কীভাবে? তাই তো? তারই উত্তর হল এই ডেজা ভিউ (Deja Vu)।
কোথা থেকে এল?
এই ডেজা ভিউ (Déjà vu) হল একটি ফরাসি শব্দ, যার অর্থ হল ‘ইতিমধ্যেই দেখা’ (Already seen) বা পূর্বদৃষ্ট। যদিও এর অনেকগুলি রূপ রয়েছে। যেমন— ডেজা ভেকু (Déjà vecu) যার অর্থ হল ‘ইতিমধ্যেই জ্ঞাত’ (Already experienced), ডেজা সেন্টি (Déjààsenti) যার অর্থ হল ‘ইতিমধ্যেই যা ভাবা হয়ে গিয়েছে’ (Already thought) এবং ডেজা ভিসিটি (Déjà visite) যার অর্থ হল ‘ইতিমধ্যেই যেখানে ঘোরা হয়ে গিয়েছে’ (Already visited)। সাধারণত ১৮৭৬ সাল নাগাদ এক ফরাসি বিজ্ঞানী, নাম এমিল বোইর্যাক এই অদ্ভুত ঘটনাটির নামকরণ করেন। আসলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীল এমিল একটি বই লেখেন আর তাতেই এই ডেজা ভিউর (Deja Vu) সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।
ডেজা ভিউ (Deja Vu) কী আর কীভাবেই বা এটি ঘটে?
আসলে কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি পরিস্থিতি, দৃশ্য বা কোনও জায়গা দেখে যদি হঠাৎ করে মনে হয়, যে সমস্ত কিছুই সে আগে দেখেছে যদিও সে আগে কখনওই তা দেখেনি। তখন সেই মনে হওয়ার অনুভূতিকেই বলা হয় ডেজা ভিউ। তবে এসব ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির অনুভূতিটি পরিচিত বলে মনে হলেও সে কিন্তু এটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান থাকে, তার মধ্যে এটি নিয়ে বেশ একটা টানাপোড়েন কাজ করে। ধরা যাক আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আশেপাশের বাড়িঘর, মানুষজন ইত্যাদি দেখতে দেখতে যাচ্ছেন, সেখানে হঠাৎই একটি মুখ আপনার খুব চেনা-চেনা বলে মনে হল, কিন্তু আপনি এও জানেন যে তাকে আপনি কখনও দেখেননি, এমনকী স্মৃতি হাতড়েও আপনি সেই মুখ সম্বন্ধে কোনও তথ্য পেলেন না। সাধারণত এই ঘটনাটিকেই বলে ডেজা ভিউ বা পূর্বদৃষ্ট। মনোবিজ্ঞানী অ্যালান এস ব্রাউনের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ মানুষই জীবনের কোনও না কোনও সময়ে এরকম পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। একবার ভেবে দেখুন তো এরকম ঘটনা হয়ত আমার বা আপনার সঙ্গেও বহুবার হয়েছে, কিন্তু আমরা হয়ত তাতে আমল দিইনি।
আরও পড়ুন: করোনা রুখতে অনন্য ভূমিকা, আশাকর্মীদের সম্মান জানাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ডেজা ভিউ (Deja Vu) কি আসলে মাথার ব্যামো?
না, এককথায় এই ঘটনাটিকে কাঠগড়ায় তোলা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সত্যিই এর কোনও তল খুঁজে পাননি। তাই এটি যে ব্যামো সেটা বলা একেবারেই উচিত নয়। তবে এটাও ঠিক যে বারংবার এটি ঘটতে থাকলে সেটি অসুখের পর্যায় পৌঁছায়। এক্ষেত্রে আমরা সরাসরি দোষ দিই মস্তিষ্ককেই বা বলা ভাল স্নায়ুতন্ত্রকেই। কারণ স্নায়ুতন্ত্রের অস্বাভাবিকতা এমন এক ধরনের সংবেদনশীলতার সৃষ্টি করে যেখানে মস্তিষ্ক বর্তমানে ঘটা ঘটনাকে অতীতের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে আর তার ফলেই জন্ম নেয় ডেজা ভিউ। বিভিন্ন গবেষণায় এটি দেখা গিয়েছে যে যারা অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকে বা একই সঙ্গে অনেকগুলি কাজে যুক্ত থাকে বা রাতে ঘুমের পরিমাণ কম হয়, এমনকী যারা রাতে বেশিরভাগ সময় স্বপ্ন দেখে এদের ক্ষেত্রে ডেজা ভিউ বেশি দেখা যায়। একটি উদাহরণ দিয়ে বলতে যায়— ধরা যাক কেউ যদি গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলতে থাকে তবে তার মনোযোগ ওই দুটি কাজের প্রতি বণ্টিত হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রেও সে আশেপাশের জিনিসগুলিকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেও ওই দৃশ্যপট তার অবচেতন মনে গচ্ছিত থাকে। এর ওপর ভিত্তি করেই অ্যালান