মহানগরী কলকাতার অলি-গলি জুড়ে ছড়িয়ে আছে বর্ষপ্রাচীন নানা মন্দির। কোথাও এগুলো পারিবারিক কোথাও-বা সর্বজনীন। স্থাপত্যরীতি আর অলংকরণের পাশাপাশি এইসব মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত দেব-দেবীর বিগ্রহগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এদের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে অনেক কাহিনি- কিংবদন্তি তেমনি শিল্প ইতিহাসের পরম্পরার দিক থেকেও এরা অত্যন্ত মূল্যবান। মাটি, পাথর, কাঠ আর ধাতু দিয়েই মূলত এইসব বিগ্রহ নির্মিত। তবে এই চারটি মাধ্যমের মধ্যে কাঠ বা দারুবিগ্রহের (Daru Vigraha) সংখ্যা নিতান্তই অল্প।
একসময় কাদামাটির নরম তাল থেকে মানুষ মূর্তি গড়ে তার সৃজনশীলতার প্রকাশ করেছিল। কৃষিভিত্তিক উর্বরতাকেন্দ্রিক ধর্মধারার এমন বহু কাঁচামাটি আর পোড়ামাটির মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে। যদিও এর সঙ্গে পরবর্তীকালে শিল্পশাস্ত্র নির্দেশিত বিগ্রহ নির্মাণের অনেক পার্থক্য আছে।
মাটির পরেই মানুষ কাঠের মতো নমনীয় মাধ্যমকে নির্বাচন করেছিল শিল্পের জন্য। শিল্পশাস্ত্রে মাটি, কাঠ, পাথর, সোনা, রুপা, তামা ও চিত্র— এই সাতটি মাধ্যমে বিগ্রহ নির্মাণের কথা আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের জলবায়ুর কারণে প্রাচীন দারুবিগ্রহ (Daru Vigraha) কালের ফেরে হারিয়ে গেছে। একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর কয়েকটি মাত্র নিদর্শন আছে বিভিন্ন সংগ্রহশালায়। বর্তমানে বাংলায় বিভিন্ন দেবালয়ে ঐতিহ্যবাহী যে দারুবিগ্রহ আমরা দেখি সেগুলির সময়কাল মোটামুটি ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের পর থেকে। চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন যাকে পূর্ণতা দিয়েছিল।
আলোচনার সূত্র ধরে বিগ্রহ শব্দটির বুৎপত্তি একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। বিগ্রহ (বিশেষ) (to fasten or tie) অচ্ কর্তৃবাচ্যে নিষ্পন্ন। বিদেহ বিশেষরূপে অর্থাৎ সগুণ হয়ে নিজেকে মূর্ত বা প্রকাশ করেছেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, জীবন যখন ছিল অনিশ্চিত ও সংশয়াছন্ন তখন আমাদের আদি প্রপিতামহরা কল্পনা করেছিলেন এই নিত্যজগতের প্রতিটি বস্তুর পিছনে এক অলৌকিক শক্তির। এভাবে নদী, পাহাড়, বন-জঙ্গল— সবকিছুই দেবতাতে পরিণত হয়েছে। এভাবেই ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়েছেন নানা লৌকিক দেবদেবী। শুরুতে এঁরা সবাই বিমূর্ত। ভক্তি নয় মানুষের কাছে এঁরা ভয়ের। সবসম এঁদের তুষ্ট রাখা প্রয়োজন শুধু বেঁচে থাকার জন্য। সে-সময় অনিশ্চিত সংশয়ে ঘেরা মানুষের জীবনে এটাই স্বাভাবিক ছিল। ধীরে ধীরে মানুষ স্থায়ী বসতি গড়েছে। এর পাশাপাশি নিজের মতো করে গড়েছে আরাধ্যের মূর্তি। এই মূর্তি গড়ায় কোনও নিয়ম-নীতি তাকে বাঁধতে পারেনি।
সমাজবিন্যাস যত জটিল হয়েছে এই সহজ সরল ধর্মীয় ভাবনাও ততটাই জটিল হয়েছে। আদিম সর্বপ্রাণবাদের জায়গায় এসেছে শাস্ত্রোক্ত দেববিগ্রহ নির্মাণের নিয়ম। বিভিন্ন শিল্পশাস্ত্রে নির্দিষ্ট করা হয়েছে দেববিগ্রহ নির্মাণের খুঁটিনাটি। এর মধ্যে আছে তাল ও মান (পরিমাপ-সংক্রান্ত), আকৃতি ও প্রকৃতি (বিগ্রহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেমন দেখতে হবে) ভাব ও ভঙ্গি। এ-ছাড়া দেববিগ্রহের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলো হল আসন (পদ্মাসন) আয়ূধ বা অস্ত্র, বাহন, মুদ্রা। অর্থাৎ দেব-দেবী তাঁদের ধ্যানমন্ত্রে যেভাবে বর্ণিত সেইভাবেই তাঁদের রূপায়ণ করতে হবে। তবে এই নির্দেশ একমাত্র পুজোর জন্য যে-সব বিগ্রহ নির্মাণ করা হবে সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে বলা হয়েছে শিল্পশাস্ত্রে।
এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাংলার দারুবিগ্রহের (Daru Vigraha) জন্ম দিয়েছিল। ত্রয়োদশ শতকে এ-দেশে রাজশক্তির পরিবর্তনে মূর্তি পুজোয় এসেছিল ভাটার টান। পূর্ববর্তী শাসকদের মতো নতুন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় দেব-দেবীর বিগ্রহ নির্মাণ থমকে গেছিল। লোকচক্ষুর আড়ালে পাথর বা ধাতুর পরিবর্তে স্থানীয় শাসক এমনকী গ্রামবাসীর যৌথ উদ্যোগে আঞ্চলিকভাবে নানা ধরনের দেবদেবীর বিগ্রহ নির্মাণের জন্য সহজলভ্য কাঠ বা দারুকেই বেছে নেওয়া হয়। শিল্পীরাও ছিলেন মূলত স্থানীয় লোকশিল্পী যাঁরা মাটিতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাই প্রথম দিকে দারুবিগ্রহ নির্মাণে এই লোকশিল্পের প্রভাবটাই প্রতিফলিত হয়েছিল। সর্বভারতীয় শাস্ত্র অনুমোদিত বিগ্রহ নির্মাণের ধারা থেকে সরে এসে নিজেদের মতো করে তাঁরা এই বিগ্রহ নির্মাণ করতে থাকেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের জোয়ারে দারুবিগ্রহ (Daru Vigraha) নির্মাণরীতিতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। ভারতবর্ষের অন্যত্র অনেক দারুবিগ্রহ রয়েছে। কিন্তু বাংলার দারুবিগ্রহের সঙ্গে তার অনেক পার্থক্য। সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলার দারুবিগ্রহের ভাব অনেক কমনীয়। গবেষকদের মতে, এই দারুবিগ্রহ রূপায়ণ সম্ভব হয়েছিল শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে। ভক্তির প্রাবল্যে চাপা পড়ে যায় শাস্ত্রীয় অনুশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিগ্রহনির্মাণ রীতি। এক অপূর্ব বাংলা ঘরানার দারুবিগ্রহের আবির্ভাব ঘটে এই সময় থেকেই।
আরও পড়ুন: আবেদন খতিয়ে দেখে ভেলোরে যাওয়ার অনুমতি দেবে রাজ্য, অযথা স্বাস্থ্যসাথী নয় দক্ষিণে
নীলাচলে জগন্নাথদেবের দর্শনের পর তাঁর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে থাকেন নিমাই। তাই তাঁর আরাধ্যকে পুজো করার প্রবণতা দেখা দেয় বাংলাতেও। জগন্নাথকে বলা হয় দারুব্রহ্ম। তিনি নিমকাঠ দ্বারাই নির্মিত। সেই ধারায় শুধু জগন্নাথদেব নন গৌর-নিতাই-সহ অন্যান্য দেব-দেবীর বিগ্রহ নির্মাণেরও শুরু হয়। অনেকের মতে নিমাইয়ের জন্ম হয় নিমগাছের তলায়। তাই নিমগাছ ছিল তাঁর প্রিয়। এই কারণে নিমকাঠ দিয়েই বিগ্রহ তৈরি হতে থাকে বাংলায়। আগে যেখানে বেলকাঠ, আমকাঠ আর কাঁঠালকাঠেই যা হত। তবে নিমকাঠে সহজে ঘুণ ধরে না। তাই অন্যান্য কাঠের বদলে স্থায়িত্বের জন্য এই কাঠকেই বেছে নেওয়া হয়।
বাসুদেব সার্বভৌমকে নীলাচলে অবস্থানকালে সাকার আর নিরাকার ঈশ্বরের মর্মার্থ বোঝানোর জন্য ষঢ়ভুজ রূপে প্রকট হয়েছিলেন মহাপ্রভু। ভক্তের মাঝেই ভগবানের বাস। এই সময় অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই এই ভাবনার আধারেই বাংলায় নির্মিত হতে থাকে দারুবিগ্রহ। আনতনয়না বা অর্ধনিমীলিত আত্মধ্যানস্থ দেবদেবীরা এবার তাঁদের দীঘল দৃষ্টি বিনিময় করতে শুরু করলেন ভক্তের সঙ্গে। বিগ্রহ নির্মাণের পরিভাষায় মৎস্যাক্ষী থেকে তাঁদের দেওয়া হল পটলচেরা চোখ। যা হয়ে উঠল বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
