তথ্যচিত্রের প্রস্তাবে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আমি একেবারেই ব্যক্তিগত প্রচার পছন্দ করি না। তাই শুরুতে একটু আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন উদ্যোক্তারা বলেন, ওঁরা আমার কাজটাকে ধরতে চান। পরের প্রজন্মের জন্য। সেই কারণেই রাজি হয়েছি। আসলে বহুবছর আগেই আমি আবৃত্তি শিক্ষার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি বের করেছি। যেটা অনুসরণ করে আবৃত্তি শেখাই। লিখেছি বইও। বিষয়টা যদি একটা তথ্যচিত্রে ধরা থাকে, তাহলে তো ভালই। তাই শেষমেশ কাজটা করলাম।
আবৃত্তিশিল্পের প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে?
আরও পড়ুন-হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা দীপ্তিময় দীপ্তি
ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে কবিতা আওড়াতে ভালবাসতাম। তার জন্য বকুনিও খেয়েছি। বাড়িতে পুরোহিত মহাশয় আসতেন পুজো করতে। ওঁর অনুকরণে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করার চেষ্টা করতাম। এইসব আমার ভিতরে ছিল। ধরা যায় সেই শুরু।
বাইরে প্রকাশ ঘটেছে কোন সময়ে?
অনেক পরে। যদিও আমার আবৃত্তিকার হওয়ার বাসনা ছিল না। একটা সময় আমি লেখালেখি করতাম। কবিতা, গল্প। কোথাও ছাপা হত না। আমরা একটা পাঠাগার খুলেছিলাম। ছাত্রবন্ধু পাঠাগার। মূলত পাঠ্যবইয়ের। সেখান থেকে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা বের করেছিলাম। সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। একবার ঠিক হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করব। দায়িত্ব চাপল আমার ঘাড়েই। সহযোগিতায় করলেন মণি দত্ত নামে স্থানীয় একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি স্ক্রিপ্ট লিখলেন। হাওড়ার রামরাজাতলা বাণীনিকেতন হলে পরিবেশিত হল আমাদের মিশ্রকলা। অনুষ্ঠানে আমি আবৃত্তি করেছিলাম অনেকগুলো কবিতা। ওটাই ছিল আমার প্রথম জনসমক্ষে আবৃত্তি। তারপর বিভিন্ন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করলাম। আজকের বহু নামী শিল্পী সেইসময় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। এইভাবে চলতে থাকল বেশ কয়েক বছর। একটা সময় বহু আন্দোলনের পরে জন্ম নিল আমাদের আবৃত্তির প্রতিষ্ঠান ছন্দনীড়। রবীন্দ্রসদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। আমরা ডাক পেলাম। ধীরে ধীরে আরও অনেক অনুষ্ঠান। তৈরি হল আরও আবৃত্তির সংস্থা। বাড়তে থাকল আবৃত্তির প্রচার, প্রসার। আমাদের সবকিছু নিজেদেরই করে নিতে হয়েছে।
আরও পড়ুন-বিজ্ঞানের আলোকপ্রাপ্তা কমল রণদীভ
আপনাদের শেখাটাও প্রায় নিজে নিজেই, তাই তো?
আমাদের সময় অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় নাড়া বেঁধেছিলেন। শিখেছিলেন আবৃত্তি। আমারটা কিন্তু সেইরকম নয়। আমিও শুরুতে শিখতে গেছি। তবে স্যাটিসফাইড হইনি। তখন ভাবলাম, গানের যেমন স্বরলিপি আছে, ব্যাকরণ আছে, আবৃত্তিরও নিশ্চয়ই ব্যাকরণ আছে। শুরু করলাম খোঁজা। খুঁজতে খুঁজতেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আজকের এই পদ্ধতি।
তারপর বই লিখলেন?
বই লিখেছি অনেক পরে। ছন্দনীড়ের পক্ষ থেকে পত্রিকা প্রকাশ করতাম। লিখতেন অনেকেই। সম্পাদনা করতাম আমি। তখন ভাবলাম, যে পদ্ধতিটা আমি জড়ো করেছি, প্রয়োগ করেছি সঙ্গীদের উপর, সেটা এখানে একটু প্রকাশ করা যাক। এই ভাবেই লেখালিখির শুরু। লিখতে লিখতে বই। আবৃত্তি নিয়ে আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যেকটাই গবেষণামূলক গ্রন্থ।
আরও পড়ুন-আলোর পথের দিশারি
আবৃত্তি কি শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে?