ব্রাউন একটি সূত্র দেন। তিনি এর নাম দেন সেল ফোন থিওরি। এর তথ্য অনুযায়ী উক্ত ব্যক্তিটি এমত অবস্থায় কোনও নিমন্ত্রণ বাড়িতে গেলে সেটির আশপাশ চোখে দেখার আগেই মনে মনে একটি ধারণা করে। যেমন ধরা যাক সেখানকার খাবার, সেখানকার সাজসজ্জা ইত্যাদি। আর যখন সে নিজের চোখে তা প্রত্যক্ষ করে তখন তার ধারণা অনুযায়ী কিছু জিনিসও যদি মিলে যায়, তখন সে মনে করে আগেও সেটি দেখেছে অর্থাৎ তখন তার ডেজা ভিউ ঘটে। এ ছাড়াও আমরা স্বপ্নে যা দেখি, তার সবটা না হলেও কিছু টুকরো টুকরো তথ্য আমাদের স্মৃতিকোষে থেকে যায়। এরকম কোনও তথ্য যদি বর্তমানে কিছু স্থান, কাল বা পাত্রের সঙ্গে মিল খায় তখন আমাদের মস্তিষ্কই সেই ঘটনাটি পুরো সাজিয়ে আমাদের সামনে নিয়ে আসে আর আমরা ভাবি এ তো আমরা আগেও দেখেছি। যদিও এই স্বল্প পরিসরে সমস্ত থিওরি সম্বন্ধে বিস্তারিত বলার খুব একটা বেশি সুযোগ নেই। তা-ও এই দুটি থিওরির পাশাপাশি আরেকটি থিওরি উল্লেখ করা যেতেই পারে। আসলে আমরা যখন বিভিন্ন চলচ্চিত্র, গান উপভোগ করি তখন তার তথ্যাদি না চাইতেই আমাদের স্মৃতিকোষে গচ্ছিত হয়ে যায় এমনকী আমরা যখন কোনও গল্পের বই মন দিয়ে পড়ে তার আস্বাদ নিই তখনও সেখানে থাকা বিভিন্ন তথ্য আমাদের স্মৃতিকোষে চলে যায়। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সেই তথ্য আমাদের মনেও থাকে না। কিন্তু আমরা যদি বর্তমানে এমন কিছু জিনিসের সম্মুখীন হই যার সঙ্গে কিনা পুরোনো ওই স্মৃতির কোনও কিছুর মিল আছে। ঠিক তখনি আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে সেটিকে উপস্থাপন করে যেন পূর্বে সেটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
এ গেল ডেজা ভিউর সপক্ষে দেওয়া কিছু যুক্তি বা থিওরি। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন এপিলেপ্সি, স্কিত্জফ্রেনিয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিংবা ইলিউশন বা হ্যালুসিনেশন— এসব ক্ষেত্রেও ডেজা ভিউ ঘটে, তবে তার মাত্রা হয় বেশি।
তবে সেন্ট অ্যানড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার তথা গবেষক আকিরা ও কনর-এর মতে ডেজা ভিউ একটি স্বাভাবিক ঘটনা, যা প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে এবং এর মাধ্যমে যে কোনও স্মৃতিরোমন্থনও খুব সহজতর হয় বা বলা ভাল এই ডেজা ভিউ যাঁরা প্রত্যক্ষ করেন তাঁদের পুরনো যে-কোনও তথ্য তাড়াতাড়ি মনে পড়ে যায়, একে বলে memory retrieval। তবে কেউ যদি সর্বক্ষণ এটি প্রত্যক্ষ করতে থাকে, তখন তা কিন্তু চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মস্তিষ্কের কোন কোন অংশ একাজে যুক্ত?
মস্তিষ্কের যে-সমস্ত অংশগুলি স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য দায়ী, সাধারণভাবে তাদেরকেই এই ডেজা ভিউর স্থান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। শারীরবিদ্যার ভাষায় বলতে গেলে মেডিয়াল টেম্পোরাল লোব, প্যারাহিপোক্যাম্পাল জাইরাস, রাইনাল কর্টেক্স, অ্যামেগডালা ইত্যাদি। এ-সমস্ত অংশের গঠনগত বা কার্যগত ত্রুটির ফলে ডেজা ভিউর প্রবণতা বাড়ে বলে মনে করা হয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে এই ডেজা ভিউকে অনেকে প্যারামনেসিয়াও বলে থাকে। যেখানে স্মৃতি রোমন্থনে বিকৃতি ঘটে।
তাই এত আলোচনা পর্যালোচনার পরে একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয় যে, মানুষের মনের সমস্ত অন্ধকার এখনও আলোকিত করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞান তার চেষ্টা দ্বারা অনেক অজানা দিককেই উন্মোচন করেছে তা ঠিক। কিন্তু এখনও মানবমস্তিষ্কের এমন অনেক রহস্য রয়েছে যা আমাদের কাছে অধরা। আদৌ তার হদিশ পাওয়া যাবে কিনা, নাকি চিরকাল তা রহস্যাবৃতই থাকবে তার উত্তর রয়েছে ভবিষ্যতের হাতে।