পায়ের তোড়া আর হাতের বালার বদলে কাঁচাবাদাম নয় পেয়ে যাবেন নস্টালজিয়ায় মোড়া সেই ‘চিনে বাদাম’। না খাবার বাদাম নয়; পরিচালক শিলাদিত্যের নতুন ছবি ‘চিনে বাদাম’-এর (Cheene Badam) কথা বলছি। মাঠে, ময়দানে, লেকের পাড়ে পা দুলিয়ে বসে কাগজের ঠোঙায় একরাশ চিনেবাদাম, লালরঙা ঝাল-নুন দিয়ে খেতে খেতে যুগলের মুহূর্তযাপন, হাসি-ঠাট্টা, রোমান্সের সেই চেনা দৃশ্য আজ অদৃশ্য। প্রেম যাপনের এই পুরাতনী অনুষঙ্গগুলির উপর যদিও কোনও নতুন মোড়কের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কালে কালে পাল্টে গেছে প্রেমের রূপ ও রং। আধুনিকতার, আতিশয্যের ঝাঁ-চকচকে জামা পরেই প্রেমে হল যত গোলমাল। খাচ্ছিল তাতি তাঁত বুনে কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে থুড়ি কাল হল ওই মুঠোফোনের অভ্যাসে। কে আর এখন বাদামভাজা চিবিয়ে শুকনো মুখে প্রেম করে! এখন ডিজিটাল প্রেমের যুগ। দেখনদারি এখানে বিরাট বিষয়। ফোন না থাকলে প্রেমের উদযাপন হত কী করে! তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি তা বোঝাতাম কী করে! অন্যে তা দেখে রসিয়ে উপভোগ করত কীভাবে! রাজ্য থেকে রাজনীতি, প্রেমবার্ষিকী থেকে এনগেজমেন্ট, বিয়ে এমনকী বিচ্ছেদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হতো কীভাবে! ফোনই তো এখন ধর্ম, কর্ম, সম্পর্ক, আবেগ, সংসার, অফিস, স্কুল, দোকান, বাজার— সব। নারী-পুরুষের পরম সঙ্গী আর সঙ্গিনী দুই-ই সেই ফোন। যদিও ফোনের এত গলদের মধ্যেও কিছু ভাল তো আছেই। গোটা জগৎ সংসার দেশ, দশ সব হাতের মুঠোয়, বাড়ি বসে পরিষেবা হাতের মুঠোয়, এই দেশে বসে সুদূরের সঙ্গে বন্ধুত্ব, প্রেমও এখন হাতের মুঠোয় সেই ফোনেরই দৌলতে। একটা সরি-তে ঝগড়া মিটে যায় সেই ফোনের দাক্ষিণ্যেই। আধুনিকতা আশীর্বাদ আবার অভিশাপও। সব পেয়েও মানুষ আজ একা। ভার্চুয়াল বন্ধুত্বর যুগে আমরা মুখোমুখি বসা, কথা বলার সম্পর্ককে বড়ই মিস করি। অ-ভার্চুয়াল বন্ধুতার মজাদার শর্তগুলো মিস করি। আর মিস করি চিনে বাদামকে যে একটা যুগে সব সম্পর্কের মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারত অনায়াসে। নতুন বাংলা ছবি ‘চিনে বাদাম’ (Cheene Badam) এমনই এক বন্ধুত্বের বার্তাবাহী। এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরে।
কথা হচ্ছিল ছবির পরিচালক শিলাদিত্য মৌলিকের সঙ্গে। ছবির গল্প নিয়ে তিনি জানালেন— ‘আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্কে অনেকটা দূরত্ব এসে গেছে। এখন সবকিছু মোবাইল ফোন কেন্দ্রিক। এই ছবির গল্পটি যিনি লিখেছেন তাঁর নাম মোমো। মোমো একদিন আমাকে বলল যে মানুষ তো খুব একলা হয়ে গেছে। বিশেষ করে অতিমারির পরে আরও দূরত্ব, একাকিত্ব বেড়েছে সবার মধ্যে। ট্রেন, মেট্রো, বাস— সর্বত্র এক ছবি। মুঠোফোনেই নিমগ্ন সবাই। আমরা সামনের অতি আপনজনকে ইগনোর করতে থাকি এই ফোনের জন্য অথচ বুঝতেও পারি না বা বোঝার চেষ্টা করি না। তো এমন একটা অ্যাপ যদি থাকত যে