পৃথিবীর শরীর যদি গরম হয়ে যায়, পৃথিবীর পিঠ যদি পোড়ে তাহলে হিমবাহ গলে যায়, আর্কটিক আর আন্ট্যার্কটিকার তুষার কমে যায়। গলিত হিমবাহ তিনভাগ জলের পৃথিবীর এক ভাগ স্থলকেও গ্রাস করতে আসে। সেই প্রভাবে বন্যা, সুনামি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, খাদ্যসংকট এবং অনাহার। গ্লোবাল লোকাল—গ্লোকাল এনভাইরোজি—প্রাকৃতিক কারণে মানুষ যেখানে উদ্বাস্তু। প্রকৃতিকে মানুষ ধ্বংস করেছে, করছে—তার শোধ প্রকৃতি নেয়, নিচ্ছে। তবুও আমরা সচেতন হইনি। এরপরেও আন্তর্জাতিক স্তরে একটি প্রশ্ন উঠেছে দেশে দেশে যুদ্ধ কি পৃথিবীর পরিবেশ ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে? যুদ্ধের জন্য কি পৃথিবীর পিঠ আরও পুড়ছে। যবে থেকে মানুষ যুদ্ধ করছে তবেই থেকেই কিন্তু এই সমস্যা দানা বেঁধেছিল। এক সময়ে মনুষ্যনিধন, ধ্বংসকেই যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষতি বলে ভাবা হত। এটা হল আ কোয়েশ্চেন অফ জেনোসাইড। এখন হল আ কোয়েশ্চেন অফ ইকোসাইড— পরিবেশ নিধন।
আরও পড়ুন-পরিবেশ বাঁচাতে শক্তির অপচয় কি বন্ধ করা যায় না?
পৃথিবীকে বাঁচাতে গেলে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আমি কত শক্তিধর বলে নিউক্লিয়ার টেস্ট করা যাবে না, হিরোসিমা-নাগাসাকির ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। সে এক অন্য পৃথিবী ছিল। এ এক অন্য পৃথিবী— পুড়ে ছাই হতে শুরু করেছে। উন্নয়নের নামে গাছ কেটে রেল লাইন পাতা এক সময় তা সভ্যতার সবুজবিপ্লব ছিল, দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে ঔরঙ্গজেব যে কত লক্ষ বনজঙ্গল সাফ করে দিয়েছেন ইতিহাস তার সব হিসেব রাখেনি। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বল্কান যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ বা সাম্প্রতিক কালের ইউক্রেন যুদ্ধে কত সম্পদ যে চলে গেছে বা যাচ্ছে, কত তেল, জ্বালানি যে পুড়ে পৃথিবীকে খাক করে দিচ্ছে তার হিসাব কে রাখে?
আরও পড়ুন-এই সময়ের তিনটি পত্রিকা
আন্তর্জাতিক স্তরে এই গবেষণাই চলছে যে একটি যুদ্ধ পৃথিবীর কত ক্ষতি করে। এ বিষয়ে সচেতনতার আগে আমাদের ইকোসাইড নিয়ে এক্ষুনি ভাবতে হবে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে আখেরে কার ক্ষতি হয়? নিরীহ মানুষের আর প্রকৃতির। গুলিতে, বেয়নেটের মুখে, ট্যাংক আর মিসাইল হামলায় পাইকারি হারে মানুষ জবাই হয়, আর ধ্বংস হয় প্রকৃতি-পরিবেশ, নষ্ট হয়ে যায় জীব-বৈচিত্র্য, বিষবাষ্পে দমবন্ধ হয়ে আসে, বাতাসে ছড়ায় তেজস্ক্রিয়তা। এটাই তো হয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে— জেনোসাইড থেকে ইকোসাইড। জেনোসাইডের দায়ে যদি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টে রাষ্ট্রনেতাদের বিচার হয়, তাহলে ইকোসাইডের দায়েই বা তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না কেন?
ইউক্রেনে হামলার একমাসের মধ্যেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে বারোশো মিসাইল হামলা হয়েছে। তেলের ডিপো ও গ্যাস পাইপলাইনের ওপর হামলা হয়েছে ছত্রিশ বার। বিদ্যুৎ স্টেশনের ওপর হামলা হয়েছে ঊনত্রিশ বার। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও মিসাইলের নিশানা থেকে রক্ষা পায়নি।
আরও পড়ুন-জামাই-আখ্যান
ইউরোপের সবচেয়ে বড় জাপোরিঝঝিয়া পরিমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মিসাইল হামলার পরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয়েছে। পরিত্যক্ত চের্নোবিল পরমাণু কেন্দ্র থেকেও নতুন করে বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে। মিসাইল হামলার ফলে সে-দেশের পনেরোটি পরমাণু রি-অ্যাক্টর থেকে এভাবেই যদি তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে থাকে তবে তার প্রভাব কি শুধু ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? কখনওই না। তার মাশুল দেবে ইউরোপের একটা বড় অংশের মানুষ। সুমিকিমপ্রোম কেমিক্যাল প্ল্যান্টে মিসাইল হানার পর ২.৫ কিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া। অসুস্থ হয়ে মারা গেছে অনেক মানুষ। এরাও কি যুদ্ধের বলি নয়? এরা তবে কী? কো-ল্যাটেরাল ড্যামেজ? জেনেসাইডের পরিসংখ্যানে এরাও ঠাঁই পাবে তো?