দেবতা কোনও ভয়ের বস্তু নন। তাঁকে দেখে ভালবাসার উদয় হতে হবে ভক্তের। তাই চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পর যখন নবদ্বীপে আসেন তখন প্রদীপ নিয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াও তাঁকে আরতি করতে গিয়েছিলেন। প্রণাম করে মুখ তুলে দেখেন নিমাই নেই। রয়ে গেছে তাঁর খড়ম জোড়া। সেই খড়ম জোড়াকেই পুজো করতেন তিনি। এরপর বিষ্ণুপ্রিয়াকে স্বপ্নে মহাপ্রভু নির্দেশ দেন তাঁর আঙিনার প্রিয় নিমগাছটি কেটে তা দিয়ে যেন তাঁর বিগ্রহ নির্মাণ করে সেই বিগ্রহের পুজো করেন বিষ্ণুপ্রিয়া। সেইমতো নির্মিত হন ধামেশ্বর মহাপ্রভু। এঁর মাঝেই লীন হয়ে যান বিষ্ণুপ্রিয়া। তাই এই মহাপ্রভুকে বিষ্ণুপ্রিয়া রূপেও সেবায়েতরা আরাধনা করেন। অপরূপ এই বিগ্রহের সৌন্দর্য। পাঁচ ফুট উচ্চতার এই মহাপ্রভুর বিগ্রহটিকে এঁর অঙ্গ-সৌষ্ঠবের জন্য একেবারেই জীবন্ত বলে মনে হয়। সমপদ ভঙ্গিতে প্রস্ফুটিত পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিগ্রহের হাত দুটি সামনে প্রসারিত। যেন তিনি ভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেম বিলিয়ে দিচ্ছেন। গবেষকগণের মতে এটি প্রেমদান মুদ্রা। একান্তভাবেই বাংলার বৈষ্ণববিগ্রহ নির্মাণকারীদের উদ্ভাবিত এই মুদ্রা। তাঁর কেশরাজি মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা। মহাপ্রভুর আয়তকার দু-নয়ন একেবারেই বাংলার নিজস্ব পটলচেরা চোখের আদর্শ উদাহরণ। এই বিগ্রহ আরও আকর্ষণীয় হয়েছে শিল্পীর তুলির টানে। তাঁর দেহের গৌরবর্ণ থেকে দিঘল দুটি আঁখি, উজ্জ্বল লাল করপল্লব পদযুগলের সঙ্গে কিছু অলংকরণের (চুড়োয় লতাপাতার নকশা আর গলার মালা) কারণে শুধু ভক্ত নন শিল্পরসিকের কাছেও তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার দারুবিগ্রহের শিল্পীরা যে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে কাঠ খোদাইয়ে অনেকটাই কুশলী হয়ে উঠেছিলেন এই বিগ্রহের সুডৌল গড়ন আর নমনীয়তাই তার প্রমাণ।
বাংলার দারুবিগ্রহের উপরিউক্ত সমস্ত বৈশিষ্ট্য কলকাতার দারুবিগ্রহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এইসব বিগ্রহ কোনওটাই এখানে তৈরি হয়নি। যেসব পরিবার এই মহানগরীতে বসবাসের জন্য এসেছেন তাঁরা সঙ্গে করেই তাঁদের বিগ্রহ নিয়ে এসেছেন অথবা অন্য জায়গা থেকে নির্মাণ করিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এইসব দারুবিগ্রহ মূলত নদীয়া জেলার নবদ্বীপ, পূর্ব বর্ধমান জেলার দাঁইহাট, পাটুলি, বাঘনাপাড়া, হাওড়া জেলার বিনোলা, থলে রসপুর অঞ্চলের সূত্রধরেরাই নির্মাণ করতেন। বা আজও করেন। অনেক সময় বৃন্দাবন থেকেও বিগ্রহ এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
কলকাতার কিছু বিশেষ দারুবিগ্রহদের (Daru Vigraha) মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— চিৎপুরের দেবী চেত্তেশ্বরী, শেঠ বসাকদের কুলদেবতা শ্যামরাই, বড়বাজারের জগন্নাথ, সিমলা বাঘওয়ালা গোসাঁইবাড়ির জগন্নাথ মন্দির, নিত্যানন্দ প্রভুর মন্দির, শোভাবাজারের বলদেব, কলুটোলায় চুনিমণি দাসীর জগন্নাথ বাড়ি, টেরিটি বাজারের তাউবাদী চিনা উপাসনালয়ের নানা রকমের দেব-দেবীর বিগ্রহ, গড়িয়ার রথবাড়ি ইত্যাদি। অতি সম্প্রতি পুরনো কলকাতার গল্পের উদ্যোগে কলকাতার দারুবিগ্রহের ইতিহাস এবং অবস্থান নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ ভাবে কলকাতার ২৫টি দারুবিগ্রহের সঠিক অবস্থান মানচিত্রায়ণ করে এই বইটিতে পরিবেশিত হয়।
এ-প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কলকাতার কুমোরটুলি, কালীঘাটের পোটো পাড়ায় মাটির, চিৎপুরে পাথরের আর ধাতুর বিগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু দারু বা কাঠের বিগ্রহ হয় না। দারুবিগ্রহের অঙ্গরাগের জন্য উপরিউক্ত অঞ্চল থেকেই শিল্পীদের বায়না দেওয়া হয়। এমনকী শিল্পীদের বংশানুক্রমিক ভাবেও এই কাজ কোনও পরিবারের জন্য করতে দেখা গেছে। পাথর, মাটি বা ধাতুর ক্ষেত্রে স্থানীয় শিল্পীরাই করেন।