ফের বাংলাভাগ নিয়ে সম্প্রতি বিজেপি নেতা-নেত্রীরা নাটক শুরু করেছেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ১৮টা আসন জিতে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন পদ্মপার্টির নেতারা। মাত্র দু’বছর বাদেই ছিল বিধানসভা ভোট। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে মোট ৪২ টার মধ্যে ১৮টা আসন নাগালে আসার বিষয়টা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু রাজনীতিতে অনেক সময় অঘটন ঘটে। সেরকম অঘটনকেই গেরুয়াশিবির স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নিয়েছিল। এবং তার জেরেই বাংলা দখলের স্বপ্নে মশগুল হয়ে উঠেছিল। এই গেরুয়া স্বপ্ন কেবল বাংলার সীমানাতেই আবদ্ধ থাকেনি, তা বিস্তৃত হয়েছিল দিল্লি পর্যন্ত। ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’ আওয়াজ তোলা বঙ্গ-বিজেপি-র নেতারা এবং তাঁদের দিল্লির বড়বাবুরা ধরেই নিয়েছিলেন, বঙ্গের সিংহাসনে তাঁদের বরণ করে নিতে রাজ্যের বাসিন্দারা পুষ্পমালা হাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। নেহাত ভোটের ফল পর্যন্ত অপেক্ষা করার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশে এখনও চালু, তাই! নইলে, ভোটপ্রচার পর্বে দিল্লি থেকে প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা মহামহিমরা কবেই বিশেষ ফ্লাইটে দমদমে নেমে সোজা নবান্নেই পৌঁছে যেতেন! যদিও রাজ্যে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে ‘নিশ্চিত’ হলেও, সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রীর নামটুকু পর্যন্ত ঘোষণা করার সৎসাহস দেখাতে পারেননি কর্তারা।
যাই হোক, ২০২১-এ বাংলা দখলের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। রাজ্যের মানুষ যোগ্য জবাব দিয়েছেন। এমনকী মাত্র দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে ড্যাং-ড্যাং করে জেতা পদ্মশিবিরের কয়েকজন ‘ব্যাপক জনপ্রিয়’ নেতা-নেত্রীও বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়ে ভোটারদের কাছে রামঠোক্কর খেয়েছেন। হয়ত ওঁদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তবে ভোটের ফল দেখে তাঁরা ‘ঝড়ে বক মরা’র প্রবাদবাক্যটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়।
রাজ্যবাসীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে নানা কায়দায় রাজ্যের বিরুদ্ধেই খড়্গহস্ত হয়েছেন দিল্লি দরবারের কর্তারা— এমন অভিযোগের মাত্রা দিনে দিনে বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিল্লির এতটা নেকনজর আগে কোনওকালে পড়েছিল বলে রাজ্যবাসীর স্মরণে আসে না। ভোটের আগে থেকে ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত দিল্লির তরফে এ-রাজ্যে যেরকম তৎপরতা দেখা গেল, তা সত্যিই নজিরবিহীন।
আরও পড়ুন : ভারতে মমতার বিকল্প নেই, দলে ফিরে বললেন বিশ্বজিৎ
যাইহোক, বাংলা-দখলে ব্যর্থ হয়ে গেরুয়া শিবির এখন বাংলাভাগের ফন্দি আঁটতে বসেছে। ১৯৪৭ সালে বাংলা একবার ভাগ হয়েছিল। বাংলা বিভাজনের কারণে সেদিন কোটি কোটি বাঙালিকে যে অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখে পড়তে হয়েছিল, তার জের এখনও কাটেনি। রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গও গোটা দেশে ক্রমশ পিছনের সারিতে হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। যে-বাংলা একদিন গোটা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতকে নেতৃত্ব দিতে গত চুয়াত্তর বছরে সেই বাংলা থেকে একজনও উঠে আসতে পারেননি। সাম্প্রতিক বিধানসভা ভোটের পটভূমি, পরিস্থিতি, ফলাফল বিশ্লেষণ করে অনেকেরই মনে আশার সঞ্চার হয়েছে, বাঙালির সেই ব্যর্থতা-পর্বের অবসান হতে চলেছে। বাংলার নেত্রীর অচিরেই দেশনেত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ সম্ভাবনার আভাস ফুটে উঠছে বহু সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিবেচনাতেও।
