একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান— হিন্দি বলয়ে সাংসদ হিসেবে পিছড়ে বর্গের প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত। ১৯৮৪-তে সংসদে পিছড়ে বর্গের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্রায় ১১ শতাংশ। ১৯৯০-এ তা বেড়ে ২০ শতাংশের বেশি। কিন্তু জনসংখ্যায় শতাংশের নিরিখে মুসলমান প্রতিনিধির সংখ্যা অতীব কম। উল্লেখ করার মতোই নয়। ২০১৯-এ লোকসভায় উচ্চবর্গীয় সাংসদ শতাংশের বিচারে প্রায় ২৯ শতাংশ। অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ২২ শতাংশ। আর, আগামী জুলাই মাসে রাজ্যসভায় তিনজন সদস্যের সাংসদ পদের মেয়াদ ফুরোলে ভারতীয় জনতা পার্টির তরফে কোনও মুসলমানই ভারতের সংসদে থাকবেন না।
হ্যাঁ, এবারই প্রথম সংসদে রাজ্যসভা কিংবা লোকসভায়, শাসক দলের তরফে এমন একজনও সাংসদ থাকবেন না যিনি কৌম পরিচয়ে ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু (Minority) সম্প্রদায়ের মানুষ।
এই ছোট্ট পরিসংখ্যানই বুঝিয়ে দেয়, মুসলমানকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরিয়ে রাখার সব বন্দোবস্তই সেরে ফেলেছে বিজেপি।
রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির সরকার। কিন্তু বিধানসভাতেও শাসক দলের পক্ষে এমন কোনও বিধায়ক পাওয়া যাবে না, যিনি মুসলমান। সংসদীয় রাজনীতির বলয় থেকে মুসলমানকে নিকেশ করে ফেলার ছক প্রথম কার্যকর হয়েছিল গুজরাতে। তার পর উত্তরপ্রদেশে। যোগী আদিত্যনাথের এই রাজ্যে ২০১৭ এবং ২০২২, দু’বারের বিধানসভা নির্বাচনেই শাসক দল নির্বাচনী রাজনীতির বৃত্তে সংখ্যালঘু মুসলমানরা যাতে ঘেঁষতে না পারে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
যদি কেন্দ্রে বা রাজ্যের আইনসভায় সরকার পক্ষে কোনও সংখ্যালঘু (Minority) জনপ্রতিনিধি না থাকেন, তবে মুসলমানের কান্না, মুসলমানের দাবি, মুসলমানের চাহিদা সরকারের কানে পৌঁছবে কে? সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব সরকার যথাযথভাবে পালন করবে কীভাবে? ভারতীয় গণতন্ত্রে বহুস্বরের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে কীভাবে?
এসব জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে বসলে সাফ বোঝা যায়, গত এক দশক করে ধর্মনিরপেক্ষতা আর বহুত্ববাদের ভিতটাকেই এদেশে সুপরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে দিয়েছে মোদি-শাহের সরকার। আপামর জনসাধারণকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠকানোর পাশাপাশি প্রতিনিধিত্বের অঙ্কটাকেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে মুসলমানকে জনপ্রতিনিধি না হতে দেওয়ার কৌশলে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের সময় এ ব্যাপারটাই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন বুলডােজার বাবা যোগী আদিত্যনাথ। ৮০ শতাংশের সমর্থনে, সংখ্যাগুরুর সমর্থনে জেতার গুমোরে সংঘ্যালঘু (Minority) ২০ শতাংশকে, মুসলমানকে মাফিয়া আর দুর্বৃত্তদের সম্প্রদায় বলে দেগে দিতে কসুর করেননি। অথচ, ভারত-ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের মধ্যে, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতার মধ্যে, বিবিধের মধ্যে মিলন ও সংহতিকে শক্তপোক্ত করতে হলে সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলে দিলে চলবে না। আইনসভায় সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের পরিমাণ বুঝিয়ে দেয় গণতন্ত্রে বহুত্ববাদের প্রতি মর্যাদা কতটা রক্ষিত হচ্ছে। আইনসভাগুলিতে সংখ্যালঘু সংসদ ও বিধায়কের সংখ্যা চিনিয়ে দেয় সম্প্রদায়গত বৈষম্য কতটা কম কিংবা বেশি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্টীয় কাঠামোতে।
আরও পড়ুন: গলছে হিমবাহ, এভারেস্টের বেসক্যাম্প সরানোর ভাবনা
এসব যদি মেনে নিই তাহলে এটা মানতেই হবে যে জনগণের দরবারে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ কেড়ে নিয়ে কোনও জনগোষ্ঠী বা কৌম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে কার্যকরী রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া যায় না।
আর, বর্তমান ভারতে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে সেটাই হচ্ছে মোদি-শাহর সৌজন্যে।
সবশেষে আর একটা কথা।
মুসলমানদের স্বার্থ দেখার জন্য মুসলমান জনপ্রতিনিধিই দরকার, এমন ভাবাটা অর্থহীন, অন্যায়, অনুচিত। অনেকাংশে বেঠিকও।
কিন্তু এরকম অনর্থক, অযৌক্তিক ভাবনাও সঠিক প্রতিপন্ন হয় যখন অ-মুসলমান জনপ্রতিনিধরা ঘৃণা ভাষণে অনর্গল হন।
মুসলমান জনপ্রতিনিধি ছাড়া মুসলমানের স্বার্থ সুরক্ষিত নয়, এরকম বোকা বোকা কথাও ভিত্তিহীন বলে মনে হয় না যখন মুসলমানের বাড়িঘর, দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
সংসদীয় রাজনীতির মঞ্চ থেকে কাউকে উধাও করে দিলে, সেই সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার অধিকারের বর্মটুকুও খসে পড়ে।
মোদি জমানা এসব প্রমাণ করে ছেড়েছে।
এই নষ্টামির হাত থেকে ভারতবর্ষকে বাঁচিয়ে সনাতন শাশ্বত ভারতের পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনে একটা কাজই করতে হবে।
২০২৪-এ বিদায় বাজনা বাজাতে হবে এই বিভাজনকারী বিদ্বেষ-প্রসারী কেন্দ্রীয় সরকারের।
না! শুধু মুসলমানের স্বার্থরক্ষার জন্য নয়।
ভারতীয়ত্বের বুনিয়াদি মৌল রক্ষা করার জন্য।
মোদি জমানার আট কাহন এটাই শিখিয়েছে।