কথামুখ
ছোটকত্তার বাড়িতে মন বসে না বাইজি বাড়ির হই-হুল্লোড় মদের ফোয়ারা তাঁকে বেশি করে টানে। গভীর রাতে অচৈতন্য ছোটকত্তাকে কোনওরকমে বাড়িতে এনে খাটে শুইয়ে দেওয়া হয়। প্রতি রাতেই এই ঘটনার সাক্ষী থাকেন পটেশ্বরী। এদিকে পটেশ্বরী রূপসী গৌরবর্ণা— স্বামীকে কাছে ধরে রাখবার জন্য নাছোড়বান্দা। স্ত্রীকে কাবু করতেই স্বামী ছুঁড়ে দেন তীক্ষ্ণশর “পারবে আমার সঙ্গে বসে মদ খেতে।” স্বামীকে ধরে রাখতে সে-কাজটিও করেন পটেশ্বরী। এইভাবে প্রতি রাত্রে মদ খেতে খেতে দেখা গেল পটেশ্বরী মাদকাসক্ত হয়ে উঠেছেন। তিলেতিলে পটেশ্বরীর এই অধঃপতন দেখে আড়াল থেকে যিনি শিউরে ওঠেন তিনি ভূতনাথ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল মিত্রের বহুপঠিত উপন্যাস ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর বিবি হলেন এই পটেশ্বরী। বহুপঠিত এই উপন্যাসকে বড় পর্দায় তুলে ধরলেন পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। যিনি পটেশ্বরী চরিত্রটি দাপটের সঙ্গে ফুটিয়ে তুললেন তিনি হলেন সুমিত্রা দেবী। একসময় ডাকসাইটে সুন্দরী প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী সুমিত্রা দেবীর অভিনয়ের জন্য দর্শকেরা বারবার ছুটে গেছেন সাহেব বিবি গোলাম দেখতে। সেখানে তাঁর পাশে রয়েছেন উত্তম কুমার (ভূতনাথ), ছবি বিশ্বাস (মেজকর্তা), ছায়া দেবী (বড় গিন্নি), নীতীশ মুখোপাধ্যায় (ছোট কর্তা ), অনুভা গুপ্ত (জবা), পদ্মাদেবী (মেজো গিন্নি) প্রমুখ জাঁদরেল সব শিল্পী। তবু সবাইকে ছাপিয়ে দর্শকদের নজর কাড়লেন সুমিত্রা দেবী। সাহিত্যের পাতা থেকে সরাসরি উঠে এলেন বড় পর্দায় তিনি।
আরও পড়ুন-নিঃশব্দ বিপ্লব: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করতে চলেছেন কাজের খতিয়ান
জীবনকথা
১৯২৩ সালের ২২ জুলাই সিউড়িতে সুমিত্রা দেবীর জন্ম। পিতৃদত্ত নাম নীলিমা। বাল্যশিক্ষা মজফফরপুরে। ১৯৩৪ সালে বিহারে ভূমিকম্প হয়। বাবা মূরলীধরের সঙ্গে সপরিবার চলে আসেন সুমিত্রা কলকাতায়। পড়াশোনার ছেদ পড়ে। নাচের তালিম নিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল ভাগলপুরে। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের ফলে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। অভিজাত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে চিত্রজগতের যোগদানের জন্য তাঁকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পরিচালক অপূর্ব মিত্রের নজরে পড়লেন তিনি। অপূর্ব মিত্র তাঁর ‘সন্ধি’ ছবিটি তখন তৈরি করছিলেন। অপূর্ব মিত্র প্রযোজক দেবকীকুমার বসুর সামনে নিয়ে এলেন সুমিত্রাকে। প্রযোজকের পছন্দ হল। চিত্রজগতে তাঁর নতুন নাম হল সুমিত্রা। ১৯৪৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘সন্ধি’ ছবিটি। প্রথম ছবিই হিট।
আরও পড়ুন-মানবিক মন্ত্রী, কলকাতায় চিকিৎসা ক্যান্সার-রোগীর
ছবির জগতে স্মরণীয় সব কাজ
সতীশ দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘পথের দাবী’ ছবিতে তিনি করলেন ভারতীর চরিত্র। সব্যসাচীর চরিত্রে দেবী মুখোপাধ্যায়। সুদর্শন সু-অভিনেতা দেবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুমিত্রার পরবর্তীকালে বিয়ে হয়। এটি ছিল সুমিত্রার দ্বিতীয় বিয়ে। দেবী মুখোপাধ্যায় ও সুমিত্রা দেবীর পরবর্তী ছবি ‘অভিযোগ’। পরিচালক সুশীল মজুমদার। স্বামী-স্ত্রীর পরবর্তী ছবি ‘জয়যাত্রা’। এই ছবির সময় থেকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। সংসারী ঝামেলা এড়াতে আত্মহত্যা করেন দেবী মুখোপাধ্যায়। ‘জয়যাত্রা’ মুক্তির আগেই সাংসারিক মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে দেবী মুখোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেছিলেন। সুমিত্রা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ছবির জগৎ থেকে কিছুদিনের জন্য তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। পরে আবার ফিরে আসেন ছবির জগতে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সুমিত্রার অভিনয়-দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় দুটি স্মরণীয় উপন্যাসের