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় বিজেপির হয়ে মাঠে মায়াবতী
জেনিভা কনভেনশনের তোয়াক্কা না করেই নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। স্কুল, কলেজ, আবাসন— কিছুই বাদ যায়নি। খারকিভ, খেরসন, মারিয়ুপোল, লিভিভ বা বুচার-র নারকীয় গণহত্যার শিকার হওয়া, গণকবরে স্থান পাওয়া অজ্ঞাত মানুষজনের সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু যাদের খেতখামার নষ্ট হয়ে গেছে, যুদ্ধের দূষণে চাষের জমি বন্ধ্যা হয়ে গেছে, বিষবাষ্প যাদের ফুসফুস ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, মাইন যাদের পঙ্গু করে দিয়েছে, কিংবা পানীয় জল, মাটি, বাতাসে ভারী ধাতু ঢুকে পড়ায় যারা তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের তথ্য কে দেবে? তাদের মৃত্যুর বিচার কী করে হবে?
আরও পড়ুন-হিমন্তের বিরুদ্ধে
পরিবেশবিদরা বলছেন, যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের পরিবেশ-প্রকৃতির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিকর প্রভাব অন্ততপক্ষে আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে ভুগতে হবে। যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি মাশুল বোধহয় প্রকৃতিকেই গুনতে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে থার্মোবেরিক বোমা যা কিনা পরিবেশ থেকে অক্সিজেন শুষে নিয়ে প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন করে। এই বোমার ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও সেই নিয়মেরও পরোয়া করা হয়নি। যুদ্ধবাজরা কবেই বা আর কোন নিয়মের পরোয়া করেছে! ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় শত্রুদের টার্গেট করার জন্য অরেঞ্জ এজেন্ট নামক সাঙ্ঘাতিক ক্ষতিকর এক রাসায়নিক দিয়ে যখন সমস্ত গাছপালার পাতা ঝরিয়ে ফেলা হয়েছিল তখনও কি নিয়মের পরোয়া করেছিল মানবাধিকার নিয়ে সবচেয়ে সরব দেশটি? উপসাগরীয় যুদ্ধে সমুদ্রের জলে তেল ছড়িয়ে পড়ায় মারা পড়েছিল শত শত সামুদ্রিক প্রাণী। জানা গেছে ইউক্রেনের পরিবেশগত দিক থেকে বিপন্ন এলাকাগুলির চুয়াল্লিশ শতাংশই এখন ওয়ারজোনে…যেমন কিনা ডনবাস। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা অধিকৃত এই অঞ্চলটিতে এমনিতেই পরিবেশ দুষণের মাত্রা ছিল লাগামছাড়া। যেটুকু বাকি ছিল এখন তারও ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।
আরও পড়ুন-চারজনের ফাঁসি
ইউক্রেনের ব্ল্যাক সি বায়োস্ফিয়ার রিসার্ভ-এখন রুশ সেনার দখলে। এই ব্ল্যাক সি-এর সঙ্গে ইউক্রেনের সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিতে চায় রাশিয়া। এই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে আখেরে শেষ হয়ে গেল হাজার হাজার বিরল প্রজাতির পাখি, ডলফিন, ঝিনুক, নানান ধরনের ফুল। এখানে আগে ভিড় জমাতো প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার পরিযায়ী পাখি। কিন্তু এই বারুদের গন্ধওলা বধ্যভূমিতে আর কি তারা ফিরে আসবে?
ইউক্রেন মোটেই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনটা আকছারই ঘটছে। দেখা গেছে ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যত বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে তার আশি শতাংশেরই বেশি হয়েছে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বিভিন্ন এলাকায়। এই যুদ্ধের কারণেই শত শত বিরল প্রজাতির পশুপাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২০১৮ সালের এক সমীক্ষার দেখা গেছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের একটা প্রধান কারণ হল যুদ্ধ। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য শুধু সভা, সেমিনার আয়োজন করলেই চলবে না। যুদ্ধ বা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা সবার আগে বন্ধ করতে হবে। আরও বেশি করে উদ্যোগী হতে হবে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে।
মনুষ্যনিধন যদি ওয়ারক্রাইম হয় তাহলে প্রকৃতিনিধনই বা ওয়ারক্রাইম হবে না কেন?
কেন হবে না আরেকটা জেনিভা কনভেনশন? কেন বিচার পাবে না প্রকৃতি?