এখন আমরা প্রায়শই শুনে থাকি মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ক্লাউড বার্স্টের (Cloudburst) কথা। এটা সাধারণত প্রচণ্ড বৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, ভয়ানক আবহাওয়াজনিত দুর্যোগকেই চিহ্নিত করে। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখা করে একে সুপারসেল থান্ডারস্টর্ম বলা হয়। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই এই সুপারশেল থান্ডারস্টর্ম একটু বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে মুম্বইয়ে বিপুল বৃষ্টিপাত, উত্তরকাশী, গুজরাতের বৃষ্টিপাতের ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সম্প্রতি অমরনাথে এই মেঘভাঙা বৃষ্টির (Cloudburst) প্রভাবে ষোলোজনের মৃত্যু ঘটেছে এবং চল্লিশজন নিখোঁজ হয়েছেন। ভারতের মেটরলজিকাল (Meteorological) বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী একঘণ্টায় প্রায় ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল সেখানকার বিক্ষিপ্ত এলাকা জুড়ে। এটা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে অল্প সময়ে মাঝারি মানের বৃষ্টিপাত কিন্তু আবার এটাই সময় সময়, স্থানকাল পরিবেশভেদে ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে মুহূর্তে, যেটা অমরনাথের ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া গেল।
মনে রাখতে হবে মাঝারি -বিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি বা থান্ডারস্টর্ম সাধারণত ৩৫ কিলোমিটার এরিয়াতে হয়। ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত যদি ১০০০ স্কোয়্যার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হয় তবে তার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৫০০ টালার ট্যাঙ্কপূর্ণ জলের সমান, অতএব একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে এই ৫০০ টালার ট্যাঙ্কের সমান জল যদি একঘণ্টায় কোনও পাহাড়ি নদীর সামনে ফেলা হয় তার পরিণতি একমাত্র তাৎক্ষণিক বন্যা। যার ফলশ্রুতিই কিন্তু অমরনাথের ভয়াবহ দুর্ঘটনা, ষোলজনের মৃত্যু এবং চল্লিশজন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া।
প্রসঙ্গত অমরনাথ সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উপরে স্থিত। ওই উচ্চতায় ভিজিবিলিটি এবং ভার্টিকাল উইন্ড স্পিড উদ্ধারকার্যে ব্যবহৃত হেলিকপ্টার অপারেশনে অসুবিধের সৃষ্টি করে। যে কারণেই ওখানে নিখোঁজ যাত্রীর সংখ্যা এতটাই বেশি হয়েছিল। এইরকম আবহাওয়ার পরিস্থিতির জন্য বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং ঊর্ধ্বাকাশে জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন তলের ঊর্ধ্বে অস্থিতিশীলতার প্রয়োজন অর্থাৎ সোজাভাবে বলতে গেলে থান্ডারস্টর্ম হতে গেলে আবহাওয়ার তিনটে অবস্থা বা কন্ডিশন জরুরি। প্রথমত, সারফেস লেভেল বা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা বেশি থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি তাপমাত্রা বেশি থাকতে হবে এবং তৃতীয়ত ঊর্ধ্বাকাশে সমতল থেকে ২০০০ ফিটের বেশি উচ্চতায় বায়ুর একটা অস্থিতিশীলতা বা ইনস্টেবিলিটি থাকতে হবে।
বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেশি থাকলে সমুদ্র সমতলের বা ভিজে মাটি থেকে তৈরি জলীয় বাষ্পের গতি ঊর্ধ্বমুখী হয় অর্থাৎ দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং এরপর তা ২০০০ ফিট উচ্চতায় পৌঁছে গেলেই তাপমাত্রা কমে যায় এবং ঘণীভূত হয় ফলে এখানে এসে জলীয়বাষ্প মেঘে পরিণত হয়। এই মেঘই ঠিক ফুলকপির মতো দেখতে হয় যাকে বলে কিউমিউলাস ক্লাউড। যার বেসটা দেখলে একেবারে মনে হয় যেন মেঘগুলো ব্লেড দিয়ে কাটা।
এই ২০০০ ফিটের উপরে বায়ুমণ্ডল যত অস্থিতিশীল হবে ততই এই মেঘের (Cloudburst) উচ্চতা বাড়বে। এরপর সেটা বাড়তে বাড়তে যখন একেবারে ফ্রিজিং লেভেল বা জিরো ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছয় অর্থাৎ বরফকণায় পরিণত হয় তখন অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়। এবার এই উচ্চতা যদি ছয় থেকে আট কিলোমিটার হয় তাহলে তা বজ্রবিদ্যুৎ-সহ মেঘ বা থান্ডারস্টর্মে পরিণত হয়। এই মেঘ মোটামুটি ১০০০ স্কোয়্যার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে সামান্য থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত ঘটাতে সক্ষম। এই উচ্চতা যত বাড়বে বজ্রপাত-সহ বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ততই বাড়তে থাকবে। এইভাবে উচ্চতা বাড়তে বাড়তে যদি তা বারো থেকে আঠারো কিলোমিটার হয় তখন তাকেই বলা হয় সুপারসেল থান্ডারস্টর্ম। এই অবস্থায় মেঘ (Cloudburst) হবে ক্রিস্টাল বরফের মতো আর তাপমাত্রা হবে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। শিলাবৃষ্টির যে শিল তার ব্যাস হবে পাঁচ সেন্টিমিটারেরও বেশি এবং বাতাসের আনুভূমিক গতিবেগ হবে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারেও বেশি। ঝড়ের ঊর্ধ্বগতি যত বৃদ্ধি পাবে দুর্গতি তত বাড়বে। তখন কিন্তু মোটামুটি ২০০০ স্কোয়্যার কিলোমিটার জায়গাতে অনায়াসে ১০০ মিলিমিটার মতো বৃষ্টিপাত হবে। ২০০৫ সালের ২৬ জুলাই মুম্বই শহরে পর পর দুদিন ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হয়েছিল। দু’দিনে এই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০০ মিলিমিটার। যা প্রতি ১০০০ স্কোয়্যার কিলোমিটার প্রায় তিরিশ হাজার টালার ট্যাঙ্ক পূর্ণ জলের সমান। যার পরিণতিস্বরূপ সেই বর্ষণে প্রায় ১০৯৪ জনের মৃত্যু ঘটেছিল।
আরও পড়ুন: ইয়াসিরের হাতে ফিরল ওয়ার্নের শতাব্দী-সেরা বল, চান্ডিমালের দাপটে এগোল শ্রীলঙ্কা
এই দুর্যোগের (Cloudburst) আগাম পূর্বাভাসের শেষ কথা হল এক্স-ব্যান্ড ডপলার রেডার বা এক্স-ব্যান্ড ওয়েদার রেডার যন্ত্র। এই যন্ত্র দুশো থেকে চারশো কিলোমিটারের মধ্যে থান্ডারস্টর্মের সম্ভাবনা তৈরি হলে তা অনুসন্ধান করে পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে দিতে সক্ষম। শুধু তাই নয় যন্ত্রটি ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ার দু তিনঘণ্টা আগে থেকে নিখুঁত বর্ণনা করে। যে কারণে প্রত্যেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই এক্স-ব্যান্ড ওয়েদার রেডার থাকেই। এটি যত উঁচুতে বসানো হবে তত দূরের জিনিস দেখতে পায়। রেডারটি একটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সিগনাল প্রেরণ করে যে সিগনাল সোজা থান্ডারস্টর্মে গিয়ে ধাক্কা মেরে নিক্ষিপ্ত হয়ে আবার ফিরে চলে আসে এবং রেডারটি সেই সিগনাল পুনরায় ধরে এবং হিসেব করে বলে দেয় থান্ডারস্টর্ম ঠিক কতদূরে, কোথায় রয়েছে, তার ভার্টিকাল হাইট কত ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য। এই যন্ত্র যার কাছে রয়েছে তিনি একজন মেটেরলজিস্টের থেকে ভাল বলতে পারবেন থান্ডারস্টর্মের গতিবিধি সম্পর্কে।
আমাদের কলকাতায় গঙ্গার পাড়ে নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে একটি এস-ব্যান্ড রেডার রয়েছে। ওটা দিয়েই কাজ চালানো হয়। বাংলাদেশেও এমন পাঁচটি রেডার রয়েছে যা প্রায় চব্বিশঘণ্টা চলে। ওই রেডারগুলো থেকেও থান্ডারস্টর্মের (Cloudburst) গতিবিধি সম্বন্ধীয় অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
অমরনাথে যেহেতু প্রতিবছর দশ থেকে পনেরো হাজার তীর্থযাত্রী যাতায়াত করেন সেইহেতু জম্মু-কাশ্মীরে ধানিহালে এক্স-ব্যান্ড ওয়েদার রেডার অপারেশনাল হওয়ার কথা চলছে। এটি রণকৌশলগত জায়গা বা ডিফেন্স এরিয়া তাই রেডার বসাতে একটু সময় লাগছে। তবে রেডার বসলেই হবে না একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ ও প্রশাসনিক সক্রিয়তা এবং তৎপরতাও জরুরি, কারণ পাহাড়ি এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে কখনও-কখনও একঘণ্টা সময় হাতে পাওয়াও দুর্লভ হতে পারে।
আবহাওয়া-সংক্রান্ত অনেক ধরনের যন্ত্র আছে নানাবিধ অনুসন্ধানের জন্য। যার মধ্যে রয়েছে সারফেস অবজার্ভেশন, আপার এয়ার অবজার্ভেশন, রেডিয়েশন, রেডার (০) স্যাটেলাইট অবজার্ভেশন উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আবহাওয়ার বিভিন্ন তলে বাতাসের উলম্বগতি মাপার কোনও যন্ত্র এখনও তৈরি হয়নি। বাতাসের উপরের দিকে ওঠার একটা ভেলোসিটি রয়েছে যা মাপবার কোনও যন্ত্র নেই। অথচ থান্ডারস্টর্ম হয় কিন্তু এই ভেলোসিটির কারণেই অর্থাৎ বাতাসের ঊর্ধ্বগতি যত হবে তত বেশি ব্রজপাত, বিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি বা থান্ডারস্টর্ম হবে। ঊর্ধ্বাকাশে যথেষ্ট জলীয় বাষ্প না থাকার ফলে ডপলার রেডার দিয়েও এই ঊর্ধ্বগতি সম্পূর্ণ মাপা সম্ভব হচ্ছে না। ডপলার রেডার দিয়ে কিছু ক্যালকুলেশন করে ঊর্ধ্বগতি মাপা সম্ভব কিন্তু যেহেতু বাতাসের সব স্তরে জল থাকে না, ফলে সবটা সম্ভব হচ্ছে না। বাতাসের এই ঊর্ধ্বগতি আবহাওয়ামণ্ডলে মিশ্রিত সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি কণার ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। এইসব কণাগুলি আবহাওয়ামণ্ডলে দিনে দিনে প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার ফলে বাতাসে দূষণ ভীষণ পরিমাণে বাড়ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে এবং বায়ুর ঊর্ধ্বগতির পরিবর্তন হচ্ছে যার ফলে এত ঘন ঘন আবহাওয়ার বিপর্যয় ঘটছে বলেই মনে করা হচ্ছে।