চিত্ররূপে। প্রথমটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’। নামভূমিকায় তিনি। বিপরীতে ব্রজেশ্বরের চরিত্রে প্রদীপকুমার। দ্বিতীয়টি শরৎচন্দ্রের ‘স্বামী’। সেখানে তিনি নায়িকা সৌদামিনীর চরিত্রে। স্বামীর ভূমিকায় পাহাড়ী সান্যাল, প্রেমিক নরেনের ভূমিকায় প্রদীপকুমার। দুটি ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করলেন সুমিত্রা দেবী। এই ছবি দুটির হিন্দি ভার্সানেও নায়িকা হয়েছিলেন সুমিত্রা দেবী। কলকাতায় নির্মিত একাধিক বাংলা ছবির হিন্দি রিমেকে অবধারিতভাবেই ডাক পড়েছিল সুমিত্রা দেবীর। এই তালিকায় রয়েছে সন্ধি, পথের দাবী এবং জয়যাত্রা। নরেশ মিত্রের পরিচালনায় নিয়তি ছবিতে সুমিত্রার অভিনয়ের প্রশংসা দর্শক-সমালোচকদের মুখে মুখে ফিরল। বিপরীতে ধীরাজ ভট্টাচার্য। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দস্যুমোহন’ ছবিতে সুমিত্রা নায়িকা। বিপরীতে প্রদীপকুমার। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারে আলো’ ছবিতে তিনি নায়িকা। বিপরীতে বসন্ত চৌধুরি। অসাধারণ অভিনয় করলেন সুমিত্রা। সুমিত্রা-বসন্ত জুটিকে আবার পাওয়া গেল ‘খেলা ভাঙার খেলা’ ছবিতে। কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ ছবিতে তিনি দেবদাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নামভূমিকায় অসীমকুমার। তাঁর পরবর্তী ছবির নাম ‘গড়ের মাঠ’। কলকাতার পাট চুকিয়ে মুম্বইযাত্রার আগে সুমিত্রার শেষ বাংলা ছবির নাম ‘যৌতুক’। পরিচালক জীবন গঙ্গোপাধ্যায়। সুমিত্রার বিপরীতে নায়ক হয়েছিলেন উত্তমকুমার।
আরও পড়ুন-মানবিক মন্ত্রী, কলকাতায় চিকিৎসা ক্যান্সার-রোগীর
হিন্দি ছবিতে তাঁর ভূমিকা
অশোককুমার মুম্বইয়ে নিয়ে গেলেন সুমিত্রা দেবীকে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসের হিন্দি চিত্ররূপ ‘সমর’ ছবিতে অশোককুমার অমরনাথের চরিত্রে অভিনয় করলেন। লবঙ্গলতার চরিত্রে সুমিত্রা দেবী। বোম্বে টকিজের ব্যানারে নির্মিত হয়েছিল ‘সমর’ ছবিটি। বাংলা-হিন্দি দু-জায়গাতেই অভিনয় করলেন সুমিত্রা। সুমিত্রা দেবীর হিন্দি ছবির তালিকায় রয়েছে ময়ূরপঙ্খী, ওসিয়াতনামা, মশাল, প্রতিবাদ, রাজযোগী, জাগতে রহো, মাই সিস্টার, উঁচনীচ, আনটাচেবল ইত্যাদি ছবি। রাজ কাপুর তাঁর প্রযোজনা সংস্থা আর কে ফিল্মসের ব্যানারে একটি ডাবল ভার্সন ছবি তৈরি করেছিলেন। বাংলাটির নাম ‘একদিন রাত্রে’, হিন্দিতে নাম ‘জাগতে রহো’। ছবিতে নায়ক-নায়িকার চরিত্রে প্রদীপকুমার সুমিত্রা দেবী অভিনয় করলেন। বাংলা ছবির একসময়ের জনপ্রিয় জুটি হয়ে পড়েছিলেন প্রদীপকুমার ও সুমিত্রা দেবী।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে প্রকল্পের কাজে বাড়ল গতি, ১ বছরে ৪৫৮ মৌজায় জল
শেষের কথা
বহুদিন বাদে আবার বাংলা ছবিতে শেষবারের মতো অভিনয় করলেন সুমিত্রা দেবী ১৯৬৪ সালে। সন্তোষকুমার ঘোষের ‘কিনু গোয়ালার গলি’ উপন্যাসের চিত্ররূপ দিলেন ও সি গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে এক ব্যর্থদম্পতির চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুমিত্রা দেবী অভিনয় করেছিলেন। বন্ধ্যানারীর চরিত্র সবাইকে চমকে দিলেন সুমিত্রা। আর অভিনয় করেননি সুমিত্রা। না হিন্দিতে না বাংলায়। সুমিত্রা মুম্বই-প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহসূত্রে মুম্বইয়ে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তবে সাফল্য পাননি। সুমিত্রা-প্রযোজিত শেষ হিন্দি ছবি ‘এক চাদর ময়লি সি’। দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসাধন্য হয়েছিল ছবিটি। ওই ছবিতে হেমা মালিনী, ঋষি কাপুর, কুলভুষণ খারবান্দা, পুনাম ধীলনের অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল। কিছুদিন রোগভোগের পর সুমিত্রা দেবী পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান ১৯৯০ সালের ২৮ আগস্ট মুম্বইয়ে। মৃত্যু অনিবার্য। শিল্পীরা অমর হয়ে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। সেইভাবেই সুমিত্রা দেবী আজও সজীব হয়ে আছেন দর্শকদের অন্তরে। তাঁর মতো রূপবতী অভিনেত্রী চিত্রজগতে খুবই কম দেখা গেছে।