ব্যাপারটা নজর এড়াচ্ছে না গেরুয়া শিবিরের। সম্ভবত সে-কারণেই বাংলার স্থিতিশীল পরিবেশকে বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। খণ্ডিত বাংলাকে ফের টুকরো টুকরো করতে ওই শিবির তৎপর। বিজেপি-র দুই সাংসদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে একদিকে উত্তরবঙ্গকে অন্য দিকে পশ্চিমাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি তুলেছেন। তাঁদের দাবি মান্যতা পেলে পশ্চিমবঙ্গ তিন টুকরো হবে। এই দাবি সম্পর্কে ওই দলের কেন্দ্রীয় কর্তাদের মনোভাব কীরকম? এবার বিজেপি যে-ক’টা আসন জিততে পেরেছে, তার সিংহাভাগই উত্তরবঙ্গে। সেই উত্তরবঙ্গের এক সাংসদ জন বার্লাই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক রাজ্য গড়ার দাবি তুললেন। এতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। বার্লা দিল্লিতে তলব পেলেন। মাসখানেকের মধ্যেই দেখা গেল বার্লার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আসন বরাদ্দ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া হল উত্তরবঙ্গের আর এক সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককেও। নিশীথও পশ্চিমবঙ্গকে টুকরো করে পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্য গড়ার দাবিতে সহমত প্রকাশ করেছেন। এগুলি কীসের ইঙ্গিতবাহী?
অন্যদিকে, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলকে নিয়ে পৃথক জঙ্গলমহল রাজ্য গড়ার দাবি তোলা বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খান এখনও তেমন প্রমোশন না পেলেও তাঁর জেলারই আর-এক নেতা সুভাষ সরকারকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেওয়া হল। অর্থাৎ, গেরুয়া শিবিরের দিল্লিওয়ালারা জঙ্গলমহলের বিষয়টিও মাথায় রাখছেন।
আরও পড়ুন : প্রকৃতি রক্ষায় ম্যানগ্রোভ পুঁতছেন মেয়েরা
এদিকে, দক্ষিণবঙ্গের বাঙালিরা যে ফের বাংলাভাগের দাবিটিকে ভাল চোখে দেখছেন না, তা টের পাচ্ছেন এই তল্লাটের নেতা-নেত্রীরা। মাত্র দু’বছর আগে ভোটে জিতে সাংসদ হলেও এবারের বিধানসভা ভোটে দাঁত ফোটাতে পারেননি লকেট চ্যাটার্জি। বাংলাভাগের ইস্যু জোরদার হয়ে উঠলে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে ভোটাররা তাঁকে কুলোর বাতাস দিয়ে ভাগিয়ে দিতে পারেন বলে অনেকের আশঙ্কা। সম্ভবত সে-কারণেই তিনি বাংলাভাগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরব।
আর দিলীপ ঘোষ? তাঁকেও একই কারণে মেদিনীপুরের ভোটারদের সেন্টিমেন্টের কথা মাথায় রাখতেই হচ্ছে। আবার, তিনি এখনও দলের রাজ্য সভাপতিও। এ-কারণে বাংলাভাগ প্রশ্নে তাঁর প্রকাশ্য অবস্থান আপাতত ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। কখনও এদিকে, কখনও ওদিকে দুলছেন।
যা-ই হোক, সৎসাহস থাকলে লুকোচুরি না করে ফের বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে বিজেপি নিজেদের দলীয় অবস্থান প্রকাশ করুক। তাতে ওদের আসল রূপটি রাজ্যবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।