নয়াদিল্লি, ভারতের রাজধানী, যে শহরের পথনামে মিশে আছে ইতিহাস। লেগে আছে পরিবর্তনশীলতার সুবাস কিংবা দুর্গন্ধ।
এ শহরে পৃথ্বীরাজ রােডের (Prithviraj Road) ছায়াঘন রাস্তা পড়েছে আওরঙ্গজেব লেনে। আওরঙ্গজেব রােডের নাম বদলে গিয়েছে। নয়া নাম এপিজে আবদুল কালাম রোড। কিন্তু ছোট্ট গলিটাতে এখনও রয়ে গিয়েছেন মুঘল বাদশা। বাবরের নামেও এই শহরে একটা ছোট্ট রাস্তা আছে। আর কিছু না হোক, দুটো মিষ্টির দোকানের সুবাদে সে রাস্তা বেশ পরিচিত। জুনিয়র মডার্ন স্কুল আর খান মার্কেটের সংযোগকারী রাস্তাটা বাবর পুত্রের নামে নামাঙ্কিত। সেটা হুমায়ুন রোড। পেল্লায় সাইজের রাস্তা আকবর রোড। ইউপিএসসি-র অফিসে যেতে হলে শাহজাহান রােডে পা রাখতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য বলে, এই রাস্তার আসলি গৌরব লুকিয়ে আছে এখানকার পাপড়ি চাটের দোকানে। পার্সিদের কবরখানার ভিতর দিয়ে শাহজাহান রোড মিশে গিয়েছে পৃথ্বীরাজ রোডে (Prithviraj Road)। আগেকার দিন হলে এই মিশে যাওয়াতে একটা অন্য সমন্বয়কারী সহিষ্ণু ভারতের গন্ধ খুঁজে নেওয়া যেত। এখন, উগ্র হিন্দি-হিন্দুত্বের দাপাদাপিতে এই মিলন অন্য বিতর্কের উসকানি হয়ে দাঁড়ায়।
এসবের মধ্যে লক্ষণীয়, জাহাঙ্গিরের নামে কোনও রাস্তা নেই। ১৯৫৯-এর মানচিত্র খুলে বসলে অবশ্য দেখা মিলবে নুরজাহান রােডের। মিল্টো রোড পেরোলেই সে রাস্তায় পা পড়ত। খোদ দিল্লি শহরে জাহাঙ্গিরের নামে কোনও রাস্তা নেই কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসে বারবার একটা কথাই মনে হয়েছে। জাহাঙ্গির তো কোনওদিন দিল্লি শাসন করেননি। তাই, তাই-ই, রাস্তার নামে তাঁকে সেঁটে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি কেউ। জাহাঙ্গির তো দেশ চালাতেন লাহোরে বসে।
১৫২৬। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। বাবর দিল্লি দখল করলেন। ১৫৩০-এ তাঁর ইন্তেকাল হল। সত্যিকার দিল্লিওয়ালা ছিলেন শাহজাহান। তিনিই দিল্লি নগরী স্থাপন করেছিলেন।
দিল্লির সংবাদপত্র দুনিয়া বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে অবস্থিত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, সবার দফতর যেখানে, ১৯৬২ থেকে সেটাই বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ। ১৮৬২-তে রেঙ্গুনে মারা গিয়েছিলেন বাহাদুর শাহ। তাঁর মৃত্যুশতবার্ষিকী উপলক্ষে ওই নামকরণ। সিপাহি বিদ্রোহ, যাকে হিন্দুত্ববাদী সাভারকর ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন, তার পর দিল্লি গেটের কাছে বাহাদুর শাহের ছেলেদের হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দুঃস্বপ্নকে চ্যালেঞ্জ করে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র বিদ্রোহীদের নেতা বাহাদুর শাহর নামে মথুরা রোডের একাংশের নাম রেখেছিল। ঔপনিবেশিক স্মৃতির অন্তস্তল থেকে জাগ্রত জাতীয়তাবাদের উদগীরণ চিহ্ন সেই নামকরণে স্পষ্ট ছিল।
আরও পড়ুন: আধ্যাত্মিকতা সামাজিকতা ও অর্থনীতির সুষম মেলবন্ধন এই কোরবানি
ঐতিহাসবিদরা বলেন, নয়াদিল্লিতে রাস্তার নামকরণ ঔপনিবেশিক শাসনের পরম্পরা। ব্রিটিশরা আসার আগে দিল্লিতে জায়গার নামকরণ করা হত, রাস্তার নাম রাখার রেওয়াজ ছিল না। চাঁদনি চক তখন একটা জায়গাকে বোঝাতে। ওই নামে কোনও রাস্তা ছিল না।