আবৃত্তি একটা শিল্প। যতখানি শিল্প গান, ততখানি। যে-কোনও শিল্পের একটা মনোরঞ্জনের দায় থাকে। সেই দায় আবৃত্তিরও আছে। শ্রোতাদের কাছে উপভোগ্য করে তুলতে হবে। নাহলে সেটা শিল্প বলে গণ্য হতে পারে না।
অনেকেই দর্শকদের রুচির কথা ভেবে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
একজন মননশীল শিল্পী, যিনি যে-কোন শিল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন, তিনি কখনও শ্রোতাদের মুখ চেয়ে বিষয় নির্বাচন করেন না। তাঁর ভাবনা-চিন্তার দিকে শ্রোতাদের টেনে নিয়ে যেতে চান। যাঁরা একটার পর একটা মঞ্চ পেতে চান, তাঁরাই শ্রোতাদের কথা ভেবে কবিতা বা গান নির্বাচন করেন এবং মঞ্চে পরিবেশন করেন। তাঁরা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চান যাতে আরো পাঁচ জায়গা থেকে ডাক আসে। মনে রাখতে হবে, পাঠক গ্রহণ করবেন কিনা সেটা ভেবে কোনও কবি কবিতা লেখেন না, কোনও সুরকার, গীতিকার গান তৈরি করেন না। তাঁরা সৃষ্টি করেন মনের আনন্দে।
আরও পড়ুন-মেঘ ভাঙা বৃষ্টি অমরনাথ গুহার কাছে, মৃত একাধিক
ফিরি তথ্যচিত্র প্রসঙ্গে। কেমন লাগল কাজটা করে?
আমার শরীর বহুদিন ধরেই খুব খারাপ। শ্যুটিংয়ের আগে একবার করোনা হয়ে গেছে। তাই কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। ভাবছিলাম পারবো তো! আমার শরীরের কারণে মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে না তো! তবে কাজ শুরু করার পর বদল ঘটেছে ভাবনার। আনন্দের সঙ্গেই করেছি কাজটা। আমার বাড়িতে শ্যুটিং হয়েছে। পাশাপাশি বিই কলেজ, বাণীনিকেতন হলেও। বিভিন্ন রকম প্রশ্ন সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে আমার সামনে। উত্তর দিয়েছি। কোনও কোনও সময় আবৃত্তিও করেছি। সব মিলিয়ে মন্দ হয়নি। বাকিটা যারা দেখবেন, তাঁরা বলবেন। জেলায় জেলায় দেখানোর একটা পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
আরও পড়ুন-বৃষ্টির জলে ডুবল স্কুল বাস!
আবৃত্তি শিল্পের প্রতি নতুন প্রজন্মের উৎসাহ কতটা?
এখন শরীর ভেঙে গেছে। তবে একটা সময় প্রচুর অনুষ্ঠান করেছি, প্রায় ৪০০ কর্মশালা করেছি, বক্তৃতা দিয়েছি। নতুন প্রজন্মের নিষ্ঠা নিয়ে খুব একটা আশ্বাস দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও এখন অনেক নতুন ছেলে-মেয়েই শিখতে আসছেন। উৎসাহটা বহুগুণ বেড়েছে। সাতের দশকের তুলনায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। দলে দলে ছেলেমেয়েরা শিখছেন। তবে সমস্যা হল, তাঁদের হাতে সময় খুব কম। পড়াশোনা, অফিস সামলে আবৃত্তি নিয়ে খুব বেশিক্ষণ বসার সময় পান না। পড়াশোনা অর্থাৎ পড়া এবং শোনা দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে। আমার কাছেও বহুজন আসতে চান। শেখার জন্য। প্রচুর উৎসাহ তাঁদের। সবাইকে নিতে পারি না। আসলে সবাই খাটতে পারেন না। তাই ঠিকঠাক তৈরি হতেও পারেন না। আমরা পড়াশোনা চাকরিবাকরি বজায় রেখে আবৃত্তিচর্চা করেছি, দিনের পর দিন অনুষ্ঠান শুনতে গেছি।
সেই সময়কার শিল্পীদের কথা একটু বলুন…
আরও পড়ুন-রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর জন্মদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
আমরা শুনতাম শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি, কাজী সব্যসাচী, প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তি। আবৃত্তি বলতে আমাদের কাছে ছিলেন এঁরাই। প্রচুর অনুষ্ঠান শুনেছি। শুনতে শুনতে শিখেছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্র আমার কাছে ছিলেন গুরুর মতো। ওঁর কণ্ঠে ‘মধুবংশীর গলি’র আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কী ভীষণ আবৃত্তি। ওঁর বলা, লেখা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সময় বুঝতে চেষ্টা করেছি। ভাল লাগত আবুল কাশেম রহিমুদ্দিনের আবৃত্তি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আবৃত্তিও শুনেছি। বেশ কয়েকটি আবৃত্তির রেকর্ড বেরিয়েছিল ওঁর। ছন্দনীড়ে ক্লাসের বাইরে একটা সময় মাঝেমধ্যেই আমরা বিভিন্ন শিল্পীর আবৃত্তির রেকর্ড বাজিয়ে শুনতাম। বিশ্লেষণ করতাম। আলাপ-আলোচনা হত। বুঝতে চেষ্টা করতাম পূর্বসূরিদের। এইভাবে আমরা নিজেদের তৈরি করেছি। শিখেছি চিন্তা করতে। এটাই মূল কথা। কাজটা বড্ড পরিশ্রমের। কেউ ক্লাসে এলেন, একটা কবিতা দেখিয়ে দিলাম, শিখে চলে গেলেন— এটা আমার পদ্ধতি নয়। অত সহজে কিছু হয় না। এইসমস্ত বিষয়ে কিছু কিছু কথা বলেছি তথ্যচিত্রে। সবটা তো অল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়।