ভারতকে তীর্থক্ষেত্র বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখানে আসবে সবাই, ‘দিবে আর নিবে মিলিবে মেলাবে যাবে না ফিরে’। রবীন্দ্রনাথের যে ভাবনা আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। তার বদলে আজ আমরা আমরা দেখছি ধর্মীয় সংঘাত, ধর্মীয় বিভাজনের ছক। ‘সনাতন হিন্দুধর্মে’র স্বঘোষিত প্রবক্তা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, ভারতীয় জনতা দল। নতুন করে হিন্দুধর্মের জিগির তোলা হচ্ছে। মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্রকে হিন্দু নায়ক বলে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে প্রতিষ্ঠা করা হল রামমন্দির। এখন আবার নতুন করে ইতিহাস লেখার তোড়জোড় হচ্ছে, যে ইতিহাসে থাকবে না মধ্যযুগের মুসলমানদের কথা। উনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ আন্দোলন দেখা গিয়েছিল। একশো বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা লক্ষ্য করছি।
এ রকম সময়ে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উৎসব শুরু হয়েছে। উৎসবের ঢাকঢোল যখন বাজতে শুরু করল, তখন ফিরে দেখার ইচ্ছে জাগল মনে। ফিরে দেখতে পেলাম হেমচন্দ্র কানুনগোকে (Hemchandra Kanungo)। যিনি ইতিহাসে উপেক্ষেত, অহবেলিত। অথচ পূর্বমেদিনীপুরের বেলদা থানার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামের এই মানুষটির অনেক ঐতিহাসিক অবদান আছে। স্বাধীন ভারতের যে জাতীয় পতাকা ১৭বার বিবর্তিত হয়েছে, তিনি তার প্রথম রূপকার। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের সন্মেলনে সেই পতাকা হাতে নিয়ে বক্তৃতা করেছিলেন মাদাম কামা। বিদেশ থেকে বোমা তৈরির কলা-কৌশল শিখে এসেছিলেন হেমচন্দ্র। দেশে ফিরে তৈরি করেছিলেন বোমা। সেই বোমা হাতে নিয়ে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী মজঃফরপুরে গিয়েছিলেন অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে মারতে। বোমা নয় শুধু, বিদেশ থেকে হেমচন্দ্র শিখে এসেছিলেন বিপ্লব পরিচালনার কলা-কৌশল। কিন্তু তখনকার নেতারা হেমচন্দ্রের কথার কোনও গুরুত্ব দেননি। তাঁরা বুঝতে চাননি যে দু’চারজন ইংরেজ হত্যা করলেই দেশ স্বাধীন হবে না। কিন্তু এহ বাহ্য আগে কহ আর। হেমচন্দ্রের (Hemchandra Kanungo) আরও একটা বড় অবদান আছে। তিনি হিঁদুয়ানির আড়ম্বরের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের প্রভাব পড়েছিল তখনকার বিপ্লবীদের উপর। তাঁরা একহাতে গীতা আর অন্যহাতে বন্দুক নিয়ে বিপ্লব করতে নেমেছিলেন। তাই মুসলমানরা স্বদেশি আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাঁর ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’-বইয়ের দুটি অধ্যায়ে হেমচন্দ্র এই হিঁদুয়ানি ও ‘ভক্তিতত্ত্বকুজ্ঝটিকা’ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষের কথা। আধ্যাত্মিক শক্তিলাভের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন অরবিন্দ। গুরুর মাধ্যমে অলৌকিক শক্তিলাভ করলে তাতে মানুষ আকৃষ্ট হবে, দলে দলে এসে গুপ্ত সংগঠনে নাম লেখাবে— এই ছিল অরবিন্দের ধারণা। তাই অলৌকিক গুরুর সন্ধানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নানা স্থানে পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ হল ‘মন্ত্রবলে সোনা ফলাইবার অবাস্তব কল্পনা’।
আরও পড়ুন: মহড়ার আড়ালে কি যুদ্ধের প্রস্তুতি?
হেমচন্দ্র ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ তিনি জানতেন। দেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়ন বিজ্ঞানের হাত ধরেই অগ্রসর হবে। কোনও আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’-এর ধুয়া তুলে মানুষকে বোকা বানাবার, মানুষের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। ঘৃণা করেছেন বর্ণভেদ ও জাতিভেদকে। আন্দামান সেলুলার জেল থেকে নিজের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে স্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছেন পাত্র যদি খাঁটি মানুষ হয়, তাহলে সে হিন্দু না মুসলমান না খ্রিস্টান, সে বিচার দরকার নেই। বিদ্যাসাগরের দেশের মানুষ হেমচন্দ্রের মানব-অতীত ও মানব- ব্যতীত কোনও কিছুকে প্রশ্রয় দেননি।