অ্যাপের মাধ্যমে নিখাদ বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। কনসেপ্টটা ছিল এইরকম এবং মোমোর এই আইডিয়া আমার খুব পছন্দ হয়। তাই এই গল্পটাকে নির্বাচন করি। গল্পতে ছবির নায়ক ঋষভ বিদেশ থেকে পড়াশুনো করে ফেরে। দু বছর বান্ধবী তৃষা তাঁর সঙ্গে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপে ছিল। এখন সে আর তার প্রেমকে ফোন-নির্ভর করতে চায় না। কিন্তু ঋষভ চায় এমন একটি অ্যাপ যার মাধ্যমে সবাই বন্ধু খুঁজে নেবে এবং বান্ধবী তৃষার সঙ্গে মিলে এমনই একটা অ্যাপ তৈরি করে যে অ্যাপের মাধ্যমে বন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়। আর যেহেতু প্রেমের মুহূর্ত যাপনের জন্য আজ আর কেউ চিনে বাদামকে সঙ্গী করে না তাই অ্যাপটির নাম দেয় ‘চিনে বাদাম’। বন্ধুত্ব পাতানোর এই অ্যাপ তৈরিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় নতুন অফিস এবং লোকজন। এই অ্যাপকে ঘিরেই তৈরি হতে থাকে নানান সমস্যা। ধীরে ধীরে আসে মান-অভিমান, সম্পর্কের টানাপোড়েন। বন্ধুত্বের অ্যাপের মাধ্যমে বন্ধু খুঁজে দিতে গিয়ে নিজেই বন্ধু- হারা হয় ছবির নায়ক ঋষভ। এই নিয়ে এগোয় ছবির গল্প।
আরও পড়ুন: দুর্নীতিতে চাকরি গেল সিপিএম নেতার ছেলের
পরিচালক আরও বললেন, ‘‘ছবিটা পরিবারকেন্দ্রিক। দুটো পরিবারকে নিয়ে একটা ছোট্ট সেট-আপ যার সব শুটিংই কলকাতাতেই হয়েছে। ছবির একটি গানের দৃশ্য শুটিং হয়েছে কাশ্মীরে। জটিলতাহীন খানিকটা কমেডিধর্মী প্রেমের ছবি হল ‘চিনে বাদাম’। মুঠোফোনের কবলে হারিয়ে গেছে নির্ভেজাল আড্ডা, মজা। মোবাইলের জন্য মানুষ তার চিরাচরিত সম্পর্ক, অনুভূতিগুলো থেকে সরে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এই বার্তাটাই আমি দিতে চেয়েছি আমার ছবিতে। ছবির সংলাপও বিষয়বস্তুর মতোই সহজ-সরল কোনও জটিলতা সেখানে নেই।”
চিত্রনাট্যও নিজেই লিখেছেন শিলাদিত্য। এই ছবিতে দুটি মুখ্যচরিত্রে প্রথমবার জুটি বাঁধলেন অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত এবং এনা সাহা। জারেক এনটারটেনমেন্ট বা বলা যেতে পারে এনা সাহার প্রোডাকশন হাউজের তৈরি এই ছবি। যশ এবং এনা বেশ সাবলীল তাঁদের নিজেদের চরিত্রে। এতদিন কমার্শিয়াল ছবিতে অভিনয় করেছেন যশ দাশগুপ্ত। স্বাভাবিক ভাবেই চিনে বাদামের মতো একেবারে অন্য স্বাদের, অন্য ধারার ছবিতে এবার তাঁকে দেখা গেল। তথাপি সবমিলিয়ে ছবিটি নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া মন্দ নয়।
ছবির গানগুলি বেশ মনে ধরেছে দর্শকদের। সুরকার সৌমঋতের সুরে চারটি গান রয়েছে এ-ছাড়াও একটি গানের সুর দিয়েছেন রূপক তিওয়ারি। গান গেয়েছেন সংগীত শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী, অনুপম রায়, সোমলতা, ঈশান মিত্র, মেখলা দাশগুপ্ত, বনি চক্রবর্তী। এই ছবির একটা ছোট্ট অংশের গান গেয়েছেন পরিচালক নিজেও। অন্য স্বাদের মিষ্টি প্রেমের ছবি ‘চিনে বাদাম’ (Cheene Badam) নতুন প্রজন্মকে ভাবাবে নিঃসন্দেহে।