লকডাউনের পাট চুকতেই মনটা নিশ্চয়ই ঘুরতে যাওয়ার জন্য আনচান আনচান করছে। অনেক জায়গাতেই তো ভ্রমণ করেছেন, পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র নানান জায়গা। কিন্তু আজকে এমন একটা জায়গায় আপনাদের নিয়ে যাব যার সঙ্গে ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কথায় বলে শিক্ষার আয়নায় সমাজকে চেনা যায়। আজকে যার কথা বলব, সেটি ভারতবর্ষে শিক্ষার প্রথম আধুনিক সংস্করণ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন নালন্দা (Nalanda) বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি।
আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যার সঙ্গে বর্তমানে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি এই স্থানটি দর্শন করার আগে একবার বরং কল্পনা করুন, আপনি কমপ্লেক্স-এর মধ্য দিয়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর হাতে বই নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকছেন আর আপনার চারপাশে রয়েছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাত্র এবং শিক্ষক। আর আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে রয়েছে অনেকগুলি মনেস্ট্রি। আপনি কি লাদাখ বা স্পিতি ভ্যালির কথা ভাবছেন? তবে যা-ই ভাবুন না কেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হিমালয়ান মনেস্ট্রিগুলির থেকেও প্রাচীন। এটি প্রাচীন কালে যথেষ্ট প্রভাবশালী থাকলেও বর্তমানে এটি একটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। চলুন আজ আরও একবার অতীতের সেই নালন্দা (Nalanda) বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে আসি।
একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পঠনপাঠনের মূল পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হত। যে স্থানে প্রথম বৌদ্ধধর্মের আত্মপ্রকাশ, সেই স্থানেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি। যেখানে যাবেন তার নামকরণের প্রেক্ষাপট জানলে আরও ভাল লাগবে। সংস্কৃতে ‘নালন্দা’ (Nalanda) শব্দটিকে না+আলম+দা— এই তিনটি অক্ষরে বিভক্ত করলে এর সম্পূর্ণ আক্ষরিক অর্থ হল— ‘জ্ঞান উপহার হিসেবে প্রদান করলে তা কখনওই কম হয়ে যায় না।’ ভাবুন তো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পঠনব্যবস্থা, লাইব্রেরি, হোস্টেল ব্যবস্থা, এই সমস্ত কিছুরই সুযোগ ছিল। একটি কমপ্লেক্স-এ প্রায় ২০ হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করতে পারত এবং বিদ্যাচর্চার এই প্রক্রিয়া এবং পরিচালনার জন্য ২ হাজার শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন!
চিনা তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী হিউয়েন সাঙ অবশ্য নালন্দা নামের নানান ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর একটি মত হল, এই নামটি স্থানীয় আম্রকুঞ্জের মধ্যবর্তী পুষ্করিণীতে বসবাসকারী একটি নাগের নাম থেকে উদ্ভূত। কিন্তু যে মতটি তিনি গ্রহণ করেছেন, সেটি হল, শাক্যমুনি বুদ্ধ একদা এখানে অবস্থান করে ‘অবিরত ভিক্ষাপ্রদান’ করতেন; সেই থেকেই এই নামের উদ্ভব। সারিপুত্তর মৃত্যু হয়েছিল ‘নালক’ নামে এক গ্রামে। কোনও কোনও গবেষক এই গ্রামটিকেই ‘নালন্দা’ নামে অভিহিত করেন। নালন্দা (Nalanda) পৃথিবীর প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি এবং এটি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যেও একটি। প্রাঙ্গণে ছিল কতকগুলো দিঘি ও উদ্যান।
কীভাবে যাবেন
নালন্দা (Nalanda) শহরটি বিহার-ঝাড়খণ্ড বর্ডারে অবস্থিত। নালন্দা পৌঁছতে হলে প্রথমে ট্রেন ধরে পৌঁছে যান পাটনা কিংবা গয়া। স্টেশন থেকে বিহার শরিফগামী বাস ধরেও পৌঁছে যেতে পারেন নালন্দা। এই স্থানটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন তীর্থযাত্রীদের কাছে বেশ প্রসিদ্ধ। সারা বছর দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক আসেন এই নালন্দায়। বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তিস্থল বিহার থেকে কীভাবে সমগ্র এশিয়া এবং তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে সেটা জানলেও বেশ রোমাঞ্চকর লাগবে। আরও একটি তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি কমপ্লেক্স বর্তমানে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর আখ্যায় ভূষিত। পায়ে হেঁটে সমস্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মতো।
আরও পড়ুন: মোদি জমানায় মিডিয়া অষ্টপ্রহর পদ্মকীর্তন
পারিপার্শ্বিক দর্শনীয় স্থান
যেহেতু নালন্দা (Nalanda) বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রধান তীর্থস্থান তাই অনেকসময়ই বৌদ্ধদের তীর্থযাত্রা নেপাল থেকে শুরু করে সারনাথে সম্পন্ন হয়। ইচ্ছা করলে আপনি ভ্রমণ প্ল্যানটা এইভাবে তৈরি করে নিতে পারেন— বুদ্ধগয়া-রাজগির-নালন্দা-সারনাথ -গোরক্ষপুর-কুশিনগর-লুম্বিনী-সারস্বত-লখনৌ-নিউ দিল্লি। নালন্দার খুব কাছে সিলাও নামে একটি গ্রাম আছে। এটির জনপ্রিয়তা মিষ্টান্ন ‘খাজা’র জন্য। এখানে এমন কয়েকজন বিক্রেতা এবং বিপণী রয়েছেন যাঁদের পূর্বপুরুষেরাও খাজা তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নালন্দা থেকে কিছুদূর এগিয়ে দর্শন করে আসতে পারেন হিউ-এন-সাঙ মেমোরিয়াল হল। এখানে আপনি প্রাচীন বিদেশি পর্যটকের জীবনকাহিনি এবং তাঁর দুর্গমযাত্রা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু কিমি দূরে ব্ল্যাক বুদ্ধ স্ট্যাচু দেখতে ভুলবেন না। কালো পাথরে নির্মিত বৌদ্ধদেবের মূর্তি এখানে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় স্থাপিত আছেন। খননকার্যের সময় এই মূর্তিটি উদ্ধার করা হয় এবং বর্তমানে এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর জৈন ধর্মের মূল পীঠস্থান এবং মহাবীরের জন্মস্থান কুন্ডালপুরের জৈনমন্দির দর্শন করে নিন।
কেন ধ্বংস্তূপ আর স্মৃতি এর সঙ্গী
১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। এই ঘটনা ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। ২০০৬ সালে ভারত, চিন, সিঙ্গাপুর, জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্র যৌথভাবে এই সুপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির পুনরুজ্জীবনের প্রকল্প গ্রহণ করে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম স্থির হয়েছে নালন্দা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের নিকট নির্মিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারটি ছিল একটি ন’তলা ভবন যেখানে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। ধর্মের পাশাপাশি বেদ-উপনিশদ, বিতর্ক, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা, শিল্পকলা, চিকিত্সাশাস্ত্র-সহ তত্কালীন সর্বোচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগী আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নিয়মিত পাঠ দান চলত এখানে।। তত্কালীন জ্ঞান- বিজ্ঞানের সব শাখাতেই চর্চার সুযোগ থাকায় সুদূর কোরিয়া, জাপান, চিন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য এবং তুরস্ক থেকে জ্ঞানী ও জ্ঞানপিপাসুরা এখানে ভিড় করতেন।
ইতিহাস বলছে, চিনের ট্যাং রাজবংশের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক জুয়ানঝাং সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দার বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রেখে গেছেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার ধর্মগুঞ্জ বা ধর্মগঞ্জ সেই সময়ে বৌদ্ধজ্ঞানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ভাণ্ডার হিসাবে সুপরিচিত ছিল। পাঠাগারে ছিল হাজার হাজার পুঁথি। পাঠাগারের মূল ভবন ছিল তিনটি যার প্রত্যেকটি প্রায় ন’তলা ভবনের সমান উঁচু। ভবনগুলো রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্নরঞ্জক নামে পরিচিত ছিল। শত শত বছর ধরে অবদান রেখে আসা একটি সভ্য, উন্নত জাতি তৈরি ও জ্ঞান উত্পাদনকারী এই প্রতিষ্ঠানটি ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ করে ধ্বংস করে ফেলেন। তার আক্রমণের বর্বরতা কীরকম ভয়াবহ আকারে ছিল সে-সম্পর্কে পারস্য ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাঁর ‘তাবাকাতে নাসিরি’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘হাজার হাজার বৌদ্ধভিক্ষুককে আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে সেখানে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন খিলজি। এরপর আগুন লাগিয়ে দেন লাইব্রেরির ভবন গুতে। লাইব্রেরিতে বইয়ের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে কয়েক মাস সময় লেগেছিল সেই মহামূল্যবান বইগুলো পুড়ে ছাইভস্ম হতে। খিলজি শুধু নালন্দাকে পুড়িয়ে ছাই করেননি, একই সঙ্গে পুড়িয়ে ছাই করেছেন একটি জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য বই যা থেকে আমরা সহজেই জানতে পারতাম সে-যুগের ভারতবর্ষের শিক্ষার কাঠামো, তত্কালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা ও প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, খিলজির এই পাশবিক নিষ্ঠুর বর্বরতাও পরিচিতি পায় এক শ্রেণির ধর্মান্ধদের চোখে ধর্মীয় বিজয় হিসাবে! এত সবের পরেও কিছু কিছু সৃষ্টি এখনও টিকে আছে। যেমন নিকটবর্তী সূর্যমন্দির যা একটি হিন্দুমন্দির। পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, এখনও পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার বর্গমিটার এলাকায় খননকার্য চলানো হয়েছে। অবশ্য যদি জুয়ানঝাংয়ের হিসাব সঠিক হয় তাহলে মাত্র ১০% জায়গায় এখনও পর্যন্ত খননকার্য চালানো হয়েছে। নালন্দায় এখন কেউ বাস করে না, নিকটবর্তী জনবসতি দেখতে পাওয়া যাবে বড়গাঁও নামক গ্রামে।
আসলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থের সংগ্রহশালা। বিশেষ করে বেদ আর উপনিষদের উপর আলোচনা, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণগুলো অত্যন্ত সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। গবেষকেরা বলছেন, এই পুস্তকগুলো ধ্বংসের ফলে পরবর্তীতে হিন্দুধর্মে নানা কুপ্রথা-আচার স্থান পায়। যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে হিন্দুধর্মে। নালন্দায় ধর্মীয় বিজয় সফল হলেও লজ্জিত হয় মানবতা, পরাজিত হয় সভ্যতা, শৃঙ্খলিত হয় শিক্ষা। এভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা, আক্রোশ, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে পৃথিবী থেকে সভ্যতা বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল ধর্মান্ধরা। কয়েকশো বছর ধরে মানবসভ্যতাকে আলোর পথ-দেখানো মানুষ গড়ার এই পীঠস্থান না দেখলে সত্যিই জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। তাই আর দেরি না করে পারলে একবার ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।