তবে, দিল্লি হল গিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের। তাই, এখানকার রাস্তার নামের তাৎপর্যই আলাদা। গত শতাব্দীর সাতের দশকে নির্জোট আন্দোলন আর তৃতীয় বিশ্বের সংহতি, এধরনের কথাগুলো দারুণ গুরুত্ব পেত। সে সময়ে দিল্লির নতুন রাস্তাগুলোর নামকরণে সেই গুরুত্ব ঠিকরে ঠিকরে বের হত। ওনক পামে, হো চি মিন, আর্চ বিশপ মাকারিওজ, বেনিত্তো জুয়ারেজ প্রমুখ সে আমলে রাস্তার নামকরণে ভিন্ন গুরুত্বে অন্বিত হতেন। এখন সেসবের পাট চুকেছে। মুলচাঁদ ক্রসিংয়ের কাছে রিং রোড যেখানে মিশেছে, সেখানটার নাম এখনও জোসেফ ব্রাস টিটো মার্গ। টিটো এবং যে দেশের তিনি স্থপতি ছিলেন সেই যুগোস্লাভিয়া, দুই-ই এখন বিশ্ব মানচিত্র থেকে উধাও। তবু, তবুও, নয়াদিল্লির স্থাননামে টিটো রয়ে গিয়েছেন বিবর্ণ সাইনবোর্ডের মতো। বিংশ শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকে ঔপনিবেশিক অতীত মোছার প্রণোদনায় রাস্তার নাম কমবার বদলায়নি। ওয়েলেসলি রোড বদলে হয়েছে জাকির হোসেন মার্গ। কর্নওয়ালিস রোড সুব্রহ্মণ্যম ভারতীর কাছে হার মেনেছে। কার্জন পর্যুদস্ত হয়েছেন কস্তুরবা গান্ধীর কাছে। সবচেয়ে বড় কথা, কিংসওয়ে হয়েছে রাজপথ আর কুইন্সওয়ে জনপথ। তা বলে সব নাম বদলের পেছনে জাতীয়তাবাদের ছায়া দেখতে চাইলে ভুল হয়ে যাবে। লিটন রোড নাম বদলে যে কোপার্নিকাস মার্গ হয়েছে, তাতে জাতীয়তাবাদের ইশারা কোথায়!
তা বলে কি সব মুছে ফেলা যায়? যায় না। অ্যাদ্দিন পরেও লুটিয়েনের দিল্লির কনট প্লেস আর কনট সার্কাস রাজীব চক কিংবা ইন্দিরা চক হয়ে উঠতে পারল কই? মেট্রো চালু হওয়ার পর মেট্রো স্টেশন হিসেবে রাজীব চক অবশ্য কিছুটা হলেও জনস্মৃতিতে, গণউচ্চারণে জায়গা করে নিয়েছে।
মোদি-শাহ-র হিন্দি-হিন্দুত্বের জমানায় তাবৎ ইসলামী ঐতিহ্য, সুলতানি পরম্পরা, বাদশাহী বিন্যাস মুছে ফেলার তাগিদ স্পষ্ট। ভারতের নব নির্মাণ পর্বে নতুন নামকরণ অন্য মাহাত্ম্য টেনে আনার হাতিয়ার।
সে হোক। তাতে ক্ষতি হলেও, ইতিহাস বিকৃতির সম্ভাবনা থাকলেও আটকানোর চেষ্টা বৃথা। আমার নজর অন্য দিকে।
অনেক ধরে খুঁজছি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও উদ্ধার করে উঠতে পারিনি। ইন্ডিয়া গেটের কাছে পাণ্ডারা রোড আর পাণ্ডারা পার্কের ইতিবৃত্ত। এহেন নামকরণের উৎস ও তাৎপর্য। সেবার একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের পাতায় দেখলাম সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দেখলাম এবিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলছেন, আসলে নামটা পাণ্ডব রোড। বানান ভুলের কারণে ‘ভি’ অক্ষর ‘আর’ হয়ে গিয়ে ‘পাণ্ডব’ ‘পাণ্ডারা’ হয়েছে।
তা যদি সত্যি হয়, তবে মোদি-শাহদের উচিত, ইসলামী নাম বদল করার ফাঁকে মহাভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে এই করণিকসম ভ্রান্তি ঘুচিয়ে রাস্তাটির অবিলম্বে নতুন নাম দেওয়া।
ইন্দ্রপ্রস্থের বুকে মহাভারতীয় হিন্দুত্বকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা ব্যর্থ হোক। লোকে নিক, না-নিক, নয়া নামকরণের ঢেকুর ওঠা যেন বন্ধ না হয়।