কালের করোনা

Must read

করোনা ভাইরাস নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত  করলেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট ডাঃ অনিরুদ্ধ রায়। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

করোনার উৎপত্তি

 

করোনা ভাইরাস হল একটি আরএনএ ভাইরাস। যে ভাইরাস ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে এটা কিন্তু  ভাইরাসজনিত সর্দি-জ্বরের মতোই মানুষের শরীরে দেখা দিত। এটা নতুন কিছু নয়। আমাদের জ্বর-সর্দি-কাশির মধ্যেই রয়েছে এই ভাইরাস। এবার ২০০৩ কী ২০০৪ সাল থেকে এই করোনা ভাইরাসটা মহামারীর মতো আঠাশটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন এর নাম হয় সার্স করোনা ভাইরাস। যার পুরো হল অর্থ— সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এই রোগকে কনটেইনমেন্ট  করে দেওয়া হয় অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ করতে  সক্ষম হয় দেশগুলি। এরপর ২০১২ সালে হয় মিডিল-ইস্ট রেপিরাটরি সিনড্রোম মার্স করোনা ভাইরাস দিয়ে। মোটামুটি ২০ শতাংশ মৃত্যুহার ছিল। কিন্তু তুলনায় সার্স করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ বেশি হলেও মৃত্যুর হার  ছিল কম। মোটামুটি ১০ শতাংশ। মার্স করোনা ভাইরাস শুধু মিডল-ইস্টের দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল, ফলে বেশিদূর ছড়াতে পারেনি। নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল।  এরপর একেবারে একলাফে ২০১৯ সালে চিনের ইউহান প্রদেশ থেকে  এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল গোটা পৃথিবীতে— যাকে আমরা বলছি কোভিড নাইনটিন বা সার্স কোভ টু। এটা ২০১৯-এর ডিসেম্বরে আবিষ্কৃত হয় বলে এর নামের সঙ্গে নাইনটিন জুড়ে দেওয়া হল। এই ভাইরাস কীভাবে ছড়াল, সেই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোনওটাই কিন্তু প্রমাণিত নয়। অনেকের মতে, চিনের ইউহান প্রদেশের খোলা বাজার, যেখানে মাংস বিক্রি হয় সেখান থেকেই ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস। কেউ বলে বাদুড়ের মাংস, কেউ বলে প্যাঙ্গোলিনের মাংস থেকে হয়তো ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস। অর্থাৎ ওই একই ধরনের ভাইরাস একটু জেনেটিক্যালি অলটারেশন হয়ে ২০১৯-এ ফিরে এল। এরপরই ২০২০-তে এটাকে প্যানডেমিক ঘোষণা করা হয়।

 

সংক্রমণ কীভাবে হয়

 

এই ভাইরাস প্রথমে নাক দিয়ে ঢোকে। আমাদের নাকে ওপর একটা এপিথেলিয়াম আছে, ওখানে সিলিয়া থাকে। সেগুলোকে প্রথম ধরে নেয়। সেই জন্য প্রথমেই নাকের গন্ধটা চলে যায়— যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় অ্যানসমিয়া বলা হয়। এই ভাইরাসটি ওই ট্র্যাক ধরে প্রথমে ওপরের দিকে যায়। তারপর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। এবার এই ভাইরাস যত নিচের দিকে নামতে শুরু করে, তখন বেশি অসুস্থতা শুরু হয়। অর্থাৎ  কাশি-জ্বর, শ্বাসকষ্ট থেকে আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে, যাকে আমরা চিকিৎসা পরিভাষায় বলি ARDS। আর যদি নিচে না নেমে ওপরেই থাকে, তা হলে শুধু হালকা জ্বর হল, কাশি হল, নাকে গন্ধ চলে গেল— আবার দু’দিন বাদে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেল। সার্স কোভ টু-এর  আর ফ্যাক্টরটা বেশি তাই ইনফেকশন রেটও বেশি, তাই সংক্রমণও বেশি।

 

চিকিৎসা

 

এই ভাইরাসজনিত রোগের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। প্রথমে তো এর চিকিৎসা সম্পর্কে কেউ কিছু জানতই না। এই রোগে মাইল্ড সিম্পটমের কোনও চিকিৎসাই লাগে না। মডারেট টু সিভিয়র রোগীর ক্ষেত্রে তিন ধরনের চিকিৎসা-পদ্ধতি  কাজ করছে। একটা হল স্টেরয়েড, অপরটি হল অক্সিজেনের ব্যবহার, আর তৃতীয়টি হল রেমিডিসিভির। প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন, আরও যে সমস্ত গাইডলাইন আছে সেগুলো মেনে চিকিৎসা করা শুরু হল। ওটা মেনেই আমরা চিকিৎসক, হাসপাতাল, সরকার— সবাই ঠিক করল কোন স্টেজে কীভাবে চিকিৎসা হবে কীভাবে এগোব।

 

প্রথম ঢেউ ও দ্বিতীয় ঢেউ

 

২০২০-তে প্যানডেমিক ঘোষণা করার পর ফার্স্ট ওয়েভ চলল, লকডাউন চলল। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে তখন রোগী এলে করোনার সিম্পটম থাকলে আরটিপিসিআর টেস্ট করানো হত। রিপোর্ট পজিটিভ এলে কোভিড হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হত। আর যাঁদের আরটিপিসিআর টেস্ট নেগেটিভ, তাঁদের ‘সারি’ অর্থাৎ সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইলনেস ধরে নিয়ে  চিকিৎসা হত। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আর জি কর হাসপাতালের পরিকাঠামো আরও ভাল হল। দশ বেডের এইচডিইউ চালু হল। তারপর সেটা বাড়িয়ে আরও কুড়িটা বেড করা হল। এরপর কোভিড সিসিইউ চালু হল। এই সময় থেকে এখানেও কোভিডের চিকিৎসা পুরোদমে শুরু  হয়ে যায়। এই সময় এইচডিইউ, সিসিইউ মিলিয়ে ২৫০টা বেড ছিল। কোভিডের চিকিৎসা এই মেডিক্যাল হাসপাতালের সব ডিপার্টমেন্ট মিলিয়েই হয়েছে। কোনও ওষুধ নিয়ে ভাবতে হয়নি। পাশাপাশি পিপিই কিট, গ্লাভস, মাস্ক— কোনও কিছুর অসুবিধা হয়নি।

 

টেস্টিং

 

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। সব সময়  আরটিপিসিআর টেস্টের স্যাম্পেল ঠিকমতো কালেক্ট না-ও হতে পারে। টেস্ট তিনদিনের মধ্যে হলে স্যাম্পেল কালেক্ট করলে পজিটিভ আসবে। এবার সাতদিন পর টেস্ট হলে রিপোর্ট নেগেটিভ আসতে পারে। করোনা আছে সেখানেও টেস্ট নেগেটিভ হতে পারে। মোটামুটি ৬০ শতাংশ সেনসিটিভিটি।

 

তৃতীয়  ঢেউ

 

দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তৃতীয় ঢেউ। সম্প্রতি কোনও একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, অগাস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে পিক উঠবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সেপ্টেম্বরের শেষে পিক উঠবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এতটা মনে হয় হবে না। কারণ দ্বিতীয় ঢেউ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। কীভাবে চলতে হবে—  প্রপার মাস্ক,  হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং— এই নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। মাস গ্যাদারিং বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা পেশেন্টদের, তাঁর বাড়ির লোকদের প্রপারলি এডুকেট করতে পেরেছি। সচেতনতা অনেকটা বেড়ে গেছে। কোভিড অ্যাপ্রোপ্রিয়েট বিহেভিয়ার সর্বসম্মতভাবে লাগু হচ্ছে, এর ফলে থার্ড ওয়েভের প্রভাব অনেক কম হবে। বিশেষ করে ভ্যাকসিনের একটা বড় প্রভাব পড়বে। রাজ্য সরকারও ভীষণভাবে সতর্ক, যেটুকু পরিকাঠামো গড়া বাকি ছিল সেটাও তৈরি  হয়ে গেছে। অনেকে বাচ্চাদের নিয়েও বলছেন। এর কারণ বড়রা ইতিমধ্যেই এক্সপোজড, তাঁদের ইমিউনাইজেশন চলছে। যেহেতু ছোটরা বাইরে বেরচ্ছে না তারা সুরক্ষিত কিন্তু এরপর তো তাদের আবার বাইরে বেরতে হবে। যদিও বাচ্চাদের  সিভিয়রিটি কম। কিন্তু যেহেতু ওরা এক্সপোজড নয় তেমনভাবে, আর ভ্যাকসিনও নেই, তাই  বাচ্চাদের সংক্রমণের কথা ভাবা হচ্ছে। সেইজন্য ছোটদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া চালু করার কথা শোনা যাচ্ছে। এখন সব সরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ চালু হয়ে গেছে থার্ড ওয়েভের মোকাবিলায়। যদিও আমার বিশ্বাস, ছোটদের ক্ষেত্রেও যতটা ভয় পাচ্ছে মানুষ ততটা হয়তো ভয় পাওয়ার কিছু  নেই।

 

ভ্যাকসিনেশন

 

যে-কোনও ভাইরাল ডিজিজে ভ্যাকসিন আসাটা কিন্তু মুখের কথা নয়। একটা ভ্যাকসিন আসতে প্রায় দশ বছর অর্থাৎ ডিকেড লেগে যায়। তা হলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোভিড ভ্যাকসিন এত তাড়াতাড়ি এল কী করে! এর উত্তর হল, ওই যে সার্স করোনা ভাইরাস আর মার্স করোনা ভাইরাস এসেছিল সেই ২০০৩ কি ২০০৪-এ আর মার্স করোনা ভাইরাস ২০১২-তে। তখন থেকেই বৈজ্ঞানিকরা কাজ করছিলেন এই ভাইরাসের ওপর। পুরোদমে গবেষণা চলছিল এবং ভ্যাকসিনেশনের একটা লেভেল অবধি কাজ করে রেখেছিলেন। যার ফলে এত দ্রুত ভ্যাকসিন আসা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের দেশে কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন— দুটো বাজারে এল। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই দুটো ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা একই। ভ্যাকসিন যে বয়সের গ্রুপকে কভার করার কথা বলা হয়েছে সেই গ্রুপকে কভার করতে হবে। ভ্যাকসিন যত বেশি সংখ্যক মানুষ নেবে, তত বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হবে এবং তত বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে হার্ড  ইমিউনিটি তৈরি করবে। ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে যদি হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যায় তা হলে বাকি সংখ্যক লোকের মধ্যে এই রোগ আর প্রভাব ফেলতে পারবে না। আগে গর্ভবতী মহিলাদের বাদ দিতে বলা হত, এখন কিন্তু সেই ক্রাইটেরিয়া আর নেই। যাঁরা দুটো ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাঁদের ভাইরাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি এক শতাংশেরও কম অর্থাৎ একশো জনের মধ্যে একজন। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করল কিন্তু এর প্রভাব বেশ কিছু মাস পর কমতে পারে। তখন আবার সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে। সেই নিয়েও গবেষণা চলছে। বুস্টার ডোজের কথা শোনা যাচ্ছে, এখনও সেটা আসেনি তবে পরবর্তীকালে আসতে পারে।

 

টুকরো

হাইপক্সিয়া

করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মুহূর্ত থেকেই বিপদ শুরু হয়ে যায় মানুষের শরীরে। কারণ করোনা থাকাকালীন এবং সেরে যাওয়ার পরও রোগী ফুসফুস-সংক্রান্ত নানা রোগের শিকার হচ্ছেন, এমনটাই বিশ্বের চিকিৎসকদের অভিমত। এইসব রোগের মধ্যে অন্যতম হল হাইপক্সিয়া। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এই রোগে মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে। হাইপক্সিয়া হলে শরীরে টিস্যু এবং কোষে যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৪-এর নিচে নেমে গেলে সেটাকে হাইপক্সিয়া বলে। অনেক সময় মানুষের অজান্তেই শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং সে বুঝতেও পারে না— একে বলা হয় হ্যাপি-হাইপক্সিয়া। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে হার্ট, লিভার, কিডনি—এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে চিকিৎসা না হলে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে রোগীর অবস্থা।

 

কিডনি প্রতিস্থাপন

চেন্নাইয়ের ৪১ বছর বয়সি এক ব্যক্তির যখন ১৪ বছর বয়স ছিল, সেইসময় তাঁর দুটি কিডনিই খারাপ হয়ে যায়। এরপর ৩ বার তাঁর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি হয়েছে বলেও জানা যায়। অপারেশন টেবিলে উঠলেও এর আগে ২ বার ব্যর্থও হয়েছে অস্ত্রোপচার। তাই ভয় ছিলই। কিন্তু চিকিৎসক এস এস সারাবনন তৃতীয়বারের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অবশেষে মিলেছে সাফল্য। ১৯৯৪ সালে প্রথম ওই ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু ৯ বছরের মধ্যে সেই কিডনিও বিকল হয়ে যাওয়াতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর তার ফলেই ২০০৫ সালে ফের তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকরা। ১২ বছর ধরে সেই কিডনি নিয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে ফের বাড়তে থাকে সমস্যা। বর্তমানে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিলে তাঁরা পুনরায় কিডনি প্রতিস্থাপনেরই পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতে কতটা সফল হওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল সকলেরই। এই ধরনের অস্ত্রোপচার দেশের মধ্যেও কার্যত বিরল।